শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

কবে হবে স্বাধীন প্রসিকিউশন?

৯৫ ভাগ মামলায় হারছে সরকার

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০২৩, ১২:০১ এএম

অধ্যাদেশ জারি হয়েছিল ১৪ বছর আগে। কিন্তু জাতীয় সংসদ সেটি অনুমোদন দেয়নি। এ কারণে আলোর মুখ দেখেনি বিচার কার্যক্রমের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস আইন’। এর ফলে বিচারে রাষ্ট্রপক্ষীয় আইনি লড়াইয়ে এখনও পেশাদারিত্ব আসেনি। আইনি লড়াইয়ে সুরক্ষিত থাকছে না রাষ্ট্রীয় স্বার্থ। অস্থায়ীভিত্তিতে উচ্চ আদালতে অ্যাটর্নি জেনারেল, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল এবং বিচারিক আদালতে পাবলিক প্রসিকিউটর, সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর, স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়া হলেও সুরক্ষা হচ্ছে না রাষ্ট্রীয় স্বার্থ। বিশেষ করে ৯৫ ভাগ দেওয়ানি মামলায় পরাজিত হচ্ছেন সরকার নিযুক্ত প্রসিকিউটরগণ।

রাষ্ট্রের হয়ে লড়া এসব আইন কর্মকর্তাদের বড় একটি অংশের বিরুদ্ধেই রয়েছে অসততা, প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের পক্ষে কিন্তু গোপন সমঝোতায় আসামিপক্ষকে সহযোগিতা করার গুরুতর অভিযোগ। কিন্তু রাজনৈতিক আনুগত্য বিবেচনায় নিয়োগ দেয়ার কারণে দায়ী আইনজীবীদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা যাচ্ছে না। এছাড়া নৈতিক দৃঢ়তা, পেশাদারিত্ব না থাকা এবং প্রশিক্ষণের অভাবও দেশের অ্যাটর্নি সার্ভিসকে ‘যেনতেন বিষয়’ এ পরিণত করা হয়েছে। যখন যে দলীয় সরকার তখন সেই দলীয় আইনজীবীদের আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এতে অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয় এবং পাবলিক প্রসিকিউটর অফিস পরিণত হয়েছে দলীয় পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এতে ‘সরকারি স্বার্থ’ কোনো প্রকারে রক্ষা হলেও হানি হয় রাষ্ট্রীয় স্বার্থের। এসব কারণে একটি স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা পরিলক্ষিত হয়ে আসছে দেশের বিচারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০০৮ সালে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘অ্যাটর্নি সার্ভিস অধ্যাদেশ ২০০৮’ জারি হয়। পাশাপাশি সরকারি অ্যাটর্নি অধিদফতরও প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু পরে সেটি মন্ত্রিসভা নীতিগত অনুমোদন দেয়নি। জাতীয় সংসদ থেকেও অধ্যাদেশটি অনুমোদন পায়নি। ফলে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয় নানা বিবেচনায় ইতিবাচক এ উদ্যোগটি। তবে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিসের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে পরবর্তীতে জনস্বার্থে একাধিক রিট হয়। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর দায়েরকৃত রিটে সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগে অ্যাটর্নি সার্ভিস কমিশন গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়। এর মধ্যে একটি রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছর বছর ১৭ নভেম্বর ‘স্বাধীন প্রসিকিউশন-অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের কেন নির্দেশনা দেয়া হবে না’ এই মর্মে রুলনিশি জারি করেন হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ। রিটে আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন কমিশনের চেয়ারম্যান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সংসদ সচিবালয়ের সচিবকে বিবাদী করা হয়। রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট ফরহাদ উদ্দিন আহমেদ ভুইয়া। সরকারপক্ষে তৎকালিন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুদ্দিন খালেদ শুনানিতে অংশ নেন।

এর আগে দু’ জন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও একজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট করলে হাইকোর্টের তৎকালিন ডিভিশন বেঞ্চ ২০১৯ সালের ১২ নভেম্বর রুল জারি করেন। একই সঙ্গে ওই বছর ৭ জুলাই নিয়োগ-সংক্রান্ত জারি করা ৬ সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের নামের পাশে আইনজীবীর তালিকাভুক্তির তারিখ না থাকায় বার কাউন্সিলের সচিবকে যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট।

রিটে বলা হয়, বিদ্যমান আইনে আদালতের আইন কর্মকর্তা নিয়োগের বিধান সংবিধানের ১৯ (১), ২২, ২৯ (১) (২) এবং ৩১ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই বিধানটিতে ব্যাপক বৈষম্য রয়েছে। সততা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও নেতিকতাসম্পন্ন আইনজীবীকে আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করতেই স্বাধীন প্রসিকিউশন সার্ভিস গঠন করা দরকার। ২০০৭ সালে এ-সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছিল। সেটি সংসদে পাস না হওয়ায় আইনটি বৈধতা পায়নি। পরবর্তীতে নতুন আইনও প্রণয়ন করা হয়নি। স্বাধীন প্রসিকিউশন সার্ভিস বা অ্যাটর্নি সার্ভিস করা হলে আইনজীবীরা লাইব্রেরিমুখী হবেন। তারা কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি বা গোষ্ঠীর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হবেন না। এটা করা হলে রাষ্ট্র দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন প্রসিকিউশন পাবে। তারা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারবে।

সুপ্রিম কোর্ট বারের অ্যাডভোকেট ড. বাবরুল আমীন বলেন, অ্যাটর্নি সার্ভিস আইন প্রণয়ন করা হলে চুক্তিভিত্তিক আইন কর্মকর্তা নিয়োগের প্রথা থাকবে না। এর আওতায় ন্যূনতম আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারীরা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে পরীক্ষা দিয়ে আইন কর্মকর্তা তথা উচ্চ আদালতে সহকারী, ডেপুটি ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এবং নিম্ন আদালতে এপিপি, জিপি ও পিপি পদে নিয়োগ পাবেন। গুরুত্বপূর্ণ এসব পদ আর রাজনৈতিক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হবে না।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বিগত ২০০২ সালে অ্যাটর্নি সার্ভিস আইনপ্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের চূড়ান্ত অনুমোদনের পর অ্যাটর্নি সার্ভিস অধ্যাদেশ প্রেসিডেন্ট সংবিধানের ৯৩ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী একই বছরের ১৫ মে অনুমোদন দেন। এর তিন দিন পর ১৮ মে গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়। ওই অধ্যাদেশের ক্ষমতাবলে একই বছর ২ জুন সরকারি অ্যাটর্নি অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয়। জাতীয় প্রেসক্লাবের দক্ষিণ পাশে সচিবালয় লিংক রোডের পরিবহন পুলের ১১ তলায় অফিসও নেয়া হয়। ওই অধিদফতরের মহাপরিচালক হিসেবে লেজিসলেটিভ বিভাগের তৎকালি যুগ্ম সচিব মো. ইসরাইল হোসেনকে নিয়োগ দেয়া হয়। অধিদফতরে কয়েকটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে ওই অধ্যাদেশ জাতীয় সংসদে পাস না হওয়ায় তা হিমাগারে চলে যায়। জাতিসংঘ দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস গঠনের বিধান রয়েছে।

সূত্রটি আরও জানায়, একশ্রেণির অপেশাদার আইনজীবীদের আপত্তির কারণে স্থায়ী ও স্বাধীন অ্যাটর্নি সার্ভিস আইনটি করা যাচ্ছে না। ওই সব সুবিধাভোগী আইনজীবীরা সরকারের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পদ-পদবি ব্যবহার করেন। ফলে, অযোগ্য ও অদক্ষ আইনজীবীরা সরকারের আইন কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন রাজনৈতিক বিবেচনায়। এতে সরকার তথা রাষ্ট্র বঞ্চিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনার জন্য পাবলিক প্রসিকিউশনস যে সার্ভিস আছে, সেখান থেকে ৩০ শতাংশ ইনডিপেনডেন্ট (স্বাধীন) করার পরিকল্পনা রয়েছে। ২০১২ সালের ২ সেপ্টেম্বর সচিব কমিটির সভায় দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাটর্নি সার্ভিস আইন প্রণয়নের আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সচিবদের প্রস্তাবের যৌক্তিকতা সম্পর্কে ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে প্রধানমন্ত্রী সে সময় বলেছিলেন, বিপুল সংখ্যক মামলার কারণে বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে বিঘ্নিত ও বিলম্বিত হচ্ছে। সরকারি স্বার্থ সুরক্ষার জন্য স্বতন্ত্র অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, গতবছর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন আদালতে দেওয়ানি মামলা ছিল ১৪ লাখ ৭৮ হাজার ৮২৭টি। ফৌজদারি মামলার ২১ লাখ ৬ হাজার ৬৯২টি। অন্য মামলার সংখ্যা ৯৯ হাজার ২০৯টি। পরিসংখ্যান মতে, আপিল বিভাগে গত বছর বিচারাধীন মামলা ছিল ২৩ হাজার ৬১৭টি। এর মধ্যে দেওয়ানি ১৫ হাজার ৫৩৩টি। ফৌজদারি ৭ হাজার ৮৯৮টি। আরও রয়েছে আদালত অবমাননার ১৮৬টি আবেদন।

হাইকোর্ট বিভাগে ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮ বিচারাধীন মামলার মধ্যে ৯৭ হাজার ৬১৬টি দেওয়ানি এবং ২ লাখ ৯২ হাজার ৪২৯ ফৌজদারি। এছাড়া ৮৭ হাজার ৮৫৩টি রিট মামলা এবং অন্যান্য মামলা ১১ হাজার ১৭০টি।
অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩১ লাখ ৭২ হাজার ৪৩টি। এর মধ্যে ১৩ লাখ ৬৫ হাজার ৬৭৮ দেওয়ানি এবং ১৮ লাখ ৬৩৬৫ ফৌজদারি। আপিল বিভাগে ২০২১ সালে ২৩ হাজার ৬১৭টি মামলার মধ্যে দেওয়ানি-ফৌজদারি মিলিয়ে নিষ্পত্তি হয়েছিল ৬ হাজার ৩০৩টি মামলা। নিষ্পত্তির হার ২৬ দশমিক ৬৯ শতাংশ। হাইকোর্ট বিভাগে ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৬৮ বিচারাধীন মামলার মধ্যে দেওয়ানি-ফৌজদারি, রিট মিলে ১ লাখ ৩৫ হাজার ২৭৫টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। নিষ্পত্তির হার ২৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ।

গত বছর অধস্তন আদালতে বিচারাধীন ৩১ লাখ ৭২ হাজার ৪৩টি মামলার মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ১১ লাখ ৬৫ হাজার ৯৩৫টি মামলা। নিষ্পত্তির হার ৩৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ। এসব মামলায় ৯৫ ভাগই চূড়ান্তভাবে সরকার তথা রাষ্ট্রপক্ষ হেরে যায়। অধিকাংশ মামলায় বাদীপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় তারা সরকারি সম্পত্তি অবৈধভাবে দখলে রাখে। এসব অবৈধ দখলদারকে উচ্ছেদ করতে সরকার অভিযান চালালে প্রতিপক্ষ আদালতে মামলা ঠুঁকে দেয়। চলতে থাকে দীর্ঘ সময় ধরে। এরমধ্যে অধিকাংশই ভূমি-সংক্রান্ত মামলা। সরকারপক্ষীয় আইনজীবীরা তথ্য-প্রমাণ আদালতে যথাযথভাবে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারপক্ষ পরাজিত হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তাদের হেরে যাওয়ার ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো জবাবদিহিতাও থাকে না। সিনিয়র অ্যাডভোকেট মো: মাহবুবুর রহমানের মতে, এ বাস্তবতা থেকেই স্বাধীন, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করা যায়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন