শুস্ক মৌসুমে ফরিদপুরে পদ্মা নদীতে নাব্যতা সঙ্কট দেখা দিয়েছে। ফলে ফরিদপুরে পদ্মায় নাব্যতা সঙ্কটে লোকসানে পণ্যবাহী নৌযান। ডুবচড়ে আটকা পড়ছে কার্গো ও জাহাজ। গতকাল বৃহস্পতিবার ফরিদপুর সিএন্ডবি ঘাট ও পদ্মাচড় এলাকায় গিয়ে জাহাজ কার্গো ডুবচড়ে আটকা পড়ার এই দৃশ্য দেখা যায়।
ডুবচড়ের কারণে পণ্যবাহী জাহাজ, কার্গো, বলগেটও বড় ট্রলার চলাচল ব্যাহত হচ্ছে আটকা পড়ছে চড়ে। দূরদুরান্ত হতে আসা এসব পণ্যবাহী জাহাজ নৌবন্দরে ভিড়তে না পারছে না। ফলে নৌবন্দরের শুঙ্ক আদায়ও কমে গেছে। অন্যদিকে, এসব নৌযান হতে পণ্য খালাস করতে অতিরিক্ত মাশুল গুনতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ পদ্মা নদীর পানি কমতে শুরু করে। তখন থেকেই এসব নৌযানগুলো নাব্যতা সঙ্কটের কবলে পড়ে সিএন্ডবি ঘাটের বন্দরে আসতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। বর্তমানে এই দুরাবস্থা চরমে পৌঁছেছে। নাব্যতা সঙ্কট রক্ষায় কমপক্ষে ১০ থেকে ১৫ স্থানে বিআইডব্লিউটি এর ড্রেজিং মেশিন বসিয়ে খনন কাজ করা খুবই জরুরি হয়ে পড়ছে। তবে খননের কাজ পরিকল্পিতভাবে করা না হলে, অল্পদিনের মধ্যেই নৌচ্যানেলগুলো নতুন বালু এসে ভরাট হয়ে যাবে বলে ঘাটের ছোট ও মাঝারি নৌযান মালিকরা মনে করেন।
দক্ষিণবঙ্গসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের ব্যবসায়ীক পণ্য আনা নেয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ নৌবন্দরটি শত বছরের প্রাচীন। ২০১৭ সালে সরকার এটিকে তৃতীয় শ্রেণির নৌবন্দর হিসেবে গেজেট প্রকাশ করে। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর এবং সিলেট, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লাসহ বিভিন্নস্থান হতে নৌপথে এই বন্দরে পণ্য আনা নেয়া করা হয়। ফরিদপুরের সোনালী আঁশ খ্যাত পাট এই বন্দর হয়েই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বহিঃবিশ্বে রফতানি হয়। এছাড়া সিলেট থেকে কয়লা চট্টগ্রাম থেকে সিমেন্ট, রাজশাহী হতে বালু, ভারতের গরু ও চালসহ চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া, মুন্সিগঞ্জ, কমলঘাট, মিরকাদিম থেকে এই নৌপথেই চাল আমদানি হয়।
নারায়ণগঞ্জ বন্দর থেকে প্রচুর সিমেন্টবাহী জাহাজ ও কার্গো এই বন্দর হতে খালাস করা হয়। কিন্তু বর্তমানে নদীতে নাব্যতা না থাকায় এবং অসংখ্য ডুবোচর সৃষ্টি হওয়ায় এসব পণ্যবাহী নৌযান বন্দরে আসতে পারছে না।
সরেজমিনে দেখা গেছে, নৌবন্দরে ভিড়তে না পেরে অনেক দুরে ডিক্রীচর, ভূঁইয়াবাড়ি ঘাট, খুশির বাজার, পিয়াজখালী ঘাট, হাজিগঞ্জের চরহাজীগঞ্জের এলাকা, চরন্দ্রাসনের এমপিডাঙী ও গোপালপুরসহ বিভিন্নস্থানে নদীর তীরে পণ্যবাহী জাহাজ, কার্গো বলগেট ও বড় ট্রলার নদীর তীরে ভিড়ানো রয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ মেঘনা ঘাট হতে আগত সিমেন্টবাহী জাহাজের মাস্টার মো. সাকিল সেখ বলেন, চড়ে এসে ঠেকে গেছি। আমার জাহাজে ১২ হাজার বস্তা সিমেন্ট আনছি। কিন্তু পর্যাপ্ত গভীরতা নেই বলে ৮ হাজার বস্তা সিমেন্ট আনতে হয়েছে। ৪ হাজার বস্তা সিমেন্ট কম আনতে হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ থেকে ফরিদপুর ঘাটে আসতে প্রায় দুই কিলোমিটার চরের অস্তিত্ব মিলছে। ৩ দিনের পথ আসতে ৫ দিন লেগে গেছে।
তিনি আরো বলেন, এতে আমাদের পণ্যের তাড়াও কমে গেছে। নৌবন্দরে ভিড়তে পারলে প্রতি বস্তা হতে ১৪ টাকা করে বাড়তি পেতাম। কিন্তু এখন এই তাড়ার অর্ধেক দিয়ে আরেকটি টিলার ভাড়া করে মাল খালাস করতে হচ্ছে। এসব কারণে তাদের স্টাফ খরচ এবং অন্যান্য ভাড়াও বেড়ে গেছে। এছাড়া জানমালের নিরাপত্তা নিয়েও তারা উদ্বিগ্ন। পথে পথে চাঁদাবাজদের হানা।
এমবি শতনীড় নামে আরেকটি জাহাজের মাস্টার মো. কামাল বলেন, নাব্যতা না থাকায়, জাহাজের ইঞ্জিনের পাখা ডুবো চড়ে ঠেকে যায়। চুকান আটকে যায়। এতে চালু অবস্থায় জাহাজের অনেক ক্ষতি হয়। তিনি বলেন, অন্তত গড়ে ১০ হাত গভীর পানি থাকা প্রয়োজন ছিলো, কিন্তু সেখানে কোথাও কোথাও দুই-তিন হাত পানি রয়েছে।
এখন জরুরি দরকার ড্রেজিং করা। পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং না করলে, পুনরায় পলি পড়ে আবার গভীর করা জায়গা ভরে যায়। পদ্মায় কোনো নাব্যতা আসছে না কেন? এর কারণ জানতে চাইলে সেখানে ড্রেজিংয়ের কাজে নিযুক্তরা (নাম প্রকাশে অনইচ্ছুক) তারা বলেন, ড্রেজিংয়ের পরপরই আবার নতুন পলি ও বালু এসে ভরে যায়। পানিতে প্রচুর পলি থাকায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
ফরিদপুর নৌবন্দরের পণ্য খালাসে নিযুক্ত প্রতিষ্ঠান টাইগার ট্রান্সপোর্টের ম্যানেজার মো. আ. হাকিম বলেন, প্রায় ৮ হাজার কুলি শ্রমিক এই নৌবন্দরে কাজ করতো। এর মধ্যে, অনেক ট্রান্সপোর্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীও রয়েছেন। জাহাজ কার্গো না আসায় তারা বেকার হয়ে পড়ছেন। কাজ পাচ্ছে না।
পদ্মা ট্রান্সপোর্ট এর মালিক রহমান জানান, বছরের ৫ মাস এখানে পানি কম থাকে বলে পণ্য খালাসে সমস্যা হয়।
ফরিদপুরের সিএন্ডবি ঘাট হতে শুল্ক আদায়কারী বিআইডব্লিউটিএর কর্মচারী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, বন্দরে জাহাজ, কার্গো বলগেট, বড় ট্রলার ভিড়তে না পারায় তাদের শুল্ক আদায়ও কমে গেছে। তিনি জানান, আগে ঘাটটি ইজারা দেয়া হতো। তবে এখন সরাসরি বিআইডব্লিউটিএর লোকেরা শুল্ক আদায় করেন।
এ ব্যাপারে বিআইডব্লিউটিএর সংশ্লিষ্ট পোর্ট অফিসার মাসুদ কামাল বলেন, নৌবন্দরটিকে সচল করতে নৌচ্যানেলে ড্রেজিং কাজ চলছে। তবে এই ঘাটটি এখনও পথটি বড় নৌযান চলাচলের উপযুক্ত হয়নি। আশা করছি চলতি মৌসুমেই ঘাট পয়েন্টে ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু করলে এই সঙ্কট কেটে যাবে।
গণমাধ্যমকর্মীর সাথে কথা হয় ঘাটের কুলি শ্রমিকদের জনৈক প্রবীণ নেতা মো. তারা মিয়া এর সাথে তিনি জানান, এই ঘাটে ১১টি কুলি সেক্টরে প্রায় ৮ হাজার কুলি শ্রমিক ছিল। পদ্মার যৌবন থাকা অবস্থায় এই বন্দের প্রতিদিন ৩/৪ শত নৌযান ভিড়তো। এখন নাব্যতা সঙ্কটের কারণে সপ্তাহ ১০/১৫ বলগেট ৩/৪ টি জাহাজ আসে। কাজ নেই। তাই কমপক্ষে ৭ হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে পড়ছে।
একটি বিষয় ঘাট শ্রমিক ও ট্রান্সপোর্ট মালিকরা দুঃখ করে বলছেন, সরকার এই ঘাটটি থেকে বছরে প্রায় দেড়কোটি টাকা রাজস্ব আয় করেন। অথচ নিজস্ব কোনো শৌচাগার নাই। বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের আমলে নিতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন