আবারও ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপেছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড। একটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট থেকে বিস্ফোরণের পর ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে কমপক্ষে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। গত বছরের ৪ জুন রাতে একই এলাকার বেসরকারি বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণে অর্ধ শতাধিক মানুষের মৃত্যু আর চার শতাধিক আহতের ঘটনার রেশ না কাটতেই গতকাল শনিবার ফের বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলো। বিকেল সাড়ে ৪টা নাগাদ সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেড নামে এ কারখানাতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, প্রচণ্ড বিস্ফোরণে আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকা কেঁপে ওঠে। এরপর অক্সিজেন কারখানায় একের পর এক বিস্ফোরণে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণের সাথে ভবনের দেয়াল, ছাদ উড়ে যায়। সেখানে থরে থরে মজুদ অসংখ্য গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়ে অনেক দূরে ছিটকে পড়ে। চারিদিকে ইট, লৌহখণ্ড বৃষ্টির মতো পড়তে থাকে। বিস্ফোরণে কারখানায় কর্মরত অনেকের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। কারখানায় বিস্ফোরণের সময় নিকটবর্তী একটি তৈরি পোশাক কারখানাসহ আশপাশের কারখানা ও ভবনের দরজা, জানালা ও কাঁচ ভেঙে পড়ে। বিধ্বস্ত হয় বেশ কয়েকটি বাড়ির টিনের ছাদ।
বিস্ফোরণের শব্দ আর একের পর এক লৌহখণ্ড উড়ে আসার ঘটনায় হতবিহ্বল লোকজন দিক-বিদ্বিকজ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে থাকে। কারখানা থেকে প্রচণ্ড ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশে উঠে চারিদিক অন্ধকার করে দেয়। দুর্ঘটনার পর আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে হতাহতদের উদ্ধারে ঝাঁপিয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ছুটে যায় ফায়ার সার্ভিসের ছয়টি ইউনিট। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পাশাপাশি সীতাকুণ্ড থানা পুলিশ উদ্ধার কাজে নামে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সেখান থেকে অন্তত ৩০ জনকে উদ্ধার করা হয়। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে তিনজন এবং চমেক হাসপাতালে নেয়ার পর আরও দুইজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন। রাত সাড়ে ৮টায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন ঘটনাস্থলে তিনজন এবং হাসপাতালে তিনজনসহ ছয়জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেন। আহতদের মধ্যে বেশিরভাগেরই হাত-পা উড়ে গেছে। অনেকের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিস্ফোরণের পর সেখানে শ^াসকষ্ট দেখা দেয়। আহতদের অনেকের নাক-মুখ দিয়ে লালা ও রক্ত ঝরতে দেখা যায়। একের পর এক রক্তাক্ত আহতদের উদ্ধার করে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে আনা হয়। আহতদের আর্ত চিৎকার আর হতাহতদের স্বজনের আহাজারিতে চমেক হাসপাতাল এলাকায় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। হতাহতদের মধ্যে কারখানা শ্রমিক এবং আশপাশের কারখানার লোকজন ও স্থানীয় বাসিন্দারাও রয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। খবর পেয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান, পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সেখানে ছুটে যান। দুর্ঘটনা তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের কথা জানান জেলা প্রশাসক।
ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। তবে কী কারণে এ বিস্ফোরণ তা তদন্তের পর জানা যাবে। বিস্ফোরণের পর সৃষ্ট আগুন সন্ধ্যার আগে নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। তবে আরও বিস্ফোরণের আশঙ্কায় অক্সিজেন প্ল্যান্ট এলাকায় সর্বোচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। নিরাপদ দূরত্বে থেকে উদ্ধার কর্মীরা কাজ করছেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে দুইজনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের একজন হলেন শামসুল আলম (৬৫)।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, কারখানা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কদম রসুল জাহানাবাদে বাড়ির পাশে একটি খোলা মাঠে ছিলেন তিনি। বিস্ফোরণের সাথে একটি লৌহখণ্ড সেখানে গিয়ে তার মাথায় পড়ে। এতে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। অন্যজন হলেন প্ল্যান্টের গাড়ি চালকের সহকারী মো. ফরিদ (৪০)। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আহত ১৯ জনকে চমেক হাসপাতালে আনা হয়েছে। আহতদের মধ্যে নয়জনের নাম জানা গেছে। তারা হলেন- মো. নুর হোসেন (৩০), মো. আরাফাত (২২), মো. মোতালেব (৫২), ফেনসী আকতার (৩০), মো. জসিম উদ্দিন (৪৫), নারায়ণ চন্দ্র (৬০), মো. ফোরকান (৩৫), মো. শাহরিয়ার (২৬), মো. জাহিদ হাসান (২৫)।
এর আগে গত বছরের ৪ জুন রাতে এ কারখানার এক কিলোমিটার দূরবর্তী বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হয়। ওই দুর্ঘটনায় কমপক্ষে ৫৪ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন চার শতাধিক মানুষ। একের পর এক বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সীতাকুণ্ড শিল্পাঞ্চলে এখন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। বিএম ডিপোর বিস্ফোরণের পর বলা হয়েছিল, অনুমোদন ছাড়াই ডিপোতে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক অরক্ষিত অবস্থায় মজুদ করায় বিস্ফোরণ ঘটে। অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনার পর কারখানার সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
এদিকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করার কথা জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক আবুল বাশার মো. ফখরুজ্জামান। রাতে তিনি ইনকিলাবকে জানান, ঘটনাস্থলে উদ্ধার কাজ চলছে। সেনাবাহিনীর একটি টিম উদ্ধার কাজে তাদের কোন সহযোগিতা লাগবে কিনা তা দেখতে ঘটনাস্থল ঘুরে গেছেন। আহতদের চিকিৎসার খরচ দেয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে দায়ীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে। সন্ধ্যায় দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সিটি মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি সেখানে সাধারণ মানুষকে ভিড় না করে উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন