নারী জাগরণের পথিকৃত ও নারী মুক্তির অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার পৈত্রিক বাড়িটি এখন কেবলই কিছু পুরনো দিনের ভাঙা, আধা ভাঙা ইটের স্তূপ হিসেবে টিকে আছে। পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে এটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় ঝড়-বৃষ্টি-রোদে দিনে দিনে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মাটির সাথে মিশে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। বাড়িটির পাশেই অবশ্য রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র রয়েছে। কেন্দ্রটির পরিচালনায় রয়েছে বাংলা একাডেমি।
বেগম রোকেয়ার স্মৃতিধন্য পায়রাবন্দ গ্রাম ও ইউনিয়নটি ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে রংপুরের দিক থেকে আসতে হাতের বাঁদিকে অবস্থিত। প্রশস্থ ফিডার সড়ক ধরে মোটর বাইকে ১০ মিটিটেই পৌঁছে দেখা মিলবে বেগম রোকেয়ার স্মৃতি নিবাসের। প্রায় বিঘার কাছাকাছি স্কয়ার আয়তনের পুরনো জমিদার বাড়ির ধ্বংসচিহ্ন হয়ে এখনো টিকে আছে। বাড়িটির বাইরের চারিদিকে বাউন্ডারি ওয়াল থাকায় অবশ্য স্থানটি সংরক্ষিত অবস্থায় থাকে।
বাড়িটির পাশে যেতেই সত্তোরোর্ধ এক মহিলা জানতে চাইলেন আপনারা কে, কোথা থেকে আসছেন? পরিচয় বলতেই হেসে নিচের আঁচল থেকে চাবি বের করে গেট খুলে দিয়ে বললেন, যান ভেতরে যান, ছবি তোলেন। ছবি তোলার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম তার পরিচয়। জবাবে বললেন, তিনি সালেহা, বয়স ৭০। পাশেই তার বাড়ি। গেটের চাবি তার কাছে কেন জানতে চাইলে বললেন, এটা আমার স্বামীর চাকরি ছিল। তিনি মারা গেলে তার ছেলে চাকরিটা পায়। ছেলে মারা গেলে নাতি শফিকুল এই চাকরিটা পায় (সম্ভবত আর্কিওলজি ডিপার্টমেন্ট অথবা জেলা পরিষদের মাস্টার রোল কর্মচারি সবাই)। বেতন ১৩ হাজার টাকা। নাতি শফিকুলের বর্তমান কর্মস্থল রাজহাটের জমিদার বাড়ি হওয়ায় তার বদলী হিসেবে ডিউটি করছেন সালেহা। বিনিময়ে শফিকুলের বেতন থেকে ১,৩০০ টাকা কেটে দেয়া হয় তাকে। এ টাকাতেই চলতে হয় সালেহাকে।
এছাড়াও প্রতিদিন যেসব দর্শনার্থী তাকে কিছু বখশিস দেয় এতই চলে যায় তার -উত্তর দেন সালেহা।
এরপর তিনি ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই ঘুরে ঘুরে সালেহা দেখিয়ে দেন, এখানে রোকেয়া জানালা দিয়ে বাইরে গ্রাম দেখতেন, এখানে বইয়ের আলমারি (বুক শেলফ) ছিল, এখানে পড়াশোনা করতেন। এই ব্যালকোনিতে হেঁটে বেড়াতেন, এখানে খাওয়া দাওয়া করতেন। তিনি জানালেন, কোলকাতার সাখাওয়াত রোকেয়াক বিয়ে করে নিয়ে গেল আর ওখানেই মারা গেল, কথাটা বলতেই যেন গলাটা ধরে এল সালেহার।
এমনভাবে বর্ণনা করলেন সালেহা, যেন মনে হচ্ছিল তিনি রোকেয়াকে নিজের চোখে দেখেছেন। সঙ্গত কারণেই বললাম আপনি এসব জানলেন কিভাবে? বললেন, মুরুব্বিদের মুখে শুনেছি, মুরুব্বিরা তার মুরুব্বিদের মুখে শুনেছেন।
বেগম রোকেয়ার বাড়ির প্রাচীর ঘেঁষেই রয়েছে একটি লাইব্রেরি। রোকেয়া স্মৃতি লাইব্রেরি নামের পাঠাগারটির লাইব্রেরিয়ান রফিকুল ইসলাম দুলাল জানালেন, সম্পূর্ণ স্থানীয় উদ্যোগে ১৯৮৫ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেছেন তারা। শুরু থেকেই তিনি এখানে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। লাইব্রেরির সদস্যরা এখান থেকে বই নিয়ে পড়তে পারেন। বেগম রোকেয়ার সকল বই, নির্বাচিত প্রবন্ধসহ প্রায় সব ধরনের বই এখানে পাওয়া যায়। তবে মোবাইল প্রযুক্তির এ যুগে এসে বইয়ের পাঠকসংখ্যা খুবই কমে গেছে। রফিকুল ইসলাম জানালেন, বেগম রোকেয়ার বাড়িটির স্থায়ী সংরক্ষণের জন্য তিনি সরকার ও প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
ইতিহাস ও সমাজ সচেতন রফিকুল ইসলাম দুলাল জানালেন, বেগম রোকেয়াকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৭২ সালে বেগম রোকেয়ার জন্মভিটায় ‘নিত্য স্মরণয়ী’ নামে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়। ফলকটি স্থাপন করেন তৎকালীন নারী কল্যাণ সংস্থা ঢাকার সভানেত্রী বেগম সুফিয়া কামাল। এছাড়া বাংলা একাডেমি এখানে তিন একর জায়গার ওপর ১৯৯৭ সালে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র নামে একটি স্থাপনা তৈরি করেছে। ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি ৭৮ লাখ ৮১ হাজার টাকা। এ স্মৃতি কেন্দ্রে রয়েছে একটি করে হল, সেমিনার কক্ষ, লাইব্রেরি, পুকুর, অতিথিশালা। সরকারি ছুটির দিন ছাড়া এসব অফিস টাইমে বিনা পয়সায় ঘুরে দেখা যায়।
লাইব্রেরি সংলগ্ন দুটি হস্তশিল্পের একটির পরিচালক বিউটি বেগম জানালেন, এখানে পিকনিক ফ্যাসিলিটি থাকলে পর্যটকের সংখ্যা বাড়তো বলে মনে করেন তিনি। পায়রাবন্দ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো. আনিছুর রহমান জানালেন, বেগম রোকেয়ার স্মৃতিধন্য পায়রাবন্দ ছাড়াও রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলা বিখ্যাত মোঘল মসজিদ, ফুলচৌকি মসজিদ, শাহ ইসমাইল গাজী এবং মোঘল সেনাপতি মীর জুমলার স্মৃতিধন্য বিশাল মিঠাপুকুর দীঘির মতো পর্যটন স্পট থাকলেও প্রয়োজনীয় প্রচার এবং পর্যটন সুবিধার অভাবে এখানে কাক্সিক্ষত পর্যটক আসেন না। রংপুরের বিখ্যাত হাঁড়িভাঙ্গা আমের বৃহত্তম চালানও যায় মিঠাপুকুরের ঘোড়াগাছা ইউনিয়ন থেকেই বলে জানালেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন