ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতুতে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় টোকেন বাণিজ্যের নামে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’ লেখা এই স্টিকারের আড়ালে প্রতি সিএনজি অটোরিকশা থেকে মাসে ২ হাজার টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। অটোরিকশা চোর, স্থানীয় মাস্তান, আওয়ামী লীগ নামধারী চিহ্নিত কিছু চাঁদাবাজ প্রকাশ্যে থাকলেও অন্তরালে রয়েছে বিদেশে অবস্থানরত একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে গড়ে ওঠা সংঘবদ্ধচক্র সিএনজি অটোরিকশা থেকে মাসে অর্ধকোটি টাকারও বেশি চাঁদা আদায় করছে।
ডিএমপি অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগের বিষয়টি আমাদেরও নলেজে এসেছে। অনৈতিক কর্মকাণ্ডে পুলিশের কোনো সদস্য জড়িত থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এছাড়া নম্বরবিহীন কিংবা অবৈধ অটোরিকশাগুলোকে আমরা ডাম্পিংয়ে পাঠাই। পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, কেরানিগঞ্জের ইকুরিয়া অংশে কোনো সিএনজি স্টেশন নেই। পাম্পের অযুহাত দেখিয়ে তারা এপারে আসে। ওইসব সিএনজি অটোরিকশা ঢাকার অংশে প্রবেশ করার সুযোগটা কাজে লাগায় সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট।
এদিকে সরেজমিন ঘুরে এবং ভুক্তভোগী সিএনজি অটোরিকশা চালকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’ এই স্টিকার ছাড়া কোনো সিএনজি অটোরিকশা বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতুতে উঠতে পারে না। গতকাল রোববার জুরাইন পোস্তগোলার বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতু হয়ে ওপারের হাসনাবাদ ও ইকুরিয়া রোডে চলাচলরত অন্ততঃ ৩০ জন অটোরিকশাচালকের সাথে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তারা জানান, ওই স্টিকার দিয়ে প্রতিমাসে সিএনজি প্রতি ২ হাজার টাকা করে চাঁদা নেয়া হয়। যাদের অটোরিকশার কোনো নম্বর নেই, তাদের কাছ থেকে নেয়া হয় আড়াই হাজার টাকা করে। ওই স্টিকার সম্বলিত অটোরিকশাগুলো শুধু জুরাইন পোস্তগোলার বুড়িগঙ্গা প্রথম সেতু হয়ে ওপারের হাসনাবাদ ও ইকুরিয়া পর্যন্ত চলাচল করার অনুমতি রয়েছে। ঢাকার ভেতরে এদের চলাচলে কোনো সুযোগ নেই।
চালকরা জানিয়েছেন, কম করে হলেও তিন হাজার অটোরিকশা চলাচল করে প্রথম বুড়িগঙ্গা সেতু সড়কে। তারা বলেন, গত বছরের ২৬ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ার পর বুড়িগঙ্গা সেতুর টোল বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় সেতুর ইজারাদার ছিলেন আলম ওরফে দিগম্বর আলম। টোল বন্ধ হওয়ার আগেই আলমের লোকজন আক্তারকে দায়িত্ব দেয় মালিকপক্ষের সাথে আলাপ করার জন্য। আক্তার মালিকপক্ষকে হুমকি-ধমকি দিয়ে বোঝাতে সক্ষম হয় যে, চাঁদা না দিলে মহাসড়কে সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করতে দেয়া হবে না। আক্তার ও আলমের সাথে আরও রয়েছে বাবু নামে একজন। তাদের নেতা আবার কথিত পরিবহণ ব্যবসায়ী রাজু। আর সবার গডফাদার বিদেশে পালিয়ে থাকা এক শীর্ষ সন্ত্রাসী। তাদের ভয়ে মালিকরা চাঁদা দিতে বাধ্য হয়। চাঁদাবাজ রাজুর দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও পুলিশকে ম্যানেজ করা।
মাসের প্রথম সপ্তাহেই অগ্রিম টাকা দিয়ে স্টিকার সংগ্রহ করতে হয় বলে জানিয়েছেন, অটোরিকশার চালক এমদাদ, ইউসুফ, শরিফ, টিটু, নাসির ও সুজনসহ অনেকেই। তারা বলেন, সরকারি রাস্তায় এভাবে অবৈধভাবে চাঁদা তুলছে। আমাদের কিছুই করার নেই। কারণ স্টিকার না নিলেই অটোরিকশাচালককে মারধর করে রাজু ও আক্তারের লোকজন। সুলেমান নামে এক চালকের অটোরিকশায় করে ব্রিজের উপর দিয়ে ইকুরিয়া হয়ে আবার শ্যামপুর থানার সামনে আসেন এ প্রতিবেদক। তখন ওই চালকই সব দেখালেন তার অটোরিকশায় চাপিয়ে। ব্রিজের নিচে শ্যামপুর অংশে রয়েছে একটি অফিস। যেখানে বসেন আওয়ামী লীগের নেতারা। পাশেই অন্য অফিসে বসে এসব অটোরিকশার স্টিকার চাঁদার রশিদ সরবরাহ করা হয়। ওই অফিসে সাধারণের প্রবেশ করাও নিষেধ। আক্তার ও দিগম্বর আলমের নাম জানে সেখানের সবাই। অটোরিকশার চালকদের কাছে আক্তার ও আলম নাম দু’টি আতঙ্কের। আক্তার খুবই খারাপ একজন মানুষ। তার কথা না শুনলে সিএনজি চুরির আশঙ্কার কথা বলেন তারা। আরেক চালক রফিকুল বলেন, মাসের অগ্রিম টাকাটা দিলেই নিরাপদ। নিরাপত্তার জন্যই আমরা চাঁদা দিচ্ছি। সিএনজি চুরির দায়ে আক্তারের বিরুদ্ধে বহু মামলা হয়েছে।
তবে এসব বিষয় অস্বীকার করে আক্তার গত শনিবার সন্ধ্যায় ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশে এখন কোথাও কোনো সিএনজি অটোরিকশা চোর নেই। আমি ওপেন চলি। ত্রিশ বছর ধরে পরিবহণের সাথে জড়িত। মালিক সমিতির লোক হিসেবে অনেক কিছু করতে পারি। কিন্তু করি না। বয়স হয়েছে ৬০ বছর।
জানতে চাইলে অভিযুক্ত রাজু বলেন, আমি প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস কেনাবেচা করি। এক সময় সিএনজি অটোরিকশার ব্যবসা করতাম। প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে কেউ আমার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির গুজব ছড়াচ্ছে। আমার মতো ছোট মানুষ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ম্যানেজের ক্ষমতা রাখি না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন