রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় তিনতলা একটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছে অর্ধশতাধিক। বিস্ফোরণে উড়ে গেছে ভবনের দেওয়াল ও দরজা-জানালা। বিস্ফোরণের পরপরই ভবনটিতে আগুন ধরে যায়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৪টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। গতকাল রোববার সকালে ঢাকা কলেজের উল্টো দিকের ওই ভবনে এ ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের পর ওই ভবনের সামনের সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ভবনটির নিচতলায় হোটেল, দোতলায় সেলুন ও প্যান্টের দোকান রয়েছে। তৃতীয় তলায় ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। আহতদের মধ্যে ১৫জনকে ঢামেকে ভর্তি করা হয়েছে।
ঘটনার পরপরই পুলিশের বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট ও নিউমার্কেট থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছায় এবং ওই ভবনের জায়গাটি ঘিরে রাখে। ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে সেনাবাহিনীর কেমিক্যাল ডিজাস্টার রেসপন্স টিম (সিডিআরটি) ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের দুটি পৃথক দল ঘটনাস্থলে যায় এবং তারা আলামত সংগ্রহ করে। অত্যাধুনিক সরঞ্জামের সংযোজনে বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে কাজ করে দুটি টিম।
ভবনে উপস্থিত নিউ জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডের মালিক আকরাম হোসেন বলেন, বিস্ফোরণে নিহতরা হলেন-আব্দুল মান্নাম, তুষার ও শফিকুজ্জামান শফিক। নিহতরা সবাই নিউ জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেডে কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যে দুজন কম্পিউটার অপারেটর এবং একজন অফিস সহকারী ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সকাল ১০টা ৫০ মিনিটের দিকে ভবনের তিনতলায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ভবনটির তৃতীয়তলায় ফিনিক্স ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের অফিসে মূলত বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বিস্ফোরণের তীব্রতা এমনই ছিল যে, পাশের একটি ১৪তলা আবাসিক ভবন কেঁপে ওঠে। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন ভবনটির বাসিন্দারা।
ভবনটির সিকিউরিটি গার্ড আব্দুল কাদির বলেন, বিস্ফোরণের সময় ভবনের গেটে বসেছিলাম। বিস্ফোরণের তীব্রতা এমনই ছিল যে, ভবনসহ আমার চেয়ার কেঁপে ওঠে। এত পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়। এর কিছুক্ষণ পরই ভবনের বাসিন্দারা আতঙ্কিত হয়ে নিচে নামতে থাকেন। পরে বের হয়ে দেখি তিনতলা ভবনটির সামনে মানুষজন পড়ে আছে এবং সব কিছু ভেঙেচুরে গেছে।
বিস্ফোরণের তীব্রতায় আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন ভবনটির পাশের মার্কেট প্রিয়াঙ্গনের শপিং সেন্টারের দোকানিরা। সেখানে দোকানি সানাউল্লাহ বলেন, আমি মার্কেটে বসে নাশতা করছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দে চারদিকে কেঁপে ওঠে। দৌড়ে মার্কেটের ভেতর থেকে বের হই। বের হয়ে দেখি শিরিন ম্যানশনের তিনতলা উড়ে গেছে। নিচে ৪ থেকে ৫ জন মানুষ পড়ে আছে। তাদের মধ্যে তিনজনকে দেখে মনে হয়েছে ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। পরে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাই। এখনও মাথার মধ্যে বিকট শব্দ ঘুরছে।
অন্যদিকে, ঘটনার পর ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের চারটি ইউনিট বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্ট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর ঘটনাস্থলে একে একে আসে সিটিটিসির বোম ডিস্পোজাল ইউনিট, সিআইডির ক্রাইম সিন, পিবিআইসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার লোকজন। তারা প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরণের কারণ জানার জন্য চেষ্টা করছেন। তদন্তকারী দলগুলো বলছে বিস্ফোরণের তীব্রতা অনেক ছিল। তবে, এটি দুর্ঘটনা, নাশকতার কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বলেন, সায়েন্সল্যাব এলাকার ভবনে বিস্ফোরণের ঘটনা নাশকতা নয়, এটি একটি দুর্ঘটনা। বিস্ফোরণের ঘটনাটি বিভিন্ন কারণে ঘটতে পারে। সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তে আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তদন্ত কমিটি ফায়ার সার্ভিস এবং ঘটনাস্থলে কাজ করা এক্সপার্টদের ওপিনিয়ন (মতামত) নেবেন। পরে তারা একটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবেন। প্রাথমিকভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মনে হচ্ছে এটি নাশকতা নয়, দুর্ঘটনা থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। বিশেষজ্ঞরা কাজ করছেন।
ঘটনাস্থলে স্প্রিন্টার, বিস্ফোরক বা নাশকতার কোনো আলামত মিলেছে কি না জানতে চাইলে কমিশনার বলেন, এখনো বিস্ফোরক বা স্প্রিন্টার জাতীয় কোনো আলামত পাওয়া যায়নি।
শিরিন ম্যানশনের তৃতীয় তলায় বিস্ফোরণের ঘটনায় বিস্ফোরক কোনো দ্রব্যের আলামত পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর ৫৭ ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানির কমাডিং অফিসার মেজর মো. কায়সার বারী।
তিনি বলেন, আমরা মূলত সেনাবাহিনীর বোম ডিস্পোজাল ইউনিটের সদস্য। আমরা প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরক শনাক্তকরণ যন্ত্রণ দিয়ে ঘটনাস্থলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছি। প্রাথমিকভাবে পর্যবেক্ষণের পরে আমরা বুঝতে পারি এ বিস্ফোরণের ঘটনায় বিস্ফোরকের মাধ্যমে সংঘটিত হয়নি। যদি বিস্ফোরণের ঘটনায় কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহার করা হতো তাহলে আমাদের যন্ত্রের মাধ্যমে বুঝতে পারতাম।
তিনি বলেন, যেহেতু আমরা প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরক ব্যবহারের কোনো আলামত পাইনি সেহেতু আরও তদন্ত শেষে পরবর্তীতে জানা যাবে বিস্ফোরণটি আসলে কেন ঘটেছে।
প্রাথমিকভাবে কি মনে হচ্ছে, বিস্ফোরণটি কেন সংগঠিত হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা যেকোনো ধরনের বিস্ফোরণ হতে পারে। তবে প্রকৃত কারণ জানার জন্য আমাদের আরও তদন্ত করতে হবে। আমরা যেহতু বিস্ফোরক শনাক্ত করি আমাদের যন্ত্র দিয়ে, তাই প্রাথমিকভাবে আমরা বলতে পারি এখানে বিস্ফোরকের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। এখানে বারুদ বা আইইডি ব্যবহারের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। বিস্ফোরণের আসল কারণ আরও তদন্ত শেষে পরে জানা যাবে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) ড. খ মহিদ উদ্দিন বলেন, প্রাথমিকভাবে বিস্ফোরণের কারণ বলা যাচ্ছে না। ধারণা করা হচ্ছে, চারটি কারণে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটতে পারে। একটি হলো শর্টসার্কিট, জমে থাকা গ্যাস বিস্ফোরণ, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও এসি বিস্ফোরণও হতে পারে। তবে, এ মুহূর্তে সঠিক কারণ বলা যাচ্ছে না। তদন্ত শেষে সঠিক কারণ জানা যাবে।
ঘটনাস্থলের তিনতলা ভবনের নিচতলায় ক্যাফে ধানমন্ডি নামে হোটেলের কর্মচারী ওমর ফারুক জানান, ঘটনার সময় তিনিসহ হোটেল কর্মচারীরা ছিল ১২জন। এছাড়া কাস্টমাররা নাস্তা করতে ছিল বেশ কয়েকজন। হঠাৎ সকাল সাড়ে ১০টার পরে ভয়াবহ আওয়াজ করে বিস্ফোরণ। উপর থেকে দৈত্য দানবের মতো কি জানি পড়ার শব্দ পেলাম। এরই মধ্যে আর্তনাদ চিৎকার মনে হয়েছে ভবনের নিচে চাপা পড়েছি। তারপরে আমিসহ অন্যান্যরা কিভাবে বের হয়েছি এটা বলতে পারি না। তবে এতটুকু বলতে পারি কয়েকজন পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়েছিলাম।
৪ ঘণ্টা পর সড়ক স্বাভাবিক : ভবনে বিস্ফোরণের পর বন্ধ হয়ে যায় মিরপুর-সায়েন্সল্যাব-নিউমার্কেট সড়ক। প্রায় তিন ঘণ্টা পর সড়কে শুরু হয় যান চলাচল। সকাল সাড়ে ১০টায় বিস্ফোরণের পর বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সড়ক স্বাভাবিক হয়েছে। এরপর শুরু হয় সব ধরনের যান চলাচল। ফলে প্রায় চার ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর সড়ক স্বাভাবিক হলেও তীব্র যানজট ছড়িয়েছে পুরো রাজধানীতে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। বিকেল ৪টার দিকে দেখা গেছে, রাজধানীর সায়েন্সল্যাব, ধানমন্ডি, নিউমার্কেট ও আজিমপুর সড়কে ধীরগতিতে যানবাহন চলছে।
জানতে চাইলে নিউমার্কেট থানার ওসি শফিকুল গণি সাবু বলেন, বিস্ফোরণের পর সড়ক দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। ৪ ঘণ্টা পর সড়ক স্বাভাবিক হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন