বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

অতিরিক্ত চাপেই বিস্ফোরণ

সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে অগ্নি নিরাপত্তাতেই গলদ : ধ্বংসস্তুপে দুর্ঘটনার কারণ খুঁজছে তদন্ত কমিটি : থামছে না নিহতের স্বজনদের আহাজারি : আহত কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক : দৃষ

রফিকুল ইসলাম সেলিম ও শেখ সালাউদ্দিন | প্রকাশের সময় : ৬ মার্চ, ২০২৩, ১২:০১ এএম

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে গ্যাসের অতিরিক্ত চাপ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। দুর্ঘটনার জন্য অক্সিজেন কারখানার সার্বিক অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থার গলদও দায়ী বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বলা হচ্ছে, ফায়ার সেফটি বাস্তবায়ন করেনি কারখানা কর্তৃপক্ষ। তবে কেন এই বিস্ফোরণ তার প্রকৃত কারণ খুঁজতে মাঠে নেমেছে জেলা প্রশাসন গঠিত সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি। গতকাল রোববার কমিটির সদস্যরা দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
বিস্ফোরণে কারখানা ও আশপাশের এলাকা রীতিমত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। চারিদিকে শুধু ধ্বংসযজ্ঞ-প্রচণ্ড বিস্ফোরণে উড়ে গেছে কারখানা ভবন। আশপাশের এলাকায়ও ব্যাপক ক্ষতির চিহ্ন। ভয়াবহ এই বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে নিহত ছয়জনের পরিবারের থামছে না শোকের মাতম-আহাজারি। আহতদের মধ্যে ১৮ জন এখন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তাদের মধ্যে পাঁচজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। চোখের দৃষ্টি হারানোর আশঙ্কা তিনজনের।
আহতদের আর্তচিৎকার আর স্বজনদের কান্নায় এখনও ভারী হাসপাতালের বাতাস। দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত কারখানার আশপাশের বাসিন্দারাও চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। তাদের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আশপাশের বেশ কয়েকটি কারখানাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগুনের বিবর্ণ হয়ে গেছে আশপাশের সবুজ গাছপালা।
বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ। দুর্ঘটনায় মালিকপক্ষের কোন গাফেলতি থাকলে তাদেরও মামলায় আসামি করার কথা বলেছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। দুর্ঘটনার পর মালিকপক্ষের লোকজন আড়ালে চলে গেলেও গতকাল তারা কারখানা এলাকায় এসেছেন বলে জানিয়েছেন সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তোফায়েল আহমদ। গতকাল সকাল থেকে দ্বিতীয় দিনের মতো উদ্ধার অভিযানে নামে ফায়ার সার্ভিসের টিম। তবে ধ্বংসস্তুপের ভেতর কোন লাশ বা আহত কাউকে না পাওয়ায় এবং কেউ নিখোঁজ না থাকায় উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করা হয়। তবে ফের বিস্ফোরণের আশঙ্কায় সেখানে ফায়ার সার্ভিসের দুটি টিমকে স্ট্যান্ডবাই রাখার কথা জানান ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা।
গত শনিবার বিকেলে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী কদম রসুল এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক লাগোয়া সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণে প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকা প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠে। কারখানার দেয়াল, ভবনসহ আশপাশের সব স্থাপনা বিধ্বস্ত হয়। বিস্ফোরণের সাথে সাথে আগুন ধরে যায়। হতাহত হন প্রায় ৪০ জন। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে প্রথমে স্থানীয়রা উদ্ধারে এগিয়ে যান। এরপর ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ উদ্ধারে নামে। রাতে সেনাবাহিনীর একটি টিমও দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্তি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসানের নেতৃত্বে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। কমিটির সদস্যরা বিকেলে সেখানে যান। তারা সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে পর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল কিনা জানতে চান। তবে সেখানে উপস্থিত কারখানা ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা সেটি নিশ্চিত করতে পারেননি।
ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক মো. আব্দুল হামিদ মিয়া বলেন, দুর্ঘটনার পর আমরা ঘটনাস্থলে এসে বেশ কিছু অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র দেখতে পেয়েছি। তবে তা পর্যাপ্ত ছিল কিনা আমরা নিশ্চিত নই এখনও। তিনি বলেন, এ প্রতিষ্ঠানের ফায়ার লাইসেন্স ছিল। তবে তারা ফায়ার সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়ন করেনি। সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়নের জন্য তারা আবেদন করেছিলেন। অক্সিজেন সিলিন্ডার ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে একটি গাইডলাইন মেনে চলতে হয়। আর সেটি মেনেছে বলে মনে হচ্ছেনা। এ বিষয়টি বিস্ফোরক অধিদপ্তর ভালো বলতে পারবেন। এদিকে বিস্ফোরিত সিলিন্ডার ম্যানেজমেন্ট ঠিক ছিল কিনা সেটি খতিয়ে দেখতে সকালে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন ঘটনাস্থলে যান। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এগুলো নিয়ে আমরা বিশ্লেষণ করে দেখবো। এরপর আমাদের প্রতিবেদন জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির কাছে দেব।
তদন্ত কমিটির সদস্য ও সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, অক্সিজেন প্ল্যান্টের কলামে গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণেই এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। থানার ওসি তোফায়েল আহমদ বলেন, কেন বিস্ফোরণ সেটা বিশেষজ্ঞরা বলবেন। তবে প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে অতিরিক্ত চাপের কারণে প্ল্যান্টের কলাম বিস্ফোরণ হওয়ায় দুর্ঘটনা ঘটেছে। সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের ম্যানেজার মো. আবদুল আলীম দাবি করেন, ফায়ার সার্ভিস, পরিবেশ, বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিয়েছেন তারা। এমন দুর্ঘটনা কেন ঘটলো তা নিজেও বুঝতে পারছে না বলে জানান। তিনি বলেন, সবকিছু সুন্দরভাবেই চলছিলো। তদন্তের পর বলা যাবে এতো বড় ঘটনাটি কিভাবে হয়েছে।
সরেজমিনে ঘটনাস্থলে দেখা যায় এখনও অক্সিজেন সিলিন্ডারগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। পুরো কারখানা ধ্বংসস্তুপ। এছাড়া ভয়াবহ বিস্ফোরণে আশপাশের অনেক প্রতিষ্ঠানও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত এইচ স্টিল রি-রোলিং মিল, রুবাইয়া অক্সিজেন লিমিটেড, ভেজিটেবল অয়েল ও রুবাইয়া প্লাস্টিকসহ চারটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় আমাদের চারটি প্রতিষ্ঠানের কমপক্ষে ১০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিস্ফোরণে প্রতিষ্ঠানগুলোর ভবন ও ছাদ উড়ে গেছে। ওসি তোফায়েল আহমেদ ইনকিলাবকে বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাথমিক তদন্ত চলছে। এখানে কারখানা কর্তৃপক্ষের অবহেলা আছে। তবে কী ধরনের অবহেলা, সেটি তদন্ত করে দায়ীদের খুঁজে বের করা হবে। হতাহতদের নাম-ঠিকানা এজাহারে উল্লেখ করে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে।
জানা গেছে, শিল্পে ব্যবহৃত অক্সিজেন উৎপাদনের এ কারখানায় দুর্ঘটনার সময় ২৫ জন শ্রমিকসহ মোট ৪২ জন কাজ করছিলেন। সীমা অক্সিজেন অক্সিকো লিমিটেডে উৎপাদিত অক্সি-এসিটিলিন গ্যাস লোহার পাত কাটা ও লোহা গলাতে ব্যবহার হয়। বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় বিশেষ করে জাহাজভাঙা ও স্টিল রি-রোলিং মিলে এই গ্যাস ব্যবহার করা হয়। শিপব্রেকিং ব্যবসায়ী মরহুম মোহাম্মদ শফির গড়ে তোলা কারখানাটি বর্তমানে তার তিন ছেলে মামুন উদ্দীন, আশরাফ উদ্দীন ও পারভেজ উদ্দীন পরিচালনা করেন। এর আগে গত ৪ জুন রাতে সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের অদূরে বেসরকারি বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পর সাতটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। এরপর শিল্প কারখানায় নিরাপত্তার বিষয়টি খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হয়। আর এর মধ্যেই ঘটলো ফের বিস্ফোরণের ঘটনা।
হাসপাতালে ১৮জন : দুর্ঘটনায় নিহত ছয়জনের পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন- শামসুল আলম (৫০), ফরিদ উদ্দিন (৩৬), রতন লকরেট (৪৫), আব্দুল কাদের (৫০), সালাহউদ্দিন (৩৫) এবং সেলিম রিচিল (৩৮)। নিহতদের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আহতরা হলেন- আরাফাত আলম, মো. মনসুর, নারায়ণ ধর, মো. ফোরকান, জাহিদ হাসান, জসিম উদ্দিন, রোজী আক্তার, রিপন মারাথ, মো. ওসমান, মজিবুর রহমান, আব্দুল মোতালেব, নওশাদ সেলিম চৌধুরী, ফেন্সি, সোলাইমান, শাহরিয়ার, আজাদ, মাসুদ এবং প্রভাস। আহত অপর দুইজন রিপন ও নূর হোসেন প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন। হাসপাতালের ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডে ৭ জন, ২০ নম্বর ওয়ার্ডে ৩ জন, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ২ জন, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৪ জন এবং আইসিইউতে ২ জন চিকিৎসাধীন আছেন। মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ডা. শাহাদাত হোসেনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখতে যান। এ সময় তারা চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। ##

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন