একজন মুমিনের প্রকৃত সফলতা হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও জান্নাত লাভ করা। যে তা অর্জন করতে পারবে সে-ই সফল। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ইরশাদ করেন, প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করবে এবং তোমাদের সকলকে কিয়ামতের দিন (তোমাদের কর্মের) পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হবে। তখন যাকেই জাহান্নাম থেকে দূরে সরিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সে-ই প্রকৃত অর্থে সফলকাম। আর এই পার্থিব জীবন তো প্রতারণার উপকরণ ছাড়া কিছু নয়। (সূরা আলে ইমরান : ১৮৫)
জান্নাত মুমিনের চির সুখ এবং অনাবিল শান্তির ঠিকানা। পরম আরাধ্য ও কাক্সিক্ষত স্থানও বটে। প্রতিটি মুসলিম জান্নাত কামনা করে। জান্নাত লাভে আল্লাহর কাছে দোয়া ও প্রত্যাশা করে। সেই কাঙ্খিত জান্নাত কেমন হবে? সেখানে কী কী নেয়ামত থাকবে প্রতিটি মুমিনহৃদয়ে সে কৌতুহল রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন হাদীসে তা বর্ণনা করেছেন। তবে সেসব বর্ণনা বান্দাদের বুঝানোর জন্য মাত্র। না হয় জান্নাতের নেয়ামতের প্রকৃত চিত্র কোন মানুষ দুনিয়ায় থেকে অনুধাবন করতে পারে না। নিম্নে ধারাবাহিক জানন্নাতের নেয়ামত রাজির বর্ণনা তুলে ধরা হলো।
জান্নাতের নেয়ামত হবে অদ্বিতীয় ও কল্পনাতীত : জান্নাতে আল্লাহ তায়লা মুমিনদের জন্য অসংখ্য নেয়ামত রাজি প্রস্তুত করে রেখেছেন। যেগুলো অদ্বিতীয় এবং কল্পনাতীত। প্রকৃত অর্থে দুনিয়ায় থেকে সেসকল নেয়ামতের উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত : এক হাদিসে কুদসিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসালাম ইরশাদ করেন, ‘মহান আল্লাহ বলেছেন, আমি আমার নেককার বান্দাদের জন্য এমন জিনিস (জান্নাত) তৈরি করে রেখেছি, যা কোন চক্ষু দেখেনি, কোন কান শুনেনি এবং যার সম্পর্কে কোন মানুষের মনে ধারণাও জন্মেনি। তোমরা চাইলে এ আয়াতটি পাঠ করতে পার, ‘কেউ জানেনা, তাদের জন্য তাদের চোখ শীতলকারী কী জিনিস লুকানো আছে’। (আস-সাজদাহ : ১৩ সহিহ বুখারী, হাদিস নং-৩২৪৪)।
জান্নাতের কিসের তৈরি : আবূ হুরাইরাহ্ (রা.) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, আমি প্রশ্ন করলাম : হে আল্লাহ্র রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! কী দিয়ে জান্নাত তৈরি করা হয়েছে? তিনি বললেন : সোনা-রুপার ইট দিয়ে। একটি রুপার ইট, তারপর একটি সোনার ইট, এভাবে গাঁথা হয়েছে। এর গাঁথুনির উপকরণ (চুন-সুরকি-সিমেন্ট) সুগন্ধি মৃগনাভি এবং কঙ্করসমূহ মণি-মুক্তার ও মাটি হলো জাফরান। (তিরমিজি-২৫২৬)।
জান্নাতে প্রবেশকারী প্রতিটি মুমিনের চেহারা সেদিন উজ¦ল থাকবে : জান্নাতে প্রবেশকারী প্রতিটি মুমিনের চেহারা চাঁদের ন্যায় উজ্জল থাকবে। তবে প্রবেশে অগ্রগামীদের উজ¦লতা পরবর্তীদের চেয়ে বেশি হবে। সর্বপ্রথম প্রবেশকারীদের চেহারা হবে পূর্নিমার চাঁদের ন্যায়। হাদিস শরীফে ইরশাদ হচ্ছে, আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিতঃ: তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘যে দল প্রথমে জান্নাতে প্রবেশ করবে তাদের চেহারা পূর্ণিমার রাতের চাঁদের মত উজ্জ্বল হবে। তারা সেখানে থুথু ফেলবে না, নাক ঝাড়বেনা, মল মূত্র ত্যাগ করবেনা। সেখানে তাদের পাত্র হবে স্বর্ণের; তাদের চিরুণী হবে স্বর্ণ ও রৌপ্যের, তাদের ধুনুচিতে থাকবে সুগন্ধি কাষ্ঠ। তাদের গায়ের ঘাম মিসকের মত সুগন্ধময় হবে। তাদের প্রত্যেকের জন্য এমন দু’জন স্ত্রী থাকবে যাদের সৌন্দর্যের কারণে গোশত ভেদ করে পায়ের নলার হাড়ের মজ্জা দেখা যাবে। তাদের মধ্যে কোন মতভেদ থাকবে না; পরস্পর হিংসা-বিদ্বেষ থাকবে না। তাদের সকলের অন্তর এক অন্তরের মত হবে। তারা সকাল- সন্ধ্যায় আল্লাহর তাসবীহ পাঠ করতে থাকবে।’ (বুখারী-৩২৪৫)।
অন্য হাদীসে এসেছে যে, এই উম্মতের সত্তর হাজার লোক একত্রে পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় উজ্জল চেহারা নিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সাহ্ল ইব্নু সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিতঃ: নবী কারীম (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম), বলেছেন, আমার উম্মাতের সত্তর হাজার লোক অথবা সাত লক্ষ লোক একই সঙ্গে জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের কেউ আগে কেউ পরে এভাবে নয় আর তাদের চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্জ্বল থাকবে। (সহিহ বুখারী, হাদিস নং-৩২৪৭)।
জান্নাতের বিন্দু পরিমাণ জায়গা দুনিয়া এবং তাতে যা রয়েছে তা থেকে উত্তম : একজন মুমিন জীবনে যতই কষ্ট করুক না কেন। যখন সে জান্নাতে প্রবেশ করবে তখন জান্নাতের এক বিন্দু নেয়ামতের বিনিময়ে ইহকালীন সকল কষ্ট ভুলে যাবে। কারণ জান্নাতের প্রতি ইঞ্চি জায়গা এবং নেয়ামত হবে দুনিয়া এবং যা কিছু রয়েছে তা থেকে উত্তম। সাহ্ল ইব্নু সা’দ (রা.) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘জান্নাতে চাবুক পরিমাণ সামান্য জায়গাও দুনিয়া এবং এর মধ্যে যা আছে তার থেকে উত্তম। (সহিহ বুখারী-৩২৫০)।
জান্নাতের নেয়ামতের ঝলকে পৃথিবীর আলো ম্লান হয়ে যাবে : সা’দ ইবনু আবী ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত : নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যদি জান্নাতের কোন জিনিসের এক চিমটি পরিমাণও (পৃথিবীতে) আসতে পারতো তাহলে আসমান-যমীন সকল স্থান আলোকিত ও সৌন্দর্যমন্ডিত হয়ে যেতো। কোন জান্নাতী যদি দুনিয়াতে উঁকি দিত এবং তার হস্তালংকার প্রকাশিত হয়ে পড়তো তাহলে তা সূর্যের আলোকে নিস্তেজ করে দিত যেভাবে সূর্যের আলো নক্ষত্রসমূহের আলোকে নিস্তেজ করে দেয়। (তিরমিজি-২৫৩৮)।
জান্নাতিদের প্রতি আল্লাহর চিরস্থায়ী সন্তুষ্টি প্রকাশ : একজন মুমিনের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। সে সন্তুষ্টি অর্জনেই আল্লাহর বিধান পালন ও ইবাদত করা হয়। জান্নাতে প্রবেশ করার পর আল্লাহ তায়ালা জান্নাতীদের প্রতি চিরস্থায়ী সন্তুষ্টি প্রকাশ করবেন। হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাযি.) সূত্রে নবী (সা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ জান্নাতী লোকদেরকে লক্ষ্য করে আল্লাহ তাআলা বলবেন, হে জান্নাতীগণ! তারা বলবে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আপনার নিকটে উপস্থিত আছি। সমস্ত কল্যাণ আপনারই হাতে। অতঃপর তিনি বলবেন, তোমরা কি সন্তুষ্ট? তারা উত্তর দেবে, হে আমাদের প্রতিপালক! কেন আমরা সন্তুষ্ট হবো না? অথচ আপনি আমাদেরকে এমন জিনিস দান করেছিলেন যা আপনার সৃষ্টি জগতের অন্য কাউকে দান করেননি। তিনি বলবেন আমি কি তোমাদেরকে এর থেকে উত্তম জিনিস দান করব না? তারা বলবে, হে রব! এর চাইতে উত্তম বস্তু আর কি হতে পারে? অত:পর আল্লাহ বলবেন : আমি তোমাদের উপর আমার সন্তুষ্টি অবতরণ (স্থাপন) করব। এরপর তোমাদের উপর আমি আর কখনো অসন্তুষ্ট হবো না। (সহীহ মুসলিম, ইফা নং-৬৮৭৮)।
জান্নাতিদের নেয়ামত হবে চিরস্থায়ী : জান্নাতের প্রতিটি নেয়ামত হবে চিরস্থায়ী। তা কখনো নিঃশেষ বা ক্ষয় হবে না। হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেন : যে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে সে আরাম আয়েশে থাকবে ও চিন্তামুক্ত থাকবে। তার কাপড় কখনো পুরাতন হবে না এবং তার যৌবন কখনো নিঃশেষ হবে না। (সহীহ মুসলিম, ইফা নং-৬৮৯৩)। অন্য বর্ণনায় হযরত আবু সাঈদ খুদরী ও আবু হুরায়রা (রাযি.) থেকে বর্ণিত। নবী (সা.) বলেনঃ কোন আহবানকারী জান্নাতী লোকদেরকে আহবান করে বলবে, এখানে (সর্বদা) তোমরা সুস্থ থাকবে, আর কখনো অসুস্থ হবে না। তোমরা যুবক থাকবে, কখনো আর তোমরা বৃদ্ধ হবে না। তোমরা (সর্বদা) সুখ-সাচ্ছন্দ্যে থাকবে, কখনো আর তোমরা কষ্ট- ক্লেশে পতিত হবে না। এ মর্মে আল্লাহর বাণীঃ এবং তাদেরকে সম্বোধন করে বলা হবে, তোমরা যা করতে তারই জন্য তোমাদেরকে এ জান্নাতের উত্তরাধিকারী করা হয়েছে। (সহীহ মুসলিম, ইফা নং-৬৮৯৪)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন