শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

প্রিয়জনের হাতে খুন বাড়ছে

তুচ্ছ কারণ ধর্মীয় শিক্ষার অভাব ও সেই সাথে তরুণদের সামনে স্বপ্ন না থাকায় অস্থিরতা বাড়ছে। স্যাটেলাইট চ্যানেলে প্রচারিত সিরিয়ালগুলোর প্রভাব ব্যক্তিজীবনে ও সমাজজীবনে : মনোবিজ্ঞানী আমা

সাখাওয়াত হোসেন | প্রকাশের সময় : ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

খুন, ধর্ষণ, প্রতারণার ঘটনাগুলো বেশিরভাগ ঘটছে ভিকটিমের আপনজনের হাতে! জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধে ভাইয়ের হাতে ভাই খুন, ছেলের হাতে বাবা খুন, ভাতিজার হাতে চাচা খুন, যৌতুক বা নেশার টাকা না পেয়ে স্বামীর হাতে স্ত্রী খুন, অবৈধ সম্পর্কের কারণে দুলাভাইয়ের হাতে শালিকা খুন, মায়ের হাতে সন্তান খুন, বাবার হাতে শিশু খুন, বাবার দ্বারা মেয়ে বহু বছর ধরে ধর্ষিত, চাচার কাছে ভাতিজি ধর্ষিত ইত্যাদি খবরে প্রতিদিনকার পত্রিকা ঠাঁসা। এ জাতীয় অপরাধের ঘটনা কমার বদলে ক্রমশ বেড়েই চলেছে। এক কথায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একের পর এক খুনের ঘটনা ঘটছে।

দুই মেয়েকে সম্পত্তির ভাগ দেয়ার কথা শুনেই বাবাকে হত্যার পরিকল্পনা করে একমাত্র ছেলে মাসুদ (৪২)। এজন্য ৫ লাখ টাকা চুক্তিতে অটোড্রাইভার মো. রুবেলকে যুক্ত করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী শ্বাসরোধ করে বাবাকে হত্যার পর ডাকাতির নাটক সাজায় ছেলে মাসুদ। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ধর্মগঞ্জ মাওলা বাজার এলাকায় নিজ বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম (৭২) গত ৩১ জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে ঘুমিয়ে পড়লে রুবেল ও মাসুদ তার রুমে প্রবেশ করে। প্রথমে মাসুদ তার বাবার হাত-পা চেপে ধরে, আর রুবেল গলা চেপে ধরে।

এ সময় চিৎকার দিলে রুবেল বালিশ দিয়ে মুখ চেপে শ্বাসরোধ করে মৃত্যু নিশ্চিত করে। খুনের পর ছেলে মাসুদ তার ঘরে থাকা ডিজিটাল ব্লাড প্রেসার মাপার যন্ত্র দিয়ে ব্লাড প্রেসার মেপে মৃত্যু হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হন। পরে আলমারি থেকে ৫ লাখ টাকা এবং তাদের বাসার সিসি টিভি ক্যামেরার ডিবিআর বক্স বাইরে ফেলে দেয়ার জন্য রুবেলকে দেয়। গত শনিবার রুবেলকে গ্রেফতার করে পিবিআই। এর পর জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। তবে এখনও অধরা ঘাতক মাসুদ।

সমাজ ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ করা, নৈতিক অবক্ষয় ও মানসিক বিষণ্নতা দূর করা না গেলে এ ধরনের খুনের ঘটনা বাড়তেই থাকবে। পারিবারিক বন্ধন না থাকার কারণে মা-ছেলেকে, ছেলে মা-বাবাকে খুন করছে। ধর্মীয় শিক্ষার অভাব এবং সেই সাথে তরুণদের সামনে কোনো স্বপ্ন না থাকায় সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে। তারা আরো বলছেন, বিকৃত মানসিকতা, মানসিক বিষণ্নতা, আত্মকেন্দ্রিকতার কারণে প্রিয়জনের হাতে প্রিয়জন খুনের ঘটনা বাড়ছে। স্যাটেলাইট চ্যানেলে প্রচারিত সিরিয়ালগুলোর প্রভাব পরিবার ও ব্যক্তিজীবনেও পড়ছে। নিজেকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ায় কেউ কারও সঙ্গে খোলামেলা আলাপ করছে না। ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব বাড়ছে। তুচ্ছ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে একে অপরকে খুন করতেও তাই দ্বিধা করছে না তারা।

আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন ইনকিলাবকে বলেন, পরিবারকেন্দ্রিক অপরাধ উদ্ঘাটনে অনেক সময় তদন্তকারী কর্মকর্তাও বিস্মিত হয়ে পড়ে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সন্দেহাতীত ঘটনাও সত্যি হয়ে যায়। আমাদের মধ্যে সামাজিক সম্পর্কোন্নয়ন ও পারিবারিক বন্ধন বাড়াতে হবে। এখন পুলিশের তদন্তের ক্ষেত্রে অগ্রগতি হয়েছে। কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে ৯৫ ভাগ মামলায় জড়িতদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে। কোনো একটি অপরাধ বেড়ে গেলে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হলে সেই অপরাধ দ্রুত কমে যায়। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি সকলকে আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে অপরাধ কমবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের একজন সমাজবিজ্ঞানী বলেন, যুবকদের সামনে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কোনো আদর্শ নেই। এগুলো সংস্কারে রাষ্ট্রকেই উদ্যোগী হতে হবে। আদর্শহীন পরিবারে অর্থবিত্ত ও রং-ঢঙে আবহে আবেগতাড়িত হয়ে বড় হচ্ছে তারা। এ ছাড়া পারিবারিক বন্ধনের অনভূতি না থাকা আর নৈতিক অবক্ষয়ের কারণে তুচ্ছ ঘটনায় প্রিয়জনকে খুন করতে দ্বিধা করছে না। তাই পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের চেয়ারপার্সন খন্দকার ফারজানা রহমান ইনকিলাবকে বলেন, মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং হতাশার কারনে পারিবারিক বিরোধ বাড়ছে। আমাদের পরিবার প্রথা ভেঙে যাচ্ছে। যে কারণে সামাজিক মূল্যবোধ আমাদের থেকে কমতে শুরু করেছে। এখন আমরা ব্যক্তি স্বার্থের কথা চিন্তা করি, নিজের বেনিফিট নিয়ে চিন্তা করি। সামাজিক পতিপত্তি নির্ধারণের একমাত্র নিয়ামক হচ্ছে ক্ষমতা। সেটা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক ক্ষমতাও হতে পারে। আমাদের সামাজিক কাঠামোর মূল জায়গা এখন ক্ষমতা ছাড়া সামাজিক পতিপত্তির নির্ধারণের উপায় নেই। বিকৃত মানসিকতা, মানসিক বিষণ্নতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতার কারনে প্রিয়জনেরাই প্রিয়জনের অপরাধী হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করতে হবে। এজন্য রাষ্ট্রকেই উদ্যোগ নিতে হবে।

মানুষের এহেন অমানবিক হওয়া প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, দিনের পর দিন আমাদের মানসিকতা ও মানবিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়ন নীতি এবং আসলে আমরা পুঁজিবাদকে মূল জায়গায় নিয়ে এসেছি। পূর্বে আমাদের একটা সুন্দর সম্প্রদায়ভুক্ত জীবন ছিল। যেখানে আমরা একে-অপরের সবকিছু শেয়ার করতাম। ছিল পারিবারিক ও সামজিক বন্ধন। যা ছিল ইসলামী মূল্যবোধের সাথে প্রচণ্ড রকমের ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। আমাদের মমত্ববোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এটাই মূল কারণ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্প্রতি সিআইডি থেকে অবসরে গেছেন এমন একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, পারস্পরিক সহিংস মনোভাব ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাবে এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। আইনের শাসন ও বিচার প্রার্থীদের বিচার নিশ্চিত হলে এধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। তাই এটা নিশ্চিত করা খুব জরুরি। ধর্মীয় রীতিনীতি অনুসরণ এবং পারিবারিক সেতুবন্ধন তৈরি হলেই এ ধরনের হত্যাকাণ্ড রোধ করা সম্ভব হবে।

গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শংকর এলাকায় মাদরাসা শিক্ষার্থী ৮ বছরের শিশু সাইম বাবুকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে সৎ মা রেশমা খাতুন। এ ঘটনায় সাইমের বাবা মাহবুল ইসলাম মামলা করেন। মামলা সম্পর্কে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা হাজারীবাগ থানার এসআই মাহফুজার রহমান বলেন, সাইম বাবুকে তার সৎ মা রেশমা খাতুন বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করেছে। রেশমা খাতুন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন। পরে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।

বিদেশ ফেরত ছেলে ও তার বউয়ের মার খেয়ে বিচারের দাবিতে শেষ পর্যন্ত থানায় যেতে হয়েছে মা আঙ্গুরা বেগমকে (৫০)। এ ঘটনাটি ঘটেছে রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার মহিপাড়া গ্রামে। গত সোমবার থানায় যাওয়ার আগে তিনি এ ব্যাপারে ইউএনও-এর দফতরেও নালিশ দেন। এরপর স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসা নিয়ে থানায় যান ওই মা। আঙ্গুরা বেগম সাংবাদিকদের জানান, সাইদুল তার একমাত্র ছেলে। ভরণ-পোষণ দেয় না ছেলে ও তার বউ। মানুষের বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে কোনোভাবে জীবিকা নির্বাহ করেন। এরপরও কোনো কিছু হলেই ছেলে ও তার বউ মিলে তাকে কথায় কথায় মারধর করে। এ নিয়ে এর আগেও গ্রামে একাধিকবার সালিশ-বৈঠক হয়েছে। কিন্তু এই সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন