নির্ধারিত অপারেটরের অনুপস্থিতিতে অদক্ষ লোক দিয়েই চলছিল সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্ট। আর এ কারণেই সর্বনাশ ঘটেছে বলে ধারণা তদন্ত কমিটির। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিকো অক্সিজেন লিমিটেড প্ল্যান্টটি শুরু থেকেই অনিয়মের মধ্যে চলছিল। সেখানে ছিল না ফায়ার সেফটি, পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিস্ফোরক অধিদপ্তরের যথাযথ সনদ। এমনকি বিদ্যুৎ ব্যবহারের লাইসেন্স এবং বয়লারেরও ছিল না কোন অনুমোদন। কারখানার ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারি কল-কারখানা পরিদর্শক অধিদপ্তরের আপত্তিও ছিল। কোনকিছুরই তোয়াক্কা করেনি প্রতিষ্ঠানটি। কারখানাটি মূলত বাতাস থেকে অক্সিজেন তৈরি করে। দুর্ঘটনার পর বলা হচ্ছে, আসলে হাওয়ার উপরেই চলছিল সীমা অক্সিজেন।
আর নানা অনিয়মের পরও প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সরকারি কোন সংস্থায় কার্যকর কোন ব্যবস্থা নেয়নি। আর এ কারণেই গত শনিবার সেখানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিস্ফোরণের সাথে সাথে কারখানাটিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। দুর্ঘটনার দিন প্রাণ হারায় ছয়জন। রোববার রাতে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও একজনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা সাতে দাঁড়ালো। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরো ১৭জন। ভয়াবহ বিস্ফোরণে অক্সিজেন কারখানা ছাড়াও আশপাশের বেশ কয়েকটি কল-কারখানা ও বসতবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। রীতিমত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় আশপাশের বিশাল এলাকা। ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার তিন দিন পার হলেও দায়ীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত থানায় কোন মামলাও হয়নি।
এদিকে এতদিন নানা অনিয়মের পরও যেসব সরকারি কর্মকর্তারা নির্বিকার ছিলেন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ব্যাপক হতাহতের পর তারাও এখন সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। গতকাল সোমবার জেলা প্রশাসন আয়োজিত এক সভায় সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের নানা অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার চিত্র তুলে ধরে প্রতিষ্ঠানটির কঠোর সমালোচনা করেন। আর মালিকপক্ষও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সামনে কারখানার সার্বিক অব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরেন। অক্সিজেন তৈরির ওই কারখানাটি মাত্র দুইজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার এবং মানবিক বিভাগ থেকে পাস করা একজন সুপারভাইজার দিয়ে পরিচালনা করার কথা স্বীকার করেন প্রতিষ্ঠানটির এমডি মো. মামুন উদ্দিন।
সার্কিট হাউসে চট্টগ্রাম জেলার ভারী ও মাঝারি শিল্প প্রবণ এলাকার দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য আয়োজিত মতবিনিময় সভায় তিনি এসব তথ্য দেন। সভার শুরুতে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান জানতে চান, কত সাল থেকে সীমা অক্সিকো অক্সিজেন লিমিটেড ব্যবসা করছে? জবাবে এমডি মামুন বলেন, ১৯৯৬ সালে এটা প্রতিষ্ঠিত, আমার বাবা আহমদ শফী প্রতিষ্ঠা করেন। তখন থেকে চালু আছে। সরকারি সব কমপ্লায়েন্স মেনেই কারখানাটা চালু রেখেছি। কী কারণে হঠাৎ করে পরশু দিন বিস্ফোরণ হয়েছে আমরা এখনও বুঝতে পারতেছি না। তদন্ত কমিটি পরিদর্শন করে এসেছে। উনারা তদন্ত করলেই আসল কারণটা বুঝতে পারবেন। তিনি জানান দুর্ঘটনার সময় ১৪-১৫ জন শ্রমিক ছিল। দুইজন অপারেটর ছিল। অ্যাডমিনে দুজন ছিল। একজন সুপারভাইজার ছিল। সব মিলিয়ে ১৯ জন। তবে অনেক পথচারী আহত হয়েছেন। এজন্য হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে।
প্ল্যান্টে ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রেডের অক্সিজেন প্রস্তুত হত। ডিসি ফখরুজ্জামান জানতে চান, আপনাদের ওখানে ইঞ্জিনিয়ার বা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার কেউ আছেন? যারা প্ল্যান্টটি পরিচালনা করেন? জবাবে মামুন বলেন, অপারেটররা ডিপ্লোমা হোল্ডার। উনারা ২৭ বছর ধরে ওই প্ল্যান্টটা চালাচ্ছেন। সেজন্য এক্সপেরিয়েন্স আছে।
কীভাবে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার একটি অক্সিজেন প্ল্যান্ট চালাচ্ছে? জানতে চান জেলা প্রশাসক। মামুন বলেন, এটা তো দুর্ঘটনা। এটাতে কারও হাত নেই। কেন হয়েছে জানি না।
এ সময় ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার মো. সোলায়মান জানতে চান, প্ল্যান্টটি (যন্ত্রপাতি) চীন থেকে ইমপোর্ট করা। ইন্সটলেশনের পর প্রকৌশলীরা আর কখনও এসেছিলেন? আপনারা কীভাবে মাত্র ২ জন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার এবং মানবিক থেকে পাস করা একজন স্টুডেন্ট (সুপারভাইজার) দিয়ে একটা অক্সিজেন প্ল্যান্ট চালাচ্ছেন? জবাবে মামুন উদ্দিন বলেন, চীন থেকে সাপ্লাই দেওয়ার পর কমিশনিং এবং প্রডাকশন পর্যন্ত প্রায় তিন মাস উনারা এখানে ছিলেন। এরপর আরও দুমাস থেকে যারা অপারেটিং করবে, তাদের ট্রেনিং দিয়েছেন। তারপর আর আসেননি। উনারা প্রায় (ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার ও সুপারভাইজার) ২০ বছর ধরে চালাচ্ছিলেন।
এরপর জেলা প্রশাসক বলেন, প্রাথমিকভাবে যতটুকু জেনেছি আপনাদের ওখানে অত্যন্ত অপরিকল্পিতভাবে জিনিসপত্র রেখেছিলেন। অ্যাসেম্বলিং পয়েন্ট, সেফটি প্ল্যান্ট- কিছু ছিল না। আপনাদের বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইসেন্স নেই বলে জানতে পেরেছি। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। বয়লারের অনুমোদন নেই। এমনকি বয়লারে সেফটিও নেই। প্রায় ৩০ বছর ধরে ব্যবসা করছেন, অনেক কাগজপত্রই নেই।
এ সময় সীতাকুণ্ড থানার ওসি মো. তোফায়েল আহমদ বলেন, ঘটনার দিন যার অক্সিজেন কলাম পরিচালনার কথা ছিল, সে অনুপস্থিত ছিল বলে জানতে পেরেছি। অন্য একজনকে দিয়ে সেটি চালানো হচ্ছিল। এভাবে দক্ষ লোকের পরিবর্তে অন্যদের দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালালে কী হয় তা তো দেখাই যাচ্ছে। সাতজনের প্রাণ গেছে। যার গেছে সেই জানে। যাদের সেটা পরিচালনার কথা ছিল, তারা সেখানে ছিল না।
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-মহাপরিদর্শক আবদুল্লাহ আল সাকিব মুবাররাতও মুখ খুলেন। তিনি বলেন, সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টটি আমরা ইতোপূর্বে পরিদর্শন করে অনেক সমস্যা পাই। শুরুতে তাদের মৌখিক নির্দেশনা দিই। পরে ডিসেম্বরে আবার পরিদর্শনে যাই। তখন মালিকপক্ষ তিন মাস সময় চায়। তিন মাস পর চলতি মাসের মাঝামাঝিতে আবার পরিদর্শনের কথা ছিল। কিছু তারা সংশোধন করেছিল। কিন্তু বাকিও ছিল। তাছাড়া তাদের সীমা অটো রি-রোলিং মিলেও আমরা ফল্ট পাই। শ্রম আদালতে মামলা করি। সেখানে সব পরিপূর্ণ করার আশ্বাস দিয়ে তারা আসে।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক বলেন, বিএম কন্টেইনার ডিপোর ঘটনার পর আমরা সীতাকুণ্ডের বিভিন্ন ডিপো পরিদর্শন করি। দিকনির্দেশনা দিই। অনেকে ব্যবস্থাপনা ভালো করেছে। সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টেও আমরা গিয়েছিলাম ২০২২ সালে। তাদের ফায়ার সেফটি প্ল্যান্ট করতে বলেছি। তারা এখনো বাস্তবায়ন করেনি।
বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক এস এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ওখানে কার্বন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেনের সিলিন্ডার ছিল। এসব সিলিন্ডারে তারা অক্সিজেন ফিলিং করে। এর কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। অদক্ষ লোক দ্বারা প্ল্যান্ট পরিচালনা করা হয়। সেফটি ভাল্ব বা চেকআপের কাগজ দেখাতে পারেনি।
এদিকে দুর্ঘটনায় আহত প্রবশ লাল শর্মা (৫৫) নামে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। তার বাড়ি সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী ইউনিয়নে। দুর্ঘটনার পর থেকে তিনি চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন