চট্টগ্রামে আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং। প্রথমে আড্ডা থেকে পরিচয়। এরপর সংঘবদ্ধ হয়ে গ্রুপ গঠন। অতঃপর অপরাধে জড়িয়ে পড়া। আর বড় ভাইদের শেল্টার বা আশ্রয়ে ভয়ানক হয়ে উঠে তারা। বেপরোয়া কিশোর গ্যাং সম্পর্কে এমন তথ্য জানিয়েছেন র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম মহানগরী এবং জেলায় হঠাৎ করে কিশোর গ্যাং তথা সংঘবদ্ধ উঠতি বয়সী অপরাধীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় নড়েচড়ে বসেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর কর্মকর্তারা। ইতোমধ্যে এসব চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর নজরদারি শুরু করেছে এলিট বাহিনী র্যাব। গত মঙ্গলবার ডট গ্যাং নামে একটি চক্রের সাত সদস্যকে পাকড়াও করা হয়েছে। আরো অন্তত ৫০টি কিশোর গ্যাংয়ের তথ্য র্যাবের হাতে রয়েছে জানিয়ে র্যাব কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের বিরুদ্ধে খুব শিগগির সাঁড়াশি অভিযান শুরু হবে। পুলিশও কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টানতে মাঠে নেমেছে।
চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন থেকে কিশোর অপরাধীদের দৌরাত্ম্য চলছে। পাড়া-মহল্লায় মারামারি, হাঙ্গামা, খুন খারাবি, ছিনতাই, ডাকাতি, দস্যুতা, ইভ-টিজিং, ধর্ষণ, মাদক সেবন, মাদক ব্যবসা, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার থেকে শুরু করে হরেক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোর ও উঠতি বয়সের তরুণেরা। রাজনৈতিক দলের কতিপয় নেতা, ক্যাডার, মাস্তান, কথিত কিছু জনপ্রতিনিধির প্রত্যক্ষ মদদে এরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। বিশেষ করে সরকারি দলের কিছু নেতা ও তাদের অঙ্গ এবং সগযোগী সংগঠনের বিতর্কিত সেই সাথে জনবিচ্ছিন্ন নেতারা এসব কোমলমতি কিশোরদের বিপদগামী করছে। দরিদ্র ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের পাশাপাশি অভিজাত ও ধনাঢ্য পরিবারের বখে যাওয়া কিশোররাও গ্যাং কালচারে জড়িয়ে পড়ছে।
মহানগরীর ১৬টি থানা এলাকায় বিভিন্ন নামে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশতাধিক কিশোর গ্যাং। যারা জড়িয়ে পড়েছে দখলবাজি, চাঁদাবাজিসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডে। তারা সেবন করছে ইয়াবা, ফেন্সিডিলসহ নানা মাদকদ্রব্য। আধিপত্য বিস্তারে ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধ অস্ত্রও। গত এক দশকে মহানগরীর জামালখান এলাকায়ও একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের উত্থান ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে মহানগরীতে বিভিন্ন ছত্রছায়ায় এসব গ্রুপের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ তথা রিকশা-সিএনজি অটোরিকশা চালক, ফুটপাতের হকার, ক্ষুদে ব্যবসায়ী এবং স্কুলছাত্র-ছাত্রীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। কিশোর গ্যাংয়ের বিরোধে নগরীতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ অসংখ্য খুনের ঘটনাও ঘটেছে গত কয়েক বছরে। সর্বশেষ নগরীর চেরাগী পাহাড়ে খুন হয় বিএএফ শাহীন কলেজ চট্টগ্রামের এক শিক্ষার্থী। ওই ঘটনায় গ্রেফতার হয় কিশোর গ্যাংয়ের আট সদস্য।
র্যাব কর্মকর্তারা জানায়, কিশোর গ্যাংয়ের লাগাম টানতে গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করেছে তারা। এর মধ্যে অন্তত অর্ধশত কিশোর গ্যাংয়ের তথ্য এখন র্যাবের হাতে। তাদের গডফাদার তথা মদদদাতাদের তালিকাও করেছে র্যাব। এ ধারাবাহিকতায় নগরীর তিনটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছয় ছাত্রসহ সাতজনকে মঙ্গলবার গ্রেফতার করা হয়। চকবাজার বালি আর্কেডের সামনে থেকে গ্রেফতার ওই সাতজন হলো- গ্যাং লিডার মিম, তার সহযোগী সামিউল ইসলাম (১৬), আহনাফ শাহরিয়ার (১৬), মো. শরিফুল ইসলাম (১৬), শানিপ শাহীদ (১৬), মাশহাদ সিদ্দিকী (১৬) ও আবু তারেক (১৬)।
ডট গ্যাং বা ডট সুপ্রিমেসি নামে এ গ্যাংটির দৌরাত্ম্য নগরীর জামালখান, সিরাজউদ্দৌলা রোড ও চকবাজার এলাকায়। এসব এলাকায় বিভিন্ন আড্ডায় যোগ দিয়ে তারা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এরপর নিজেরাই ‘ডট গ্যাং’ নামে একটি কিশোর গ্যাং গড়ে তোলে। ভিডিওচিত্রে ফেসবুকে প্রকাশ্যে অপরাধ কর্মকাণ্ডের বিবরণ শেয়ার করে নিজের বীরত্ব প্রকাশ করে তাদের গ্যাং লিডার। ছাত্রলীগ নেতা নামধারী কয়েকজন বড় ভাই এই কিশোর অপরাধী চক্রের মূল মদদদাতা বলে জানা গেছে।
র্যাব সূত্রে জানা গেছে, ডট গ্যাংকে ফেসবুকে নজরদারির মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়েছে। এই চক্রটি মূলত দেড় বছর আগে সৃষ্টি হয়েছে। এর আগে তারা ছুরি আকিবের গ্রুপ নামে একটি চক্রের সঙ্গে ছিল। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বের জেরে ডট গ্যাং সৃষ্টি হয়। এ গ্যাংয়ে ৪০ জনেরও বেশি সদস্য থাকলেও সক্রিয় ৮-৯ জনকে চিহ্নিত করতে পেরেছে র্যাব, যাদের মারামারিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রমে প্রায়ই দেখা যায়। গত দেড় বছরে এই চক্রের সদস্যরা চকবাজার থেকে জামালখান পর্যন্ত এলাকায় ১২-১৪টি মারামারির ঘটনা ঘটিয়েছে। তাদের হাতে ছুরি, চাকু ও হকিস্টিক দেখা গেছে সিসি ক্যামেরার ফুটেজে। তারা মূলত চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ইভটিজিং, আধিপত্য বিস্তার এবং সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে মারামারি করে।
চকবাজারের একটি কোচিং সেন্টারের আড্ডা থেকে তারা সংঘবদ্ধ হয়। এরপর হিরোইজম দেখাতে গড়ে তোলে কিশোর গ্যাং। এ গ্যাংয়ের লিডার হোসাইনুল আমিন মিম। হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে যার নিয়ন্ত্রণও আবার লিডারের হাতে। স্থানীয়রা জানায়, ছাত্রলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত চকবাজার এলাকার মো. আকিব ওরফে ছুরি আকিব, তার ভাই ফাহিম মুন সুমন এবং জামালখান এলাকার তানজীরুল আলম ও জাহেদুল আলম কয়েকটি কিশোর গ্যাং পরিচালনা করে। ডট গ্যাং-ও তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে।
চকবাজার থেকে জামালখান পর্যন্ত চট্টগ্রাম কলেজ ও হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের আশপাশে বেশ কয়েকটি আড্ডাস্থল আছে। একেকটি আড্ডাস্থলের নিয়ন্ত্রণ একেকজন তরুণের হাতে। শাফায়েত ফাহিম, মাশফিকুল ইসলাম রাফি, অন্তু বড়ুয়া, সাদ্দাম হোসেন ইভান, রবিউল ইসলাম রাজুসহ আরও কয়েকজন এসব আড্ডার নিয়ন্ত্রক। র্যাবের হাতে গ্রেফতার ওই সাত কিশোর মূলত ঘুরেফিরে এসব আড্ডার সদস্য। এরা সবাই ছাত্রলীগের নেতাকর্মী হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেয়। ডট গ্যাং ছাড়াও চকবাজারে আরও অন্তত পাঁচটি গ্রুপ আছে।
এর আগে পুলিশের পক্ষ থেকে মহানগরীতে সক্রিয় কিশোর গ্যাং সদস্যদের একটি তালিকা করা হয়। সেখানে অর্ধশত কিশোর গ্যাংয়ের ৫৩৫ জন সদস্যের নাম উঠে আসে। আর তাদের আশ্রয়দাতা বড় ভাইয়ের সংখ্যা ৪৭ জন। এরা প্রায় সবাই সরকারি দল আওয়ামী লীগের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা। মহানগরীর ৩০০টি স্পট কিশোর গ্যাংয়ের আড্ডাস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এসব আড্ডাস্থলে কিছুদিন অভিযান পরিচালনা করা হলেও এরপর তা থেমে যায়। ফলে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বেড়েই চলেছে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, অভিভাবকদের অসচেতনতা, শিক্ষাব্যবস্থায় গলদ, নৈতিক অবক্ষয় এবং রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়নের ফলে এ ধরনের গ্যাং কালচার বেড়েই চলেছে। বিপথগামী কিশোরেরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধে। এদের আশ্রয়দাতা হিসেবে সরকারি দলের নেতাকর্মীদের সংশ্লিষ্টতা থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থাও নিতে পারছে না প্রশাসন। কোথাও কোন খুন খারাবি কিংবা বড় ধরনের অপরাধের ঘটনা ঘটলে পুলিশ নড়েচড়ে বসে। কিছুদিন অভিযান চলে, এরপর সবকিছু চলে আগের মত।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন