এক মাসের মধ্যে আবারও বাড়ানো হচ্ছে বিদ্যুতের দাম। সরকারের নির্বাহী আদেশে গতকাল মঙ্গলবার রাতেই বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এবার ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হলো। মার্চ মাসের বিল থেকেই নতুন এ দাম কার্যকর করা হবে বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব হাবিবুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, মঙ্গলবার রাতেই প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। আপনারা অপেক্ষা করেন জানতে পারবেন এবং আমরা সকল মিডিয়াকে জানিয়ে দিব।
এর আগে গত জানুয়ারিতে দুই দফায় বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। এটি জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে দুই ভাগে কার্যকর হয়েছে। সর্বশেষ ৩০ জানুয়ারির প্রজ্ঞাপনে খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ও পাইকারি পর্যায়ে ৮ শতাংশ বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির চাপ সামলাতে এ বছর প্রতি মাসে বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করছে সরকার। আজ বাড়ানো হলে গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১২ বার ও খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হবে বিদ্যুতের দাম।
আগে গণশুনানির মাধ্যমে বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করতো এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা হাতে নিয়েছে সরকার। এর পর থেকে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়াচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। দেশের সরকারি-বেসরকারি সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চুক্তি অনুসারে নির্ধারিত দামে বিদ্যুৎ কিনে নেয় পিডিবি। এরপর তারা উৎপাদন খরচের চেয়ে কিছুটা কম দামে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার কাছে বিক্রি করে। ঘাটতি মেটাতে পিডিবি সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেয়। তবে বিতরণ সংস্থাগুলো কোনো ভর্তুকি পায় না। তারা নিয়মিত মুনাফা করছে। গত অর্থবছরেও মুনাফা করেছে বিতরণ সংস্থাগুলো।
নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি, মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির কারণে সাধারণ নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত। তার ওপর বিদ্যুৎ গ্যাসের উপুর্যপুরি দামবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ করে তুলছে।এর মধ্যে মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে গরিবের ঘাড়ে সব চাইতে বেশি বিদ্যুতের দাম চাপানো হয়েছে। সরকার সামাজিক সুরক্ষার অংশ হিসেবে ৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহারকারীকে লাইফলাইন বা প্রান্তিক ব্যবহারকারী হিসেবে বিবেচনা করে। সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে এই বিদ্যুতের দামে খুব বেশি কাট-ছাঁট করা না হলেও এবার দুই ধাপে সেখানে প্রায় ১১ ভাগ দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এর আগে গতমাসে মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আবাসিক গ্রাহকদের মধ্যে শূন্য থেকে ৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী লাইফলাইন গ্রাহকদের বিদ্যুতের দাম ইউনিটপ্রতি ৩ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে ১৯ দিনের ব্যবধানে দুই দফা বাড়িয়ে ৪ টাকা ১৪ পয়সা করা হয়েছে। এতে গরিবের এই বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির শতকরা হার দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৪ ভাগ। দেশে এক কোটি ৬৩ লাখ এমন গ্রাহক রয়েছেন। অন্যদিকে শূন্য থেকে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর বিদ্যুতের দাম ৪ টাকা ৪০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৪ টাকা ৬২ পয়সা, ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৩১ পয়সা, ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট ব্যবহারকারীদের ৬ টাকা ৩০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৬২ পয়সা, ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিটের জন্য ৬ টাকা ৬৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ৯৯ পয়সা, ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিটের জন্য ১০ টাকা ৪৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা ৯৬ পয়সা এবং ৬০০ ইউনিটের ওপরে বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের বিদ্যুৎ বিল ১২ টাকা ০৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১২ টাকা ৬৩ পয়সা করা হয়েছে। অন্য গ্রাহক শ্রেণির ওপর বৃদ্ধির হার ৫ ভাগের মধ্যে রয়েছে। এর আগে গত নভেম্বরে পাইকারি পর্যায়ে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এটি ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। এরপর ডিসেম্বর থেকেই খুচরা দাম বাড়াতে বিইআরসির কাছে আবেদন করে ছয়টি বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা। ৮ জানুয়ারি এসব আবেদন নিয়ে শুনানি করে বিইআরসি। ১৫ জানুয়ারির মধ্যে শুনানি-পরবর্তী মতামত জানাতে বলা হয়। এরপর নতুন দাম ঘোষণা করার কথা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির। তার আগেই সরকারের নির্বাহী আদেশে দাম বাড়ানো হলো। আজ থেকে এ দাম কার্যকর হবে।
পাইকারি বিদ্যুতের দাম : নির্বাহী আদেশে জারি করা প্রজ্ঞাপনে পাইকারিতে বিভিন্ন ভোল্টেজ লেভেলে ৬ দশমিক ৫৭ থেকে ৭ দশমিক ৩৬ ভাগ দাম বাড়ানো হয়েছে। সব শেষ বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ২১ নভেম্বর ১৯ ভাগ পাইকারি বিদ্যুতের দামবৃদ্ধি করে। ২৩০ কেভির দাম: ২৩০ কেভি ভোল্টেজ লেভেলে ৭ দশমিক ৬০৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এখন প্রতি ইউনিটে সেই দাম ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ৮ দশমিক ১০৪০ টাকা করা হয়েছে। এতে দাম বেড়েছে ৬ দশমিক ৫৭ ভাগ। ১৩২ কেভির দাম: ১৩২ কেভিতেও দাম বেড়েছে প্রতি ইউনিটে ৫০ পয়সা। আগে ১৩২ কেভির গ্রাহকের প্রতি ইউনিটের দাম ছিল ৭ দশমিক ৬৩৩৫ টাকা। এখন যা বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ১৩৩৫ টাকা। শতকরা বৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৫৫ ভাগ। ৩৩ কেভির দাম: ৩৩ কেভির বিদ্যুতের দাম আগে ছিল ৬ দশমিক ৭৮৯৫ টাকা। এখন যা বেড়ে হলো ৭ দশমিক ২৮৯৫ টাকা। এ ধাপেও ৫০ পয়সা দাম বাড়ানো হয়েছে। এখানে শতকরা বৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৩৬ ভাগ।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম ঘনমিটার প্রতি ৫ টাকা দুই পয়সা। আগামী মাসে তা বেড়ে দাঁড়াবে ১৪ টাকা। প্রতি ঘনমিটারে দাম বাড়ছে ৯ টাকা। এই দাম বাড়ার কারণে মাসে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে বর্তমানের চাইতে ৮০০ কোটি টাকার বেশি। পিডিবির হিসেবে, ফেব্রুয়ারি মাস থেকে আগামী বছরের ২০২৪ সাল জুন পর্যন্ত ১৭ মাসে মোট উৎপাদন ব্যয় প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা বাড়বে। পিডিবির ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে গ্যাসে মোট বিদ্যুতের ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ উৎপাদন হয়। আগামী মাসের শুরুতে নতুন দাম কার্যকরের পর গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের গড় ব্যয় দাঁড়াবে ১০ টাকা ৯২ পয়সা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন