মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ইসলামী ব্যক্তিত্ব আল্লামা শায়খ মুহাম্মদ হারুন ইসলামাবাদী রহ.

| প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুফতি ইবরাহীম আনোয়ারী : মাওলানা মুহাম্মদ হারুন ইসলামাবাদী বিন ইসমাঈল বিন মাওলানা গোলাম মোস্তফা। তিনি ১৮৩৮ সালে চট্টগ্রামস্থ পটিয়া থানার আশিয়া গ্রামের এক ধার্মিক ও অভিজাত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বড় ভাইদের কাছে বাড়িতে কোরআন মাজিদ শিখেন এবং পটিয়া ভাটিখাইন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত সমাপ্ত করে নিজ গ্রামের মাদরাসা এমদাদুল উলুম আশিয়াতে জামাতে (দাহুম) বেহেশতি জেওর পর্যন্ত পড়েন। এরপর শায়খুল হাদিস আলামা ইসহাক গাজী সাহেবের তত্ত্বাবধানে পটিয়া জমীরিয়া কাছেমুল উলুম মাদরাসায় জামাতে নাহুমে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে পটিয়া মাদরাসায় দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। অতঃপর এখানেই তিনি স্নাতকোত্তর শ্রেণী (তথা ফুনুনাতে আলিয়া) শেষ করেন। তাঁর জ্ঞানার্জনস্পৃহা ছিল অদম্য। তাই উচ্চশিক্ষা লাভের প্রবল আগ্রহ নিয়ে মিসর আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য তদানীন্তন পাকিস্তান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হাবিবুর রহমান সাহেবের মাধ্যমে সকল ব্যবস্থা সম্পন্ন করেন। কিন্তু তৎকালীন মুরুব্বীদের আপত্তির মুখে তিনি কৃত মিসর শিক্ষাসফর ব্যবস্থাপনা সন্তুষ্টচিত্তে বাতিল করে নেন। অতঃপর ১৯৬১ সালে দারুল উলূম দেওবন্দ গিয়ে পুনরায় দাওরায়ে হাদিসে ভর্তি হন। কিন্তু বিশেষ কারণে তিনি সেখান আবার লাহোরের জামিয়া আশরাফিয়ায় গিয়ে দাওরায়ে হাদিস সমাপ্ত করেন। ১৯৬২ সালে লাহোরস্থ জামিয়া মাদানীয়ায় বিশেষ দু’জন দার্শনিক উস্তাদের কাছে ফুনুনাতে আলিয়ার উচ্চতর ডিগ্রি লাভ করেন।
শিক্ষা-দীক্ষা ও আধ্যাত্মিক জীবনে তিনি প্রথমে আলহাজ মাওলানা শাহ্ মুহাম্মদ ইউনুছ আবদুল জব্বার (রহ.)-এর নিকট আধ্যাত্মিকতা লাভ করেন। তাঁর ইন্তিকালের পর হজরত থানভী (রহ.)-এর সর্বশেষ খলিফা, মাওলানা শাহ্ আবরারুল হক সাহেবের প্রতি তিনি রুজু হন। ১৯৬৩ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তিনি আযীযউদ্দিন লিমিটেডের অন্যতম ডাইরেক্টর হাজী বশীর উদ্দীন সাহেবের অর্থানুকূল্যে মাসিক মদিনার সম্পাদক মাওলানা মহিউদ্দিন খানের সান্নিধ্যে বাংলা চর্চা শুরু করেন। পাশাপাশি তিনি তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত একমাত্র উর্দু দৈনিক পাসবান-এ অনুবাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৫-৬৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকা ভ্রমণ করেন। অতঃপর বাংলা ভাষায় উলামাদের জাগরণ সৃষ্টি করে ধর্মদ্রোহীদের মোকাবিলার লক্ষ্যে কয়েকজন বিশিষ্ট মরুব্বীর অভিভাবকত্বে প্রতিষ্ঠিত ঢাকাস্থ মুখপাত্র হাছান আনসারীর মাধ্যমে জামিয়া পটিয়ার তদানীন্তন মুহতামিম হজরত হাজী সাহেব হুজুরের কাছে পৌঁছলে হুজুর তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনে ইসলামী কার্যক্রম অসুবিধার সম্মুখীন হলে ১৯৭২ সালে ঢাকা ত্যাগ করে তিনি চট্টগ্রাম চলে আসেন। চট্টগ্রাম চলে আসার পর বাবুনগর আজিজুল উলুম মাদরাসায় শিক্ষক নিযুক্ত হন। পাশাপাশি হজরত হাজী সাহেব হুজুরের আদেশক্রমে মাসিক আত্-তাওহীদের সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর আবুধাবিতে নিযুক্ত বাংলাদেশী দূত এ.ডব্লিউ. শামশুল আলম সাহেবের তত্ত্বাবধানে আরবি, ইংরেজি, বাংলা অনুবাদকের সরকারি দায়িত্ব লাভ করেন। ১৯৭৭ সালে ১লা মার্চ “সুপ্রিম শরীয়া কোর্ট আবধাবিতে অনুবাদক পদে নিয়োজিত হন। ইতোমধ্যে ইসলামী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের রেজিস্ট্রার্ড খতিব পদে এবং ১৯৮৫ সালে আবুধাবির বেতার ইসলামী ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রয়োজক ও উপস্থাপকের দায়িত্বে নিযুক্ত হন। পরে অনুবাদ-বিভাগীয় প্রধান পদে উন্নীত হন।
১৯৯০ সালে ‘রাবেতা আল আলম আল ইসলামী’র পক্ষ থেকে তাঁকে বাংলাদেশ শাখার পরিচালক পদে নিয়োগ প্রদান করা হয়। তাঁর গুণ-জ্ঞান, কর্মদক্ষতা, দ্বীনদরদ, মুসলিম জাগরণের আন্তরিক অনুভূতি ও কালজয়ী যোগ্যতার সমাহার দেখে হাজী সাহেব হুজুর তার প্রতি পূর্বের চেয়ে আরো বেশি স্নেহশীল ও আস্থাবান হয়ে পড়েন। ফলে তাঁর অন্তরে জেগে ওঠে তাকে পরবর্তী স্থলাভিষিক্ত করার আন্তরিক ইচ্ছা। তাই হাজী সাহেব হুজুর একসময় তাকে বললেন, বাংলাদেশ আসলে পটিয়া মাদরাসাতেই আসতে হবে। এভাবে হাজী সাহেব হুজুরের ইন্তেকালের পর জামিয়ার সকল শিক্ষক ও মজলিশে শুরার সকল সদস্যের সর্বসম্মতিক্রমে তাঁর কাঁধে অর্পিত হয় জামিয়া পটিয়ার প্রধান পরিচালকের গুরু দায়িত্ব। তাঁর কালজয়ী যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, কর্মতৎপরতা, বিদ্বৎসমাজে তাঁর আকুণ্ঠ গ্রহণযোগ্যতা, শাহী পোশাকের ভেতরে লুকায়িত বুজুর্গি, সবকিছুতে ‘ভালো পুরাতন ও উপকারী নতুনের সমন্বয়ধর্মিতা’ ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি জামিয়াকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন নতুন নতুন সফলতার দিকে। জামিয়ার সুষ্ঠু পরিচালনার পাশাপাশি তিনি সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এবং বিশেষ করে জাতীয় নেতৃত্বের ময়দানে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০৩ সালে তিনি প্রকৃত ঠিকানায় ফিরে যান।
তিনি ছিলেন একাধারে একজন তুখোড় মেধাবী ছাত্র, সর্বজনপ্রিয় শিক্ষক, কর্মদক্ষ পরিচালক, বহুভাষাজ্ঞ প্রথিতযশা সাহিত্যিক, শ্রোতামুগ্ধকারী বক্তা, প্রতিভাবান লেখক-অনুবাদক, সচেতন সংগঠক ও রাজনীতিক, চিত্তে-বিত্তে দরিয়া-উদার দানশীল, শরীয়তশোভন সংস্কারে দৃঢ় বিশ্বাসী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি, শাহী পোশাকে আবৃত বুজর্গ-কলব ব্যক্তিত্ব এবং আরো বহু। আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতুল ফিরদাঊস নসীব করুন। Ñআমিন
লেখক :  খতিব-বায়তুল করিম জামে মসজিদ, হালি শহর চট্টগ্রাম

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন