রেকর্ড পরিমাণ বিমান ভাড়া বৃদ্ধির কারণে সরকার এ বছরের জন্য বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল হজ প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সরকারি-বেসরকারি হজ ব্যবস্থাপনায় হজ প্যাকেজের ব্যয় প্রায় ৭ লাখ টাকা। কোরবানি, খাবার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ যোগ করার পর হজ প্যাকেজের প্রকৃত খরচ দাঁড়াবে ৮ লাখ থেকে সাড়ে ৮ লাখ টাকায়। বাংলাদেশ থেকে সউদী পর্যন্ত উড়োজাহাজ ভাড়া ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা করা হয়েছে। অথচ ভারত ও পাকিস্তানের হজযাত্রীদের উড়োজাহাজ ভাড়া ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে। এছাড়াও সে দেশে সরকার হজগমনেচ্ছুদের জন্য ১ লাখ টাকা ভর্তুকি দেয়।
অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (এটিএবি) নেতাদের মতে বাংলাদেশ বিমান ও সউদী আরবের একচেটিয়া ব্যবসার কারণে উড়োজাহার ভাড়া বেশি নেয়া হচ্ছে। এ থেকে হজ গমনেচ্ছুদের পরিত্রাণ পেতে বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরির জন্য সরকারের উচিত ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার এয়ারলাইন্সগুলোকে বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রী পরিবহণের অনুমতি দেয়া।
তিন দফায় হজযাত্রীদের নিবন্ধনের সময় বাড়ানোর পরও আশানুরূপ ফল হাওয়া যাচ্ছে না। কারণ অতিরিক্ত হজ প্যাকেজের কারণে প্রস্তুতি নিয়ে এবং নিয়ত করেও অনেকেই হজে যেতে পারছেন না। হজ এজেন্সি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) এবং অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (এটিএবি) জানিয়েছে, হজ প্যাকেজের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ হলো অস্বাভাবিক বিমান ভাড়া।
হাব ও এটিএবি নেতারা বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই অতিরিক্ত মুনাফা করতে ৩০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে। এতে করে গত বছরের তুলনায় এবার সরকারি ও বেসরকারি উভয় হজ ব্যবস্থাপনায় হজ প্যাকেজে খরচ বেড়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা।
এটিএবির তথ্য অনুযায়ী, গত ৬ বছরে বিমান প্রায় ৭০ শতাংশ ভাড়া বাড়িয়েছে। ২০১৭ সালে এই ভাড়া ছিল ১ লাখ ১৮ হাজার টাকা, ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা করে, ২০২০ সালে ছিল ১ লাখ ৩৮ হাজার টাকা, ২০২২ সালে ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। করোনার কারণে ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে কেউ হজে যাননি।
এ বছর বিমান ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ২ লাখ (১ লাখ ৯৭ হাজার) টাকা। গত বছরের চেয়ে এ বছর বিমান ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৬০ হাজার টাকা।
করোনা মহামারির কারণে গত ২ বছর সীমিত পরিসরে হজ অনুষ্ঠিত হওয়ায় এ বছর হজে যাওয়ার জন্য আড়াই লাখেরও বেশি বাংলাদেশি প্রাকনিবন্ধন সম্পন্ন করেন। ২০২২ সালে ৬০ হাজার বাংলাদেশি হজ করার অনুমতি পেয়েছিলেন। তবে ৬৭ বছরের বেশি বয়সিদের হজে যেতে দেয়া হয়নি।
বাংলাদেশ থেকে হজ পালনে আগ্রহীরা জানান, তারা ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা খরচ করে হজ করতে পারবেন। কিন্তু উচ্চ বিমান ভাড়ার কারণে হজ প্যাকেজের খরচ অনেক আগ্রহী হজ পালনকারীর নাগালের বাইরে চলে গেছে।
স্বাভাবিক সময়ে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সে ঢাকা থেকে সউদী আরবের যাওয়া ও আসার ভাড়া ৮০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা। হাব নেতারা বলেন, স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ বিমান ভাড়া নেয়ার বিষয়টি একেবারেই অযৌক্তিক। একমুখী যাত্রী বহনের জন্য দ্বিগুণ ভাড়া নেয়া অগ্রহণযোগ্য। মুসলিম দেশ হিসেবে হজ যাত্রীদের এতো ভাড়া বাড়ানো অন্যায় বটে।
অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা জানান, করোনার সময়ের লোকসান পুষিয়ে নিতে বিমান তাদের এবং প্রতিষ্ঠানকে লাভজনক হিসেবে দেখাতে প্রতি বছর হাজীদের বিমান ভাড়া বাড়ায়।
উচ্চ ভাড়া নেয়ার বিষয়ে বিমান বরাবরই যুক্তি দেখায়, প্রায় খালি উড়োজাহাজ নিয়ে সউদী আরব থেকে তাদের ঢাকায় আসতে হয়। তাই তারা অতিরিক্ত ভাড়া নেন। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বক্তব্যের কোনো ভিত্তি নেই। ফ্লাইট খালি এলে ভাড়া দ্বিগুণ করার দরকার নেই। কারণ ফ্লাইট খালি এলে হ্যান্ডলিং খরচ অনেক কমে যায়। যখন একটি ফ্লাইট কোনো যাত্রী বা লাগেজ ছাড়া খালি আসে, তখন তেল খরচ কমে যায়। এ ছাড়া, কোনো করও দিতে হয় না। কাজেই এই যুক্তিতে দ্বিগুণ ভাড়া নেয়া অযৌক্তিক।
পাকিস্তানে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়নি। পাকিস্তান টুডের প্রতিবেদন বলছে, পাকিস্তানের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে তারা মার্চের শুরুতে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করবে। এ বছরের জন্য তাদের আনুমানিক হজ প্যাকেজ হবে প্রায় ১০ লাখ পাকিস্তানি রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৪ লাখ টাকা।
ভারতের হজ কমিটির ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুসারে, তারা ২০১৮ সালে ৩ লাখ ৯৯ হাজার ভারতীয় রুপির হজ প্যাকেজ ঘোষণা করে। ২০২২ সাল পর্যন্ত তাদের একই খরচ ছিল।
ভারতের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, এ বছর প্রত্যেক হজ যাত্রীর জন্য ১ লাখ রুপি ভর্তুকি দেয়া হবে। সে অনুসারে ভারতীয়দের হজ প্যাকেজ হবে ৩ লাখ রুপি, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪ লাখ টাকার কম।
ভারত ও পাকিস্তানের উড়োজাহাজ ভাড়া ১ লাখ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে। বাংলাদেশ বিমান ও সউদী আরবের একচেটিয়া ব্যবসা থেকে পরিত্রাণ পেতে এটিএবি ও হাব নেতারা বলেন, বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরির জন্য সরকারের উচিত ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার এয়ারলাইন্সগুলোকে বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রী পরিবহণের অনুমতি দেয়া।
চলতি বছর ১ লাখ ২৭ হাজার বাংলাদেশি হজ করার সুযোগ পাবেন। কিন্তু মাত্র ৩৮ হাজার আগ্রহী হজযাত্রী নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন। হাব ও এটিএবি নেতারা বলেন, হজ প্যাকেজের উচ্চমূল্যের কারণে অনেক আগ্রহী হাজী প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ জোগাড় করতে না পারায়, এবার হজ যাত্রীর সংখ্যা কমে যেতে পারে। দেশে হজ গমনেচ্ছুদের প্রশ্ন ভারত পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশিদের হজের খরচ দ্বিগুণ কেন?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন