শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

চিরিরবন্দরের তুলার পুতুল যাচ্ছে ইউরোপের ১২ দেশে

মাহফুজুল হক আনার দিনাজপুর থেকে | প্রকাশের সময় : ১ মার্চ, ২০২৩, ১২:০০ এএম

ঝর্ণা, মনিকা পুষ্প লিপাসহ হাজারো নারী সাংসারিক কাজের ফাঁকে তুলা-সুতা দিয়ে তৈরি করছে বিভিন্ন ডিজাইনের পুতুল। তাদের তৈরি পুতুল রফতানি হচ্ছে আমেরিকাসহ ইউরোপের প্রায় ১২টি দেশে। পুতুল তৈরির কারিগরদের কারণে পুরো গ্রামটিই পরিচিতি লাভ করেছে ‘পুতুুলগ্রাম’ হিসাবে। দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে চিরিরবন্দর উপজেলার আবদুলপুর গ্রামে গিয়ে জানা যায় গ্রামের মানুষের জীবন পাল্টে দেয়ার কাহিনী।
২০১২ সালের কথা। এবি ক্রুসেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান পুতুল তৈরির কাজ শুরু করেন ঢাকা, গাজীপুরসহ শিল্পসমৃদ্ধ এলাকায়। তারা দেখলেন শ্রমের মজুরি শহরের তুলনায় গ্রামের মজুরি অনেক কম। কম মজুরিতে ভাল কাজের লক্ষ্য তারা পৌঁছে গেলেন চিরিরবন্দর উপজেলার আবদুলপুর গ্রামে। প্রাথমিক পর্যায়ে কয়েকজন নারীকে পুতুল তৈরির প্রশিক্ষণ দেন। ঝর্ণা রানী রায় ও মনিকা রানী দাস প্রাথমিকভাবে ধারণা নিয়ে অভিভাবকদের সম্মতিতে ঢাকায় গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামে ফেরেন। গ্রামের সামাজিক অবস্থানকে ঠিক রেখে সংসারের কাজের ফাঁকে শুরু করেন পুতুল তৈরি। বাসায় পুতুল তৈরি করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করে পারিশ্রমিক পেতে শুরু করেন। পুতুলের প্রকারভেদে পারিশ্রমিক তাদের সংসারে অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠতে বড় ভূমিকা পালন শুরু করে। ঝর্না ও মনিকার সংসারে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য দেখে অন্যান্য নারী এমনকি পুরুষেরাও আগ্রহী হয়ে উঠেন। এই পরিধি বাড়তে বেশিদিন লাগেনি। নারীদের সুনিপুণ হাতে গড়া পুতুল দেশীয় বাজার ছেড়ে মুখ দেখে আন্তর্জাতিক বাজারের। উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান এবি ক্রুসেড দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের নারীদের তৈরি পুতুল রফতানি শুরু করে আমেরিকাসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে।
এবি ক্রুসেডের কর্ণধার মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি এড়িয়ে যান। প্রতিষ্ঠানের অন্য একজন কর্মকর্তা জানান, কারখানায় তৈরি পুতুলের ডিজাইন দিয়ে দেয়া হয় কারিগরদের। তারা প্রয়োজনীয় তুলা, সুতা ও আনুষাঙ্গিক মালামাল নিয়ে চলে যান নিজ বাড়িতে। সাংসারিক কাজের ফাঁকে মা-বাবা স্বামী সন্তানদের নিয়ে কাজ করে থাকেন। আবার অনেকেই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত অফিসে দলগতভাবে কাজ করে থাকেন।
অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত এবং সময়ের ব্যবধানে অনেক শিক্ষিত মেয়ে ও নারী আধুনিক মানের পুতুল তৈরি করছেন। স্পেসম্যান, অক্টোপাস, ডাইনোসর, ব্যাঙের ছাতা, টেডি বেয়ার, ঝিনুক, জলপরি, কুকুর ছানা, পাউরয়েট, স্টারফিস, ড্রাগনফ্লাই, বাটারফ্লাই, হটচকলেট, কচ্ছপ, ডাংকি, শেয়াল ব্রকলি, ল্যাংড়াসহ আরো অনেক পুতুল তৈরি করছে।
আব্দুলপাড়া তথা পুতুল গ্রামে প্রতিটি বাড়ির উঠোনের পুতুল সামগ্রী। আলাপ হলো লিপা রায় এর সাথে। সে জানালো প্রতিবেশি মনিকার কাছ থেকে কাজ শেখার কথা। প্রতিদিন গড়ে ৫টি পুতুল তৈরির টাকায় সংসারের খরচ যোগানো খুব সহজ। তার ভাষায় সংসারের টাকা খরচের পাশাপাশি দুইটা ছাগল নিয়ে লালন পালন করে এখন ৬টা ছাগল হয়েছে। এভাবেই বাড়ছে আয়ের পরিধি। প্রতিষ্ঠানে দলবেধে কাজ করার মাধ্যমে মাসে ১৫ থেকে ১৬শ টাকা আয় হয়ে থাকে। টাকার অংকটা কম মনে হলেও গ্রামে ক্ষেত্রে আর বাড়ির কাজের অবসরে এই টাকা অনেকের জন্য বেশ সহায়ক।
কারিগর থেকে প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার পদে চাকুরি পাওয়া ঝর্ণা রানী তার জীবনের গল্পে বলেন, টাকার অভাবে অনেক সময় অর্ধাহারে দিন পার করতে হতো। পুতুল তৈরির কাজ শুরুর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কারিগরের পাশাপাশি এখন সুপারভাইজারের দায়িত্ব পালন করছি। প্রতিষ্ঠানের কাজ শেষে বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের নিয়ে পুতুুলও তৈরি করছি। হোষ্টেলে রেখে দুই ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছি। জমি কিনে পাকা বাড়ি করেছি। অদূর ভবিষ্যতে আমরাও বিদেশের মাটিতে পা রাখার স্বপ্ন দেখছি। কথা বলতে না পারা পুতুলই হয়তো আমাদের মত সমাজে অবহেলিত নারীদের বিদেশের মাটিতে কথা বলার সুযোগ করে দিবে।
একই কথা অপর সুপারভাইজার ললিতা রানীর কন্ঠে। তার মতে বর্তমানে প্রকারভেদে ৮০ থেকে ১৫০ টাকা মজুরি দেয়া হচ্ছে একেকটি পুতুলে। তার আশা, কর্তৃপক্ষ এই মজুরির পরিমাণ বৃদ্ধি করে আরো বেশি উৎসাহিত করবেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন