পিতার নেতৃত্বে নৌদস্যু দল। আর সে দলের অন্যতম সদস্য কিশোর পুত্র। উত্তাল গভীর সমুদ্রে নিজেদের ফিশিং বোট নিয়ে করেন ডাকাতি। তাতে সরাসরি অংশ নেয় ওই কিশোর। বরগুনার পাথরঘাটার বঙ্গোপসাগরের বয়া এলাকায় দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনায় চট্টগ্রামের বাঁশখালী থেকে পিতা-পুত্রসহ নৌদস্যু দলের চারজনকে গ্রেফতারের পর এমন তথ্য জানিয়েছেন র্যাবের কর্মকর্তারা।
গত ১৭ ফেব্রুয়ারি পাথরঘাটায় একটি মাছ ধরার ট্রলারের পিছনে ধাক্কা দিয়ে ফাঁকা গুলি করে। তখন ট্রলারে থাকা জেলেরা চিৎকার করলে ডাকাতদল ট্রলারে উঠে সেখানে থাকা ১৮ জন জেলেকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে। তাদের আক্রমণ থেকে বাঁচতে ৯ জন জেলে সাগরে ঝাঁপ দেয়। চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর একজনের মৃত্যু হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন পাঁচজন। ওই ঘটনায় জেলেদের ট্রলারে থাকা মাছসহ ২০ লাখ টাকার মালামাল লুট করা হয়।
ভয়ঙ্কর ওই ডাকাতির পর জড়িতদের চিহ্নিত ও গ্রেফতারে অভিযানে নামে র্যাব। র্যাব-৭, র্যাব-৮, র্যাব-১৫ এবং র্যাব ফোর্সেস সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা যৌথভাবে তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যাপক গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় একটি বিশেষ সংবাদের মাধ্যমে র্যাব-৭, চট্টগ্রামের কর্মকর্তারা জানতে পারেন ফিশিং বোটে ডাকাতির সাথে সম্পর্কিত একটি ডাকাত দল চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী এলাকায় অবস্থান করছে।
এই তথ্যের ভিত্তিতে মঙ্গলবার রাতে বাঁশখালীর উপকূলীয় গণ্ডামারা, বড়ঘোনা, বাংলাবাজার, শীলকূপসহ আশপাশের এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। তারা হলেন, পশ্চিম বড়ঘোনার আলী আহম্মেদের ছেলে মো. কাইছার ওরফে কালু। পূর্ব বড়ঘোনার মৃত আহম্মেদ সাফার ছেলে মো. জাহিদ। পশ্চিম বড়ঘোনার মৃত আলী চানের ছেলে মো. সেলিম ও তার কিশোর ছেলে মো. ইকবাল হোসেন।
অভিযানে কাইছার ওরফে কালুর কাছে বরগুনার বোট থেকে ডাকাতি করা একটি মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। র্যাব কর্মকর্তারা জানান, পরবর্তীতে উক্ত মোবাইল ফোনটি তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এতে নিশ্চিত হওয়া যায় মোবাইলটি আহত জেলে আব্দুল করিমের। পরে ডাকাতির ঘটনায় ব্যবহৃত ফিশিং বোটটি উদ্ধার করা হয়। চার দস্যুকে গ্রেফতারের পর র্যাবের পক্ষ থেকে গতকাল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দস্যুদলের বিষয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য জানান র্যাব কর্মকর্তারা।
র্যাব কর্মকর্তারা জানান, বরগুনায় ডাকাতির সময় কালু এবং জাহিদ সরাসরি বোটে উপস্থিত থেকে অংশগ্রহণ করে। গ্রেফতার সেলিম ডাকাত ওরফে সেলিম ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত বোটের মালিক। তিনি ওই ঘটনায় সরাসরি বোটে ছিলেন না। তবে তার পুত্র ইকবাল বোটে থেকে ডাকাতিতে অংশ নেয়। বোটে থাকা অস্ত্রসমূহ, বোট পাহারা ও রক্ষণাবেক্ষণের মূল দায়িত্ব পালন করে সে।
মো. কাইছার ওরফে কালু এবং মো. জাহিদ ডকাতিতে ব্যবহৃত বোটের সহকারী হিসেবে ডাকাতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করেন। তারা দু’জন ধারালো অস্ত্র দিয়ে জেলেদেরকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করেছিলেন। অপরদিকে গ্রেফতার জাহিদ ওরফে ডাকাত জাহিদ ডাকাতির সাথে সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। জাহিদ ইতোপূর্বে অন্যান্য বোটে ডাকাতি করেছেন বলেও জানান।
র্যাব জানায়, যিনি ডাকাত দলের বোটের মালিক তিনিই দলের প্রধান। তার বোট ব্যবহার করেই ডাকাতি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে এই ডাকাত দলের নেতৃত্বদানকারী এবং ডাকাতির মূল পরিকল্পনাকারীসহ জড়িত ডাকাতদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। মূল পরিকল্পনাকারী বিভিন্ন এলাকা থেকে জনবল, সংগ্রহ করা, কিভাবে ডাকাতি করবে, কোথা হতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ আসবে এবং ডাকাতির মালামাল কোথায় বিক্রি করা হবে এ সকল বিষয় সে নিয়ন্ত্রণ করেন। এই দলে সর্বমোট ১৮ থেকে ২০ জন ছিল।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, গত ১০ ফেব্রুয়ারি ডাকাতির উদ্দেশে বাঁশখালী থেকে বোট নিয়ে সমুদ্রে যায়। কক্সবাজারের কুতুবদিয়া চ্যানেল এলাকায় একটি ডাকাতি করে। সেখান থেকে ডাকাতির মালামাল নিয়ে ফের ডাকাতির উদ্দেশ্যে সাগরের বরগুনা-পটুয়াখালী চ্যানেলের দিকে যায়। সেখানে আরো দুটি বোটে ডাকাতি করে। বরগুনার ডাকাতি শেষে তারা ফিরে আসেন। অভিযানে চারটি দেশি আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ এবং ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সামগ্রি উদ্ধার করা হয়।
কাইছার ওরফে কালু জানায় গত এক মাসে বেশ কয়েকটি ডাকাতি করেছে। এছাড়া আগের অনেক ডাকাতির সাথে তারা সম্পৃক্ত ছিল। ডাকাতি শেষে কক্সবাজারের নুনিয়াছড়া, খুরুশখুল, ফিশারীঘাটে ডাকাতির মালামাল আড়তদারদের কাছে বিক্রি করত। আগে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, কক্সবাজারের পেকুয়া, মগনামা, এবং কুতুবদিয়া এলাকার উপকূলীয় অঞ্চলে ডাকাতি করত তারা। এসব এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অধিক তৎপরতার কারণে বর্তমানে বরিশাল, বরগুনা এবং খুলনা উপকূলীয় অঞ্চলে অবস্থান করে ডাকাতি কার্যক্রম শুরু করেছে। তারা পাথরঘাটায় ১৮ জন জেলেকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম, ৯ জন জেলেকে সাগরে নিক্ষেপ করে প্রায় ২০ লাখ টাকার রসদ ও সামগ্রী লুটপাট করার কথাও স্বীকার করে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে বাঁশখালী থানায় একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানায় র্যাব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন