শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

দুর্নীতিতে ডুবছে আর কে চৌধুরী কলেজ

৩০টির প্রমাণ পেয়েছে ডিআইএ অভিযোগকারীদের করা হয়েছে সাময়িক বরখাস্ত : বেতন না পেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন

ফারুক হোসাইন | প্রকাশের সময় : ৬ মার্চ, ২০২৩, ১২:০১ এএম

প্রিন্সিপাল ও ভাইস-প্রিন্সিপালের অনিয়ম-দুর্নীতিতে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রাজধানী যাত্রাবাড়ীর আর কে চৌধুরী কলেজ। প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকদের অভিযোগ প্রিন্সিপাল ইসতারুল হক মোল্লা ও ভাইস-প্রিন্সিপাল মো. রায়হানুল ইসলামের যোগসাজসে নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতি, অবৈধভাবে পদোন্নতি, অনুমোদনহীন ক্যাম্পাস পরিচালনা, শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদানের টাকা আত্মসাৎ, শিক্ষক কল্যাণ তহবিলের টাকা উত্তোলন, আইটি প্রতিষ্ঠান খুলে আর্থিক অনিয়ম, শিক্ষার্থীদের ফি, আপ্যায়নের ভূয়া বিল-ভাউচারে ব্যয়, বাস ভাড়ার নামে অর্থ লোপাট, বই-ফার্নিচার কেনায় অনিয়মসহ হেন কোন অনিয়ম নেই যেটি তারা করেননি। প্রিন্সিপাল ও ভাইস-প্রিন্সিপালের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে কলেজটির তিনজন শিক্ষক শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে (মাউশি) অভিযোগ প্রদান করেন। তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর (ডিআইএ) তদন্ত করে ৩০টি খাতে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে। এদিকে এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে অভিযোগ করার কারণে প্রতিষ্ঠানটির অভিযোগকারী ওই তিনজনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তারা হলেন- কলেজটির বাংলা বিভাগের শিক্ষক মোস্তফা কামাল পাশা, ইংরেজি বিভাগের উৎপল পাল চৌধুরী, শারীরিক শিক্ষার শিক্ষক মো. মনির হোসেন।
জানা যায়, ডিআইএ আর কে চৌধুরী কলেজের দুর্নীতি-অনিয়মের তদন্ত শেষে গত ১৯ জানুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। সেই প্রতিবেদনে দেখা যায়, কলেজটির প্রিন্সিপাল ও ভাইস-প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে ৩০টি খাতে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তারা। সহকারী শিক্ষা পরিদর্শক সোহেল আহমেদ ও অডিট অফিসার মো. ফিরোজ হোসেন অভিযোগ তদন্ত করেছেন। তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রিন্সিপাল ইসতারুল হক অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়েছেন। তিনি ভাইস-প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগের আবেদন করলেও অবৈধভাবে তাকে প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তিনি এর আগে সাভার মডেল কলেজে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ পাওয়ার সময় ১৯৯৫ এমপিও নীতিমালা বহাল ছিলো। সে নীতিমালা অনুসারে, প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগ পেতে ভাইস-প্রিন্সিপাল, সহকারী অধ্যাপক বা উচ্চমাধ্যমিক কলেজের প্রিন্সিপাল পদে তিন বছরের অভিজ্ঞতা থাকার কথা থাকলেও তা ছিলো না ইসতারুল হকের। বিষয়টি ডিআইএ’র তদন্তেও প্রমাণিত হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনে ডিআইএ বলছে, প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা না থাকায় তার নিয়োগ বিধিসম্মত হয়নি। প্রিন্সিপাল তদন্ত কর্মকর্তাদের পর্যাপ্ত তথ্য দেননি। ডিআইএ বলছে, তদন্ত কাজে অসহযোগিতা অভিযোগের সত্যতা নির্দেশ করে।
শিক্ষকদের অভিযোগ বর্তমান ভাইস-প্রিন্সিপাল মো. রায়হানুল ইসলাম সিনিয়র শিক্ষক না হলেও ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত অবৈধভাবে ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেছেন। তার সময় এক শিক্ষককের অবৈধভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আর পরে প্রিন্সিপাল ইসতারুল হক মোল্লা তাকে প্রশাসনিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে পদোন্নতি দিয়েছেন। মোস্তফা সিরা রোজদী নামের ওই প্রদর্শক ১৯৯৪ সালে যোগদান করলেও তার নিয়োগ অনুমোদন হয়েছে ১৯৯৯ সালে। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মোস্তফা সিরা রোজদীর নিয়োগ যথাযথ হয়নি। জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালায় প্রদর্শকদের পদোন্নতির সুযোগ না থাকলেও তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। প্রদর্শক মোস্তফা সিরা রোজদীকে সহাযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দিয়ে ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করেছেন প্রিন্সিপাল ইসতারুল হক মোল্লা।
এছাড়া মাহফুজা খানম ও ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ২০১০ সালে কলেজকে দুই লাখ টাকা প্রদান করে। অভিযোগ রয়েছে- এই টাকা তারা বৃত্তিপ্রদানের শর্তে কলেজকে দিয়েছেন। কিন্তু বিগত ১০ বছরেও কোন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান না করে এবং ব্যাংকে গচ্ছিত না রেখে প্রিন্সিপাল ও ভাইস-প্রিন্সিপাল উক্ত টাকা নয়-ছয় করেছেন। তবে অভিযুক্তরা বলেন, ১ লাখ টাকার বই কেনা হয়েছে এবং বাকী ১ লাখ টাকা এফডিআর করা হয়েছে। তবে তদন্ত কমিটি এফডিআর করার বিষয়ে কোন ডকুমেন্ট পায়নি, বই কেনার জন্য এক লাখ টাকা ক্যাশ বইয়ে আয় অথবা ব্যয়ের কোন বিবরণ নেই। বই কেনার স্বপক্ষে কোন রেকর্ড প্রদর্শন করা হয়নি। ফলে এক লাখ টাকা আত্মসাৎ হিসেবে গণ্য হবে বলে মন্তব্য করেছে তদন্ত কমিটি।
করোনাকালে শিক্ষক-কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিল থেকে কোন অনুমোদন ছাড়াই অবৈধভাবে ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা উত্তোলন করেন কলেজটির প্রিন্সিপাল। যা এখনো সেই ফান্ডে ফেরত দেয়া হয়নি। ২০১৯-২০১৯ অর্থবছরে শিক্ষা সফর না করেই ইসতারুল হক মোল্লা ও রায়হানুল ইসলাম ৫টি বিভাগের চেয়ারম্যানের স্বাক্ষর নিয়ে প্রায় তিন লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন। প্রিন্সিপাল তথ্য-প্রযুক্তি সেবার নামে কলেজের আয়-ব্যয় সংরক্ষণ, শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের বার্তা প্রেরণ, কলেজের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় পরীক্ষার ফলাফল সংরক্ষণ ও প্রকাশের জন্য শিক্ষার্থী প্রতি প্রতিমাসে ১৫ টাকা করে নিয়ে এই খাত থেকে আনুমানিক ৬ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে যে বোর্ড ফি নেয়া হয়েছিল তা পরীক্ষা না হওয়ার কারণে (অটো পাস) বোর্ড কলেজকে ফেরত দিয়ে দেয় এবং তা শিক্ষার্থীদের ফেরত দেয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ তা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ফেরত প্রদান করেনি। টেন্ডারবিহীন উন্নয়ন ব্যয়ের অনিয়ম এবং সরকারের প্রায় ৮ লাখ টাকা কর ও ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছেন। যা তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে।
কলেজের অপ্যায়ন খাতে ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে ৭ বছরে ৮ লাখ ১৯ হাজার ৬৮১ টাকা ব্যয় দেখিয়েছেন, আর ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছেন ৬১ হাজার ৪৭৬ টাকা। একইভাবে প্রিন্সিপাল ও ভাইস-প্রিন্সিপাল শিক্ষা বোর্ড, ডিজি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কাজ অনলাইনে করলেও যাতায়াতের নামে সাড়ে ১৪ লাখ টাকার বিল ভাউচার দেখিয়ে অর্থ উত্তোলন করেছেন। কলেজের অন্যান্য খাত নামে একটি ভিন্ন খাতে ১৪ লাখ ১৩ হাজার টাকা ব্যয় ও ২ লাখ ১২ হাজার টাকার ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হয়েছে। তদন্ত কালে এর স্বপক্ষে কোন যুক্তি ও প্রমাণই দেখাতে পারেননি প্রিন্সিপাল।
এছাড়াও তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের সপ্তাহে ছয় কর্মদিবসের মধে দুই দিন কলেজে উপস্থিতির বিষয়ে লিখিত বেআইনি আদেশ দিয়েছেন প্রিন্সিপাল ও ভাইস-প্রিন্সিপাল। এ আদেশ দেয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। অনুমোদন না থাকলেও রাজধানীর জুরাইনে একটি অবৈধ ক্যাম্পাস পরিচালনা করছেন তারা। সেখানে একজন প্রদর্শক ইনচার্জের দায়িত্ব আছেন। নিবন্ধনহীন শিক্ষককে বিধি লঙ্ঘন করে ফুল টাইম শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন অধ্যক্ষ। প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকলে কোন ব্যক্তিকে শর্তাধীনে নিয়োগ দেয়ার জন্য প্যানেল তৈরি বা নিয়োগ দেয়া নিয়োগ বিধি পরিপন্থি বলছে ডিআইএ।
ডিআইএর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজ্ঞান বিভাগের এমপিওভুক্ত ২জন সহকারী অধ্যাপককে ক্লাস থেকে প্রায় অব্যাহতি দিয়ে তাদের জায়গায় ২ জন প্রক্সি শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে বন্ধুদের পুরস্কৃত করেছেন তারা। যা অমার্জনীয় প্রশাসনিক অপরাধ ও আর্থিক দুর্নীতি বলে মনে করছে ডিআইএ। প্রয়োজন ছাড়া এ ধরনের পার্টটাইম শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির গভর্নিং বডিতে ভাইস-প্রিন্সিপালের অংশগ্রহণের বিধান না থাকলেও প্রিন্সিপাল ভাইস-প্রিন্সিপাল মো. রায়হানু ইসলাম গভর্নিং বডির সভায় অবৈধভাবে যোগদান করেন।
ডিআইএ বলছে, প্রতিষ্ঠান প্রধান টেলিফোন নীতিমালা অনুযায়ী ১ হাজার ৫০০ টাকা হারে মোবাইল ভাতা প্রাপ্য হলেও প্রিন্সিপাল নিয়েছেন ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকার বেশি। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া টাকায় বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন প্রিন্সিপাল। ছাপা, মনিহারী, ফটোকপি ও কম্পোজ খাতে আত্মসাৎকৃত প্রচুর অর্থ সমন্বয় করা হয়েছে। ছাপা, মনিহারী, ফটোকপি ও কম্পোজ খাতে তিন বছরে ১০ লাখ ২৯ হাজার টাকা ব্যয়ে দেখানো হয়েছে।
মানবেতর জীবন-যাপন করছেন বরখাস্ত শিক্ষকরা: আর কে চৌধুরী কলেজের প্রিন্সিপাল ও ভাইস-প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ করায় অভিযোগকারী তিন শিক্ষককে গতবছরের ৩১ অক্টোবর সাময়িক বরখাস্ত করেছেন প্রিন্সিপাল মো. ইসতারুল হক মোল্লা। যা কার্যকর হয়েছে ১ নভেম্বর। বহিষ্কৃত শিক্ষকরা অভিযোগ করে বলেন, তাদেরকে অন্যায় ও বিধিবহির্ভূতভাবে বহিষ্কার করা হলেও সরকারের বিভিন্ন মহলে ধর্না দিয়েও কোন প্রতিকার পাচ্ছে না। তারা এখন মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। অথচ প্রিন্সিপাল ও ভাইস-প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে ৩০টি অভিযোগ প্রমাণিত হলেও তারা এখনো স্বপদে বহাল তবিয়তে আছেন। গভর্নিং বডি কিংবা শিক্ষা মন্ত্রণালয় কেউ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না।
বহিষ্কৃত শিক্ষকরা আরো বলেন, বেসরকারি কলেজ চাকরিবিধি অনুযায়ী তদন্ত চলাকালীন সময়ে অভিযুক্ত শিক্ষক তার মূল বেতনের ৫০ শতাংশ জীবন ধারণের ভাতা পাবেন। এছাড়া ৬০ দিনের মধ্যে যদি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয় তাহলে ৬০ দিন পর পূর্ণ বেতন পাবেন। অথচ ১২০ দিন অতিবাহিত হলেও তাদের আংশিক বেতন দেয়া হচ্ছে।
এবিষয়ে জানতে চাইলে কলেজের প্রিন্সিপাল মো. ইসতারুল হক মোল্লা বলেন, তদন্ত কমিটির কাছে আমি যে তথ্য-উপাত্য, ডকুমেন্ট উপস্থাপন করেছি তা প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়নি। তারপরও তারা ব্রডশীট জবাব দেয়ার জন্য সময় দিয়েছে। আমরা জবাবগুলো তৈরি করছি। আশা করি জবাব দেয়ার পর প্রকৃত সত্য প্রমাণিত হবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন