দেশের উত্তরাঞ্চলে রেলে যাত্রীদের মধ্যে একটি প্রবাদ চালু ছিল ‘স্যার ৯টার গাড়ি কয়টায় যায়?’ রংপুর-লালমনিরহাট-বগুড়া রুটের লোকাল ট্রেনগুলো প্রতিদিন দুই থেকে চার ঘন্টা পর্যন্ত বিলম্ব করায় যাত্রীদের মধ্যে এই প্রবাদ চালু হয়। মূলত রংপুরের পীরগাছার ক্ষেতমজুরগণ ধান কাটার সময় বগুড়ায় কাজ করতে যান। তাদের একজন পীরগাছা থেকে বগুড়ার সোনাতোলা স্টেশনের টিকেট কাটার পর স্টেশন মাস্টারকে এই প্রশ্ন করেন। অতপর প্রবাদটি সবার মুখে মুখে ভাইরাল হয়ে যায়।
ওই সব লোকাল ট্রেন এখন আর তেমন চলাচল করে না। কিন্তু সেই ট্রেনের অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা চর্চা এখন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে হচ্ছে। বিশ্বের আরো অসংখ্য উড়োজাহাজের মতো আকাশ পথে বিমানও বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে। অন্যান্য দেশ ও কোম্পানির উড়োজাহাজের মতো বাংলাদেশ বিমানের চলাচলে ‘টাইম ফ্রেম’ প্রায়ই ঠিক থাকছে না। আকাশ পথে উড়োজাহাজ চলাচলে ‘নির্ধারিত সময়ে উড্ডয়ন’ এবং ‘যথারীতি সময়ে অবতরণের’ কথা থাকলেও বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমানে সেটা খুব কমই দেখা যায়। শুধু তাই নয় বিশ্বের অন্যান্য উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলো ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য যাত্রীদের ‘নতুন নতুন সার্ভিস’ দিলেও বাংলাদেশ বিমানে তেমনটা দেখা যায় না। বরং দায়িত্বহীনতা, অনিয়ম, দুই নম্বরি যেন বিমানের নিয়মে পরিণত হয়েছে। ডলার সংকটের মধ্যেও এবার পাকিস্তান ও ভারত থেকে হজযাত্রীদের জন্য উড়োজাহাজ ভাড়া বাংলাদেশী টাকায় সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা করা হয়েছে। অথচ বিমান এয়ারলাইন্স ও সউদী এয়ারলাইন্স সিন্ডিকেট করে বাংলাদেশের হজযাত্রীদের ভাড়া প্রায় দুই লাখ টাকা করেছেন। ফলে এক বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েও অনেক হজগমনেচ্ছু হজে যেতে পারছেন না।
পৃথিবীতে এখন শত শত বিমান কোম্পানির উড়োজাহাজ আকাশ পথে যাত্রী আনা-নেয়ার ব্যবসা করছে। সেবার মান বৃদ্ধি করে ওই সব কোম্পানি ব্যবসা বাড়াচ্ছে এবং লাভবান হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের মর্যাদাও বাড়াচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের পতাকা বহনকারী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স প্রতিযোগিতায় শুধু পিছিয়েই পড়ছে না বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকেও ডুবাচ্ছে। সারাবিশ্বে উড়োজাহাজ যাত্রী এবং মালামাল বহন করে থাকে। যে উড়োজাহাজ যাত্রী বহন করে সেগুলো নির্ধারিত সময়ে উঠানামা এবং যাত্রীদের সেবা অপরিহার্য। এটা না হলে ওই উড়োজাহাজ যাত্রী বহন প্রতিযোগিতায় বেশিদিন টিকতে পারবে না। কিন্তু বাংলাদেশ বিমান ব্যবসা দূরের কথা প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে শুধু দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অযোগ্য লোকদের দায়িত্বে বসানোয়। অনুসন্ধান করে দেখা যায়, বাংলাদেশের ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট থেকে বিশ্বের বিভিন্ন রুটে যাতায়াত করা উড়োজাহাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম বিমানে হয়ে থাকে। যাত্রী সেবায় কর্ণপাত নেই, নির্ধারিত সময়সীমার কোনো বালাই নেই। কিছু অযোগ্য ব্যাক্তির ইচ্ছামাফিক চলছে রাষ্ট্রের এই গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। টিকেট কাটতে গেলে টিকেট পাওয়া যায় না; অথচ প্রায়ই সিট ফাঁকা রেখে চলাচল করে বিমান।
লোকসানি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিমানে শত শত কর্মর্কতা কর্মচারী। কিন্তু যাত্রীসেবা বলে কিছু নেই। দেশের অর্থনীতির চাকা যাদের পাঠানো অর্থে সচল থাকে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ বাড়ে; সেই প্রবাসীদেরই বিদেশ যাতায়াতে বিমান এবং বিমানবন্দরে হয়রানি করা হচ্ছে যাচ্ছেতাইভাবে। শুধু বিদেশ ফেরত যাত্রীই নন, বিদেশ গমনের ক্ষেত্রেও যাত্রীরা নাস্তানাবুদ হচ্ছেন বিভিন্ন টেবিলে। সেবা নিতে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় দীর্ঘ সময়। প্রবাসী শ্রমিক যাত্রীদের সঙ্গে বিমান কর্মকর্তা ও ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের আচরণ খুবই খারাপ। প্রবাসী শ্রমিকদের বিমানের তথাকথিত শিক্ষিত কর্মকর্তারা ‘মানুষ’ মনে করেন না। তাই জন্তু-জানোয়ারের মতো ব্যবস্থা করেন।
একজন প্রবাসী শ্রমিক জানালেন তিনি বিদেশ থেকে বিমানে দেশে ফেরার পর তাকে প্রথমেই প্রশ্ন করা হয় ‘পাসপোর্ট কই, ফরম পূরণ করেছিস? দেখি’। ‘এত কাটাছেঁড়া কেন, এটা হবে না। আবার লিখে নিয়ে আয়।’ ধমক আর তুই-তোকারি করে পাসপোর্টে সিল মারেন ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা। তার পর কাস্টমস ও পুলিশের কয়েকজনের ‘লাগেজে সোনা আছে, ব্যাগে কী কী এনেছিস, কত দিন ধরে বিদেশে থাকিস, বিদেশি টাকা কত আছে, বখশিস কত দিবি’ এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি করে এবং কিছু বকশিস দিয়ে পরিত্রাণ পেতে হয়।
বাংলাদেশের কিছু উপর তলার মানুষ বিদেশে টাকা পাচার করলেও সাধারণ মানুষের দেশপ্রেমে ঘাটতি নেই। বিভিন্ন কোম্পানির উড়োজাহাজ ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থেকে চলাচল করলেও অনেকেই ‘দেশের টাকা দেশে রাখতে’ বিমানে বিদেশ যাতায়াতে অভ্যস্ত। যাত্রীসেবা নিম্নমানের হলেও তারা বিমানে টিকেট কাটেন। আর প্রবাসী শ্রমিকদের বেশির ভাগই গরীব ও অশিক্ষিত হওয়ায় তারাও বাংলাদেশ বিমানে যাতায়াত করে থাকেন। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিমানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও দুর্নীতির কারণে বিমানে যাতায়াত কমিয়ে দিচ্ছেন মানুষ।
সাম্প্রতিক ঘটনা। দেশের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর যাবেন। বিমানের টিকেট কেটেছেন এবং ২ মার্চ যথারীতি বিমান ছাড়ার দু’তিন ঘন্টা আগে শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছেন। ভিআইপি হওয়ায় তিনি ভিআইপি লবি ব্যবহার করেন। বিমানবন্দরে ডিজিটাল মনিটরে দেখানো হচ্ছে বিমান ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুরের উদ্দেশ্যে ছাড়বে রাত ১১ টা ৩০ মিনিট। যথারীতি যাত্রীদের উড়োজাহাজে উঠানো হলো। কিন্তু নির্ধারিত সময় সাড়ে ১১টায় উড়োহাজাজ ছাড়ে না। অতপর জানানো হলো বিমান ছাড়বে সাড়ে ১২ টায়। সাড়ে ১২টায় উড়ছে না বিমান। তিনি (স্বনামধন্য ব্যাক্তিত্ব যাত্রী) দেখলেন পাশের কয়েকটি সিটে বসে রয়েছেন শুকনোমুখের বিধ্বস্ত কয়েকজন মানুষ। দীর্ঘ সময় ধরে তাদের খাওয়া হয়নি মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। তিনি ওই যাত্রীদের পরিচয় এবং কোথায় যাচ্ছেন জানতে চান। যাত্রীরা জানালেন পঞ্চগড়ে বাড়ি কাজ করতে বিদেশ যাচ্ছেন। পথে যানজট হতে পারে আশঙ্কায় তারা পঞ্চগড় থেকে ১ মার্চ রওয়ানা দিয়েছেন ঢাকা অভিমুখে। পথে যথারীতি যানজটে পড়েছেন। দু’দিন ভাত খাওয়া হয়নি। গরীব মানুষ ভাত খাওয়ার পয়সা না থাকায় এটাসেটা খেয়ে ক্ষুধা নিবারনের চেষ্টা করেছেন। বিমান ছাড়ার ৬ ঘন্টা আগে শাহজালাল বিমানবন্দরে এসেছেন। ইমিগ্রেশনের পর দীর্ঘ সময় ভিতরেই ছিলেন। কিন্তু পকেটে টাকা না থাকায় কিছুই কিনে খেতে পারেননি। বিমানবন্দরে সহযাত্রীরা বলেছিল বিমানে উঠলেই খাবার দেয়া হবে। অথচ বিমানে যাত্রী ওঠার পরও ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কুয়ালালামপুরগামী বিমান বাংলাদেশের উড়োজাহাজ। অন্যান্য যাত্রীরা ধৈয্যহারা হয়ে খোঁজ খবর নেয়ার চেষ্টা করছেন বিমান ছাড়তে বিলম্বের কারণ। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা লা পাত্তা। যারা রয়েছেন তারা কেউ বিমানের বিলম্বের খবর দিতে পারছে না। বিমানের কর্মকর্তাদের খুঁজে না পাওয়ায় যাত্রীরা অসহায় হয়ে পড়েন। রাত একটার সময় হঠাৎ দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এসে যাত্রীদের জানান আজ বিমান যাবে না। কাল দুপুরে বিমান ছাড়বে। যাত্রীদের হোটেলে নেয়া হবে। পঞ্চগড় থেকে আসা যাত্রীদের বিমান থেকে নামিয়ে হোটেলে নেয়া হলেও স্বনামধন্য ওই ব্যাক্তি বিমান থেকে নেমে নিজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। কিন্তু তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে পঞ্চগড় থেকে বিদেশে কাজের জন্য যাওয়া প্রবাসী শ্রমিকদের পিপাসার্ত ক্ষুধার্ত মুখ। তাদের কি খেতে দেয়া হয়েছে? কিছুদিন আগে আমি নিজেও বিমান বাংলাদেশের অব্যবস্থাপনা মুখোমুখি হয়েছি। একমাত্র সন্তান উচ্চশিক্ষায় বিদেশ যাবে। বিমানের টিকেট কেটেছি ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দর। যথারীতি বিমান ছাড়তে দুই ঘন্টা বিলম্ব; অতপর ঢাকা থেকে ছেড়ে সিলেট নিয়ে বিমান বসে রাখা হয়। দেড় ঘন্টা পর সেখান থেকে হিথ্রোর উদ্দেশ্যে বিমান রওয়ানা দেয়। এই যে ঢাকা থেকে হিথ্রোর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে সিলেটে গেল, বিমানে কোনো ঘোষণা দেয়া হয়নি।
সারাবিশ্বের রাষ্ট্রীয় ও ব্যাক্তিমালিনাধীন উড়োজাহাজ কোম্পানিগুলো যাত্রী সেবা নিশ্চিত করে একদিকে ব্যবসা বাড়াচ্ছে; অন্যদিকে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করছে। কখনো আবহাওয়াজনিত কারণ, যান্ত্রিক ত্রুটি এবং অন্যান্য কারণে উড়োজাহাজ ছাড়া বিলম্ব হলে তা এসএমএস, ই-মেইলের মাধ্যমে যাত্রীদের জানিয়ে দেয়া হয়। যাত্রীরা যাতে সেবা পান এবং কোম্পানির ওপর রুষ্ট না হন সে জন্য আরো অনেকভাবে যাত্রীদের পরিসেবা দেয়া হয়। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিমান। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি ঘুষ, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, টিকেট কালোবাজারী, অযোগ্য লোকজনকে নিয়োগ নিয়মে পরিণত হয়েছে। এক সময়ের উত্তরাঞ্চলের রেলের সার্ভিস নিয়ে ‘স্যার ৯টার গাড়ি কয়টায় যায়’ প্রবাদের মতো হয়েছে বিমানের সময়জ্ঞান ও যাত্রীসেবা। ‘রাত ৯টার বিমান কয়টায় ছাড়ে!’ বিমানের উড়োহাজাজ যে দেশেই যাক বাংলাদেশের পতাকা বহন করে থাকে। সেই বিমান দেশের ভাবমর্যাদাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? বিগত শতকের সত্তুর দশকে ক্লাসের বাংলা বইয়ে নদীর রচনায় পড়েছিলাম সুরমা নদীর আত্মকাহিনী। গল্পটি এমন ছিল, ‘আমার নাম সুরমা। কিন্তু আমি চোখে দেখার সুরমা নই। আমি একটি নদী।’ এখন যদি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে আত্মজীবনীমূলক রচনা লিখতে দেয়া হয় তাহলে তারা লিখবে; ‘আমার নাম বিমান, আমি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। সারাবিশ্বের এয়ালাইন্সগুলো দেশের ভাবমর্যাদা বৃদ্ধি ও ব্যবসার প্রসারে যথাযথ সময়ে আকাশে এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলাচল করে, যাত্রীসেবা দেয়; কিন্তু আমার যাত্রীসেবার প্রয়োজন হয় না। আমার ওপর চড়ে ভ্রমণ করতে চাইলে টিকেট কাটা থেকে শুরু করে সবখানে ভোগান্তির মানসিকতা থাকতে হবে।’ ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন