প্রগতিশীল রাজনীতিতে বাধা
ফারুক হোসাইন, পার্বত্য অঞ্চল থেকে ফিরে : প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল নিয়ে ষড়যন্ত্র করছে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলো। পাহাড়ে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে বাঙালিদের কোণঠাসা করে রাখার পাশাপাশি বাধা দেয়া হচ্ছে মূলধারার রাজনীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের। কথা না শুনলে অপহরণের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। অন্যদিকে পাহাড়ের গহীনে অস্ত্রের ভান্ডার গড়ে তোলার পাশাপাশি চাঁদাবাজির মাধ্যমে সমৃদ্ধ হচ্ছে অর্থনৈতিকভাবেও। পিছিয়ে নেই রাষ্ট্র বিরোধী প্রচার-প্রপাগান্ডায়। বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে এক শ্রেণির ষড়যন্ত্রকারী কথিত জুম্মল্যান্ডের নামে নানারকম প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আসছে। পার্বত্য অঞ্চলে স্বায়ত্তশাসনের কথা বললেও ফেইসবুক ও তাদের পরিচালিত অনলাইন পেইজগুলোতে নিজেদের তৈরি পতাকা, পরিচয়পত্র ও মুদ্রার ছবি ছড়িয়ে দিচ্ছে। সম্প্রতি পার্বত্য অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে এমনই কিছু ছবি ইনকিলাবের হাতে আসে। এগুলো কারা বা কিভাবে ছড়াচ্ছে সে বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা না গেলেও স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজীসহ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে বিরোধ থাকলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার বিষয়ে একসাথে ষড়যন্ত্র করছে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলো। তবে এই কাজে তারা সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখছে ওই অঞ্চলের বাঙালিদের। প্রগতিশীল জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে বাধা দেয়া হচ্ছে রাজনৈতিক কর্মকান্ডে। সাম্প্রতিক সময়েই আওয়ামী লীগের সমাবেশে যোগ দেয়ার কারণে অপহরণ করা হয়েছে তিনজন উপজাতীয় আওয়ামী লীগ নেতাকে। ছাড় দেয়া হচ্ছে না বিএনপি’র নেতাদেরও। ১১ নম্বর সেক্টরের ২ এম এফ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা জহুরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, আমরা যদি পার্বত্য এলাকায় না আসতাম তাহলে এখানকার সন্ত্রাসীরা এতোদিন পার্বত্য এলাকায় স্বাধীনতা ঘোষণা করে দিত। এমনিতেই তো তারা আমাদের বের করে দিয়ে স্বাধীনতা চাচ্ছে। আমরাই তাদের স্বাধীনতার পথে প্রধান বাধা হয়ে আছি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৭ সালে শান্তি চুক্তির শর্তগুলো সরকারের পক্ষ থেকে অধিকাংশ বাস্তবায়ন করলেও বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলো কিছুই বাস্তবায়ন হয়নি বলে প্রপাগান্ডা প্রচার করছে। শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অস্ত্র সমর্পণের বিপরীতে আরও বিপুল পরিমাণ অস্ত্র মজুদ করে যাচ্ছে। অস্ত্রের ভান্ডারের পাশাপাশি গড়ে তুলেছে নিজস্ব সেনাবাহিনীও। যাদের কাছে রয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আসা অত্যাধুনিক সব অস্ত্রের সম্ভার। ফেইসবুক ও অনলাইনে কথিত জুম্মল্যান্ডের নামে পতাকা, পরিচয়পত্র, মুদ্রা ইত্যাদি ছড়িয়ে দিচ্ছে। জুম্মল্যান্ড গঠনের জন্য সকলকে একসাথে কাজ করারও আহ্বান জানাচ্ছে তারা। প্রতিষ্ঠার দেড়যুগ উপলক্ষে গত ২৫ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে ইউনাইটেড পিপল্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) এর সভাপতি প্রসিত খীসা ও সাধারণ সম্পাদক রবি শংকর চাকমা পার্বত্য এলাকার রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বায়ত্তশাসনের দাবি জানায়।
কথিত জুম্মল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরিচয়ে করুনালংকার ভিক্ষু এক সাক্ষাতকারে বলেছেন, “ট্যুভালু, জিবুতি, পূর্ব তিমুর, দক্ষিণ সুদান, মার্শাল আইল্যান্ড আমাদের সামনে স্বাধীন হলো। যদি পূর্ব তিমুর সাড়ে তিন লাখ জনসংখ্যা নিয়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে স্বাধীন পেতে পারে আমরা বাংলাদেশ থেকে স্বাধীন পাবো না কেন? আমাদের সামনে ওসেটিয়া (জর্জিয়া), আবখাজিয়া (জর্জিয়া) এবং ক্রিমিয়া (ইউক্রেন) থেকে স্বাধীন হয়েছে। আমরাও অবশ্যই পাবো। তিনি বলেন, সামরিক যুদ্ধে তিনটা ক্ষেত্র সাপ্লাই গ্রুপ, রিয়ার কাত (পিছন কাটা) গ্রুপ এবং মেইন ব্যাটেল (যুদ্ধ) গ্রুপ রয়েছে এবং বর্তমানে তিনটির ক্ষেত্রে জেএসএস-সন্তু গ্রুপ দুর্বল এবং শক্ত করার চেষ্টা চলছে। বুলেট আনার পথগুলো রয়েছে এবং সবসময় প্রচেষ্টা চলছে। কি করে বুলেট আরো আনা হবে সে ব্যাপারে পার্টি (জেএসএস-সন্তু গ্রুপ) চিন্তা করছে। জুম্ম জাতির জনক হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাকে। যার বর্তমান রূপ হচ্ছে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) এবং এর নেতা সন্তু লারমা। অনলাইনজুড়ে প্রচার-প্রপাগান্ডার বিষয়ে জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমা বলেন, এরকম অনেক কিছু আমাদেরও নজরে এসেছে। এগুলো যারা করছে তারা উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে ছড়াচ্ছে। পার্বত্য এলাকার সমস্যাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য করছে। তিনি বলেন, এরকম কিছু দাবি থাকলেও শান্তিচুক্তিতে যেহেতু উল্লেখ নেই তাই এটা নিয়ে আন্দোলন, প্রপাগা-া অনর্থক।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের সংরক্ষিত আসনের এমপি ফিরোজা বেগম চিনু বলেন, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি একটি বৃহৎ অংশ পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও ১৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে রেখেছিল। সন্তু লারমা এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের ভোটার হননি। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক কি না, তাও আমরা জানি না।
প্রগতিশীল রাজনীতিতে বাধা : বাঙালিদের ভূমি দখল, চাষের জমিতে যেতে বাধা, চাঁদা আদায়ের পাশাপাশি প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে জড়িত উপজাতীয় নেতাকর্মীদেরও নানাভাবে বাধা দিচ্ছে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো। গত ২৯ নভেম্বর খাগড়াছড়িতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের জনসভায় যোগ দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার বর্মাছড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি নীলবর্ণ চাকমাকে অপহরণ করে ইউপিডিএফ। ‘জীবনে আর কোনো দিন আওয়ামী লীগ করবো না’ এমন মুচলেকা দিয়ে তিন দিন পর মুক্তি পান তিনি। নীলবর্ণের ঘনিষ্ঠজনেরা জানান, ইউপিডিএফ অধ্যুষিত বর্মাছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় নীলবর্ণ চাকমাকে বিভিন্ন সময় হুমকী দেয়া হয়। ওবায়দুল কাদেরের জনসভায় যাতে না যাওয়া হয়, সেজন্য নীলবর্ণকে আগেই সতর্ক করেছিল পাহাড়ি আঞ্চলিক সংগঠন ইউপিডিএফ নেতাকর্মীরা। বান্দরবানের আওয়ামী লীগ নেতা মংপ্রু মারমাকে গত ১৩ জুন অপহরণ করা হয়। এরপর থেকে এখনো তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। মংপ্রু মারমার স্ত্রী সামা প্রু মারমা জানান, তার স্বামী বান্দরবান সদর থানার ১ নম্বর রাজবিলা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক মেম্বার এবং সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতা। গত ১৩ জুন রাত ১০টার দিকে তার স্বামী প্রতিবেশী ক্রানু মারমার ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন। এ সময় দুর্বৃত্তরা এসে বাইরে থেকে তাকে ডাকাডাকি করে। তিনি ঘর থেকে বের হলে অস্ত্র ঠেকিয়ে দুর্বৃত্তরা তাকে নিয়ে যায়। সেই থেকেই নিখোঁজ তিনি। নিখোঁজের ঘটনায় তিনি মামলায় যাদের আসামি করেছেন তারা সবাই সন্তু লারমার জেএসএসের সদস্য। এর মধ্যে এক নম্বর আসামি কে এস মং মারমা এবং দুই নম্বর আসামি সাধুরাম ত্রিপুরা মিল্টন আঞ্চলিক জেলা পরিষদ সদস্য। কয়েকমাস আগেই রাঙামাটির বিলাইছড়ি থেকে আওয়ামী লীগ নেতা দয়াল চন্দ্রকে অপহরণ করা হয়। কেবলমাত্র আওয়ামী লীগ করার কারণে তাকে অপহরণ করা হয় বলে অভিযোগ করেন পার্বত্য অঞ্চলের সংরক্ষিত আসনের এমপি ফিরোজা বেগম চিনু।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন