আর কিছুক্ষণ পরেই পর্দা নামবে মেলার দুয়ারে। বাজবে ছুটির ঘন্টা। তখনও মেলায় ঢুকছেন বইপ্রেমীরা। পাশের গেটে ঘরে ফেরার ব্যস্ততা। হাতে হাতে বইয়ের থলে। আবার ভিতরের দৃশ্য ছিল যেন আর কিছুক্ষণ থেকে যাওয়া, আরো কিছু বই কিনা, নতুন কী বই আর আসলো বলে নানা জল্পনা কল্পনা। শেষ সন্ধ্যায়ও বাতাসে দোল খাচ্ছিল নতুন বইয়ের ঘ্রাণ।
দোয়েল চত্বর থেকে টিএসসি মোড় পর্যন্ত মানুষের কলরব সন্ধ্যা পেরিয়ে আরও কিছুক্ষণ। দুই প্রাঙ্গণে ছিল তারার মেলা। দিকে দিকে লেখকদের ঘিরে পাঠকের আনন্দ ভাগাভাগির অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্যপট। ভেতরে-বাইরে এমন টুকরো টুকরো ছবি এঁকেই গতকাল মঙ্গলবার বিদায় নিল অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ইতোমধ্যে মেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ব্যবস্থাপনা, অব্যবস্থাপনা ও লাভ লোকসানের নানা হিসেব কষতে বসেছে পাঠক- প্রকাশকরা। কারো মাঝে আছে স্বস্তি, কারো আছে অভিযোগের ফিরিস্তি।
গতকাল মেলায় কথা হলে পার্লস পাবলিকেশন্সের প্রকাশক হাসান জাইদি বলেন, মেলায় বোমা হামলার হুমকির ব্যাপক প্রভাব পড়েছে মেলায়। গত বছর যেখানে মেলার শেষ ছুটির দিনে আমরা ১০ লাখ টাকার বই বিক্রি করেছিলাম সেখানে এ বছর শেষ ছুটির দিন মাত্র ২ লাখের মতো বিক্রি হয়েছে। এছাড়া এবার স্বাভাবিক সময়ে মেলা অনুষ্ঠিত হলেও কাগজের অস্বাভাবিক মূল্যের কারণে একটা বড় সংখ্যক পাঠক মেলায় এসে বই না কিনে ফিরে গিয়েছে।
তবে কাকলী প্রকাশনীর প্রকাশক এ কে নাছির আহমেদ সেলিমের সুরে শোনা যায় ভিন্ন আওয়াজ। তিনি বলেন, মেলায় বোমা হামলার হুমকির কোনো প্রভাব পড়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে না। দেখেন, কত কত মানুষ আজও মেলায় এসেছে। সবার হাতে হাতে বই। তবে মেলার মাঠে ইট না বসানোয় খানিকটা অভিযোগ করে তিনি বলেন, টাকা গত বছর যেমন দিয়েছি এবার তেমনই দিতে হয়েছে। সুতরাং গতবছরের ন্যায় এবারও মেলা প্রাঙ্গনে ইট বসানো উচিত ছিল।
একই সুরে কথা বলেন, চারুলিপি প্রকাশনীর ম্যানেজার ফারভেজ। তিনি বলেন, মেলায় শেষের দিকে ভীড় ছিল অনেক বেশি। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় তো অনেক ভালো বিক্রি হয়েছে। কিন্তু এবার পাঠকের চেয়ে দর্শনার্থীর সংখ্যাটা অনেক বেশি ছিল।
তাম্রলিপি প্রকাশনীর বিক্রয়কর্মীরা গতকাল মেলার শেষদিনে ক্রেতাদের হাতে বই তুলে দিতেই ব্যস্ত সময় পার করেছেন। প্রকাশনীর ম্যানেজার জানান, এ বছর গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি বিক্রি হয়েছে। অন্যান্য প্রকাশকদের মন্তব্য অনুযায়ীও এবছর এই প্রকাশনী সর্বোচ্চ লাভ করে।
এদিকে গতকাল মেলায় ধুলাবালির দৌরাত্মও ছিল চোখে পড়ার মতো। হাজারো বইপ্রেমীদের পদচারণায় মুখরিত মেলা প্রাঙ্গনে এদিন যারা মাস্ক নিয়ে যায়নি তাদের ছিল বেহাল দশা। মেলার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠকদের জন্য এই বিষয়টি ছিল বড় একটি অভিযোগের বিষয়। মেলায় আগত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজমুল জানান, মেলায় প্রথমদিকে তেমন একটা ধুলোবালি ছিল না। কিন্তু যতই দিন যেতে থাকে ততই এটার পরিমাণ বাড়তে থাকে। সেই সাথে বাড়তে থাকে জন দুর্ভোগ।
বাংলা একাডেমির তথ্য মতে এবার মেলায় মোট নতুন বই এসেছে ৩৭৩০টি। গতকাল বিকেল ৫টায় বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা ভাষণ প্রদান করেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ‹অমর একুশে বইমেলা ২০২৩›-এর সদস্য-সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন বাংলা একাডেমির সচিব বাংলা একাডেমির সচিব এ. এইচ. এম. লোকমান। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, কোভিড মহামারি পরবর্তীকালে একমাসব্যাপী অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ আয়োজন সত্যিই আমাদের জন্য বড়ো একটি সফলতা। বিন্যাস ও আঙ্গিকগত দিক দিয়ে এবারের বইমেলা সবার কাছে প্রশংসিত হয়েছে।
ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, অমর একুশে বইমেলা ২০২৩-এ বাংলা একাডেমি-সহ সকল প্রতিষ্ঠানের বই ২৫ শতাংশ কমিশনে বিক্রি হয়েছে। ২৭শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলা একাডেমির ১ কোটি ২৪ লাখ টাকার বই বিক্রি করেছে। ২৬শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্টল মালিকদের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য এবং আজকের সম্ভাব্য বিক্রি যুক্ত করলে বলা যায় যে প্রায় ৪৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে।
কে এম খালিদ এমপি বলেন, আনন্দ-উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে উদযাপিত এবারের বইমেলা সমাপ্তির দ্বারপ্রান্তে। বইমেলা কেবল বই বিক্রির জায়গা নয় । দল, মত, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রাণের মেলা অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় সাফল্যমণ্ডিত হয়েছে।
কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনে বড়ো একটি দিগন্ত। বই পাঠের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে মানবিক দর্শন জাগত হবে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।
অনুষ্ঠানে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২, কবি জসীমউদদীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ এবং অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানে ক্যারোলিন রাইট এবং জসিম মল্লিককে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২ এবং কবি মোহাম্মদ রফিক-কে কবি জসীমউদ্দীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন