মোহাম্মদ সালাউদ্দিন শেখ (৩৮), মো. আব্দুর রহমান (৩২) ও মো. স্বপন ওরফে সিলেটি স্বপন (৩০)। থাকতেন এক বাসায়। কাজও করতেন একই সাথে। সালাউদ্দিনের সাথে সাড়ে তিন হাজার টাকা নিয়ে বিরোধ হয় স্বপনের। আর এর জের ধরে তাকে উচিত শিক্ষা দিতেই ঘুমন্ত অবস্থায় তার গলায় ছুরি চালান স্বপন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে রুমমেটকে হত্যায় অংশ নেন আব্দুর রহমানও। এরপর হাতপা বাঁধা লাশ বাসায় ফেলে পালিয়ে যান ওই দুই জন। সামান্য টাকা নিয়ে বিরোধের মত তুচ্ছ ঘটনায় সহকর্মীর প্রতি ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ নিল তারা।
পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআইর অভিযানে খুনের আট দিনের মাথায় ধরা পড়েন আব্দুর রহমান। এরপর দায় স্বীকার করে নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দেন তিনি। আর এর মধ্যদিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর টাইগারপাসে বাসা থেকে যুবকের গলা কাটা লাশ উদ্ধারের ঘটনার রহস্য উদঘাটন হয়েছে। খুনি চক্রের অপর সদস্য সিলেটি স্বপনকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পিবিআই।
গত ২৭ ফেব্রুয়ারি নগরীর খুলশী থানাধীন টাইগারপাস রেলওয়ে কলোনীর পরিত্যক্ত ১১ নম্বর বিল্ডিংয়ের সামনে ছেনোয়ারা বেগম ছেনুর টিনশেড ভাড়াটিয়াদের ঘর থেকে অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রাথমিকভাবে জানা যায় লাশটি সালাউদ্দিনের। ওই বাসায় সালাউদ্দিনসহ তিনজন থাকলেও ঘটনার পর বাকি দুইজন হাওয়া হয়ে যান। তবে বাড়ির মালিকের কাছে তাদের কোন নাম ঠিকানাও ছিলও না। পুলিশের ধারণা তাকে ২৪ ফেব্রুয়ারির পর যে কোন সময় হত্যা করা হয়। আর হত্যার পর দুই রুমমেট পালিয়ে যান।
এই ঘটনায় থানার এসআই জামাল উদ্দিন বাদি হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। লাশ উদ্ধারের পর সেখানে যায় পিবিআইয়ের টিম। তারা সেখান থেকে কিছু আলামত সংগ্রহ করে। নিজ বাসায় খুনের ঘটনায় ঘটনায় নগরীতে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। সম্পূর্ণ ক্লু-লেস বা সূত্রবিহীন এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন ও খুনিদের গ্রেফতারে মাঠে নামে পিবিআই। মামলার রুজুর পর তারা তা অধিগ্রহণ করে তদন্ত শুরু করে।
পিবিআই প্রথমে আঙ্গুলের চাপ নিয়ে সালাউদ্দিন শেখের বিস্তারিত পরিচয় উদঘাটন করে। তার পিতা মৃত আব্দুল মালেক শেখ, মাতা রেজিয়া বেগম। তাদের গ্রামের নাম বরপা, মাসাবো (দক্ষিণ), ওয়ার্ড নম্বর ৬,তারাবো পৌরসভা, থানা রূপগঞ্জ, জেলা নারায়নগঞ্জ। তিনি তার সহকর্মীদের নিয়ে টাইগারপাস রেলওয়ে কলোনীর ওই বাসায় ভাড়া থাকতেন। মামলা তদন্তের এক পর্যায়ে পিবিআই তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে তার রুমমেটদের অবস্থান ও পরিচয় সনাক্ত করে। এক পর্যায়ে শুক্রবার বিকেলে রাজধানী ঢাকার ধানমন্ডি মিনা বাজারের সামনে থেকে সন্দেহভাজন আব্দুর রহমানকে পাকড়াও করা হয়। তিনি চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপ উপজেলার হরিষপুর গ্রামের মো. আলাউদ্দিনের পুত্র। টাইগারপাসের ওই বাসায় সালাউদ্দিনের সাথে থাকতেন তিনি।
পিবিআই জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে আব্দুর রহমান খুনের ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। আব্দুর রহমানের জবানবন্দির বরাত দিয়ে পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, প্রথমে সালাউদ্দিন ও সিলেটি স্বপন উক্ত কক্ষে ভাড়া থাকতেন। আব্দুর রহমান টাইগার পাস ঘুরাইন্না গেইট এলাকায় জনৈক দুলালের চা দোকানে কাজ করতেন। চা দোকানে আসা-যাওয়ার সূত্র ধরে সালাউদ্দিন ও সিলেটি স্বপনের সাথে আব্দুর রহমানের পরিচয় হয়। পরবর্তীতে থাকার সমস্যা হওয়ায় আব্দুর রহমান সালাউদ্দিন সিলেটি স্বপনের সাথে টাইগারপাসের ওই বাসায় ভাড়াটিয়া হিসাবে বসবাস শুরু করেন। একই বাসায় থাকার সুবাধে তারা এক সাথে নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করতেন। সম্প্রতি নগরীর হালিশহর আবাহনী মাঠ ও পলোগ্রাউন্ডে বাণিজ্য মেলার বিভিন্ন স্টল তৈরির কাজ করেন তারা। বয়সে বড় হওয়ায় কাজের মজুরির টাকা সালাউদ্দিন গ্রহণ করতেন। কাজের বিনিময়ে প্রাপ্ত টাকা সালাউদ্দিন অন্য দুইজনকে কম দিতেন বলে সন্দেহ করা শুরু করেন স্বপন। এক পর্যায়ে আব্দুর রহমানও স্বপনের মতো সালাউদ্দিনকে সন্দেহ করেন। টাকা কম দেওয়া নিয়ে সালাউদ্দিনের সাথে প্রায় ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হতেন স্বপন। এক পর্যায়ে স্বপন সালাউদ্দিনের কাছে তার আগের বকেয়া মজুরি বাবত সাত হাজার টাকা দাবি করেন।
তবে সালাউদ্দিন বকেয়ার পরিমাণ সাড়ে তিন হাজার টাকা দাবি করে তাকে তাৎক্ষণিক দুই হাজার টাকা পরিশোধ করেন। অবশিষ্ট দেড় হাজার টাকা স্বপনকে পরে পরিশোধ করার প্রতিশ্রুতি দেন। তবে তা মানতে রাজি হননি সিলেটি স্বপন। যার ফলে বিরোধ আরো প্রকট আকার ধারণ করে। এরই এক পর্যায়ে ঘটনার অনুমান সপ্তাহখানেক পূর্বে আব্দুর রহমান ও সিলেটি স্বপন সালাউদ্দিনকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করে।
পরিকল্পনা মোতাবেক তারা একটি ধারালো ছুরি কিনে। ২৪ ফেব্রুয়ারি স্বপন ও আব্দুর রহমান কাজে না গিয়ে বাসায় অবস্থান করেন। রাত অনুমান সাড়ে ১০টায় সালাউদ্দিন কাজ শেষে বাসায় ফিরে আসেন। কিছুক্ষণ মোবাইল ফোন দেখে যথারীতি ঘুমিয়ে পড়েন। অন্যদিকে আব্দুর রহমান ও সিলেটি স্বপন কিছুক্ষণ ছক্কা খেলে তারাও ঘুমিয়ে পড়েন।
পরিকল্পনা মোতাবেক রাত ১টার দিকে স্বপন ঘুম থেকে উঠেন এবং আব্দুর রহমানকেও জাগিয়ে তোলেন। স্বপন প্রথমে ছুরি দিয়ে ঘুমন্ত সালাউদ্দিনের গলায় আঘাত করেন। এসময় আব্দুর রহমান তার দুই হাত চেপে ধরেন। এরপর স্বপনের হাত থেকে ছুরি নিয়ে আব্দুর রহমান সালাউদ্দিনের গলায় আরো একটি আঘাত করেন। ততক্ষণে সালাউদ্দিন নিজেকে রক্ষায় আব্দুর রহমানের হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিতে চাইলে তার ডান হাতে কেটে যায় এবং আব্দুর রহমানের কব্জির উপরেও কাটা জখম হয়। আঘাতের তীব্রতায় সালাউদ্দিনের দেহ নিস্তেজ হয়ে আসলে আব্দুর রহমান তার নিজের হাতের কাটা অংশ রুমাল দিয়ে বেঁধে নেন। রুমে থাকা গামছা দিয়ে সালাউদ্দিনের দুই হাত বাঁধেন। স্বপন সালাউদ্দিনের দুই পা ওড়না দিয়ে বাঁধেন। পরে তাদের রুমে থাকা আরেকটি গামছা ও কম্বল দিয়ে সালাউদ্দিনের মুখ ঢেকে দেন।
এরপর আব্দুর রহমান ও সিলেটি স্বপন সালাউদ্দিনের মানিব্যাগে থাকা ৩৫০ টাকা ভাগ করে নেন। সালাউদ্দিনের মোবাইল ফোন আব্দুর রহমান নিজের কাছে রাখেন। শেষে তারা ঘরের দরজা বন্ধ করে রিক্সায় নগরীর অলংকার চলে যান। অলংকার থেকে বাসে করে ফেনী যান। ফেনী থেকে অন্য বাসে সিলেট যান। সিলেট থেকে তারা নরসিংদীর মালদ্বীপ যান। সেখানে সিলেটি স্বপন কাজের জন্য থেকে যান আর আব্দুর রহমান নারায়ণগঞ্জে তার মামার বাসায় যান। সেখানে আব্দুর রহমান একদিন থেকে কুল্লিার চাঁন্দিনায় তার শ্বশুর বাসায় যান। পরবর্তীতে পুলিশি অভিযানের মুখে আব্দুর রহমান পালিয়ে ঢাকা ধানমন্ডি তার স্ত্রীর কাছে চলে যান। সেখান থেকে পিবিআই তাকে গ্রেফতার করে।
এদিকে গতকাল শনিবার আব্দুর রহমানকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত দিনের রিমান্ডে আনা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পরিদর্শক মো. কামরুল ইসলাম জানান, তাকে সাত দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করা হয়। শুনানি শেষে মহানগর হাকিম সরোয়ার জাহান সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। #
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন