শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ : ইসলামী দৃষ্টিকোণ

| প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

॥ তিন ॥
খতবী শীরনীনী (মৃ. ৯৭৭হি) বলেন, কোচোয়ান এমন কাজ করবে না যা করা তার জন্যে অস্বাভাবিক বলে গণ্য হবে। যেমন কাদার মাঝে তীব্র গতিতে গাড়ি চালানো। ড্রাইভার নিয়মের ব্যত্যয় করার কারণে যদি কারো ক্ষতি হয় তবে ড্রাইভার ক্ষতিপূরণ দেবে। জনসমাবেশে তীব্রগতিতে গাড়ি হাঁকানো কাদার মাঝে তীব্রগতিতে গাড়ি চালানোর মতোই। “মুহাম্মদ বিন মুহাম্মদ খতীব শীরবীনী, মুগনী মুহতাজ (বৈরুপ : দারুল মা‘রিফা ১৪১৮হি.) খ.৪.পৃ.২৭০-২৭১”।
সিগন্যাল অমান্য করা : কোন সন্দেহ নেই, রাস্তায় সিগন্যাল রাখা হয় ক্রসিং পয়েন্টে রাস্তা পরিবর্তন করার সময় গাড়ি নিয়ন্ত্রণের জন্যেই। এই সিগন্যাল দেখে চালক বুঝবে, কখন সে চলবে আর কখন সে থেমে থাকবে। সিগন্যাল এড়িয়ে যাওয়া ট্রাফিক আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন। কারণ, সাধারণ সিগন্যাল অমান্য করা হয় অন্যদের চলা শুরু হওয়ার আগ দ্রুত অতিক্রম করার জন্যে। আর এর অবস্থাতে অন্যপাশ থেকে সবুজ সিগন্যাল পাওয়ার কারণে হঠাৎ কেউ বা কোন গাড়ি অতিক্রম করতে চাইলে অন্য পাশের মানুষ বা গাড়ি সংঘর্ষের সম্মুখীন হয়।
সিগন্যাল অমান্য করার বিষয়ে শায়খ ইবনু উছাইমীন (রহ.) বলেন, “সিগন্যাল অমান্য করা জায়েয নেই। শাসকশ্রেণী যদি কোন সংকেত নির্ধারণ করে চালককে থামতে বলে, আর কোন কোন সংকেত চালককে চলতে বলে, তাহলে এই সংকেতগুলো শাসকের পক্ষ থেকে মৌখিক নির্দেশের মতো। যেন শাসক তাকে বলছে, চলো বা থেমে যাও। আর শাসকের নির্দেম মানা আবশ্যক। অন্য লেনগুলো ফাঁকা থাকুক বা অন্য লেনে এমন কেউ থাকুক যার জন্য লেন ফাঁকা রাখা দরকার, উভয় অবস্থায় বিধান অভিন্ন। “ইবনু উছাইমীন, ফাতাওয়া ও তাওজীহাত ফীল ওয়ার রিহলাত, পৃ.৮০।”
অননুমোদিত স্থানে গাড়ি দাঁড় করানো : দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ, অননুমোদিত স্থানে গাড়ি দাঁড় করানো। যার ফলে চলাচলের রাস্তা বন্ধ হয় অথবা অন্যের উপকার নষ্ট হয় অথবা কোন গাড়ির সামনে দাঁড়ানো, যার ফলে অন্য গাড়িটি বের হতে হলে তার সরে যাওয়ার অপেক্ষা করতে বাধ্য হয়। নিঃসন্দেহে এমনটি করা বিধেয় নয়। পরিস্থিতি, বাস্তবতা ও কষ্টের বিবেচনায় এ আচরণের গোনাহে পার্থক্য হবে।
এ প্রসঙ্গে লক্ষণীয়, হজের সময়ে ভিড়ে অন্যদের কষ্ট না দেয়ার দিকে খেয়াল করে হাজরে আসওয়াদে চুম্বন না করে দূর থেকে ঈশারা করার নির্দেশ দেয় হয়েছে। অথচ বাইতুল্লাহ তাওয়াফের সুন্নত আমল এই চুম্বন। সুতরাং কোন অননুমোদিত বিষয়ে কীভাবে অন্যকে কষ্ট দেয়া জায়েয হতে পারে?
অন্যান্য কারণ : দুর্ঘটনার ঘটার এছাড়া আরো কারণ রয়েছে, যেগুলো থেকে সর্তক হওয়া প্রয়োজন। যেমন তন্দ্রা, খেলনার ছলে “এর আরবী ভাষা তাফহীত। এটি নবআবিষ্কৃৃত বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। এর অর্থ গাড়িকে অবহেলা ভরে চালানো, যা বিকৃত মানসিকতাসম্পন্ন কোন কোন যুবক করে থাকে। ইঞ্জিনে এমনভাবে চাপ দিয়ে রাখে, যে কারণে গাড়ি দ্রুত গতিতে চলতে থাকে, আর গতি থাকে এ পর্যায়ে যে, সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। ফলে তা থেকে কর্কশ আওয়াজ বের হয় এবং মাটির সাথে তীব্রভাবে ঘর্ষণ খায় ও এটি তীব্র গতিতে অন্যান্য গাড়ির দিকে ছুটে যেতে থাকে।” অবহেলার সাথে গাড়ি চালানো এবং গাড়ির ফিটনেসের প্রতি যতœ না নেয়া, বিশেষত গাড়ির ব্রেক ইত্যাদি। এ সবগুলোর প্রত্যেকটিই নির্মম দুর্ঘটনার ঘটার কারণ হয়ে থাকে, যার ফলে বিপুল জানমালের ক্ষতি হয়। এ কারণগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকা চালকের কর্তব্য। এগুলো এড়িয়ে না চললে এর দায় ও গোনাহ চালককেই বহন করতে হবে, যেহেতু তার অবহেলা ও অমনোযোগিতার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
ক্ষতির দায় বহন : ড্রাইভিং থেকে সৃষ্ট সড়ক দুর্ঘটনার দায় বহন সংক্রান্ত আলোচনার পূর্বে ইসলামে দৃষ্টিতে অন্যের ক্ষতি করার বিধান ও এ বিষয়ক মূলনীতি নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। মহান আল্লাহ মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি বলেন : “আর আমি বনী আদমকে মর্যাদা দান করেছি এবং স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি এবং তাদেরকে উত্তম রিজিক দিয়েছি এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি এমন অনেকের উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি”। “আল কুরআন, ১৭:৭০”
এ আয়াতে বর্ণিত পরিভাষা মানুষকে সম্মানিত করার অর্থ হলো, মানুষের জন্যে আল্লাহ এমন বিধান দিয়েছেন, যা তার জীবন ও প্রাণ রক্ষা করবে। পাশাপাশি তার সম্পদ রক্ষা করবে, যেহেতু সম্পদ মানুষের জীবন নির্বাহের মাধ্যম। তদ্রুপ জীবন ও সম্পদে যে কোন অন্যায় হস্তক্ষেপকে অপরাধরূপে গণ্য করেছেন, যা আখেরাতে শাস্তি আর দুনিয়াতে ও বিভিন্ন প্রকার সাজা ও ক্ষতিপূরণ আবশ্যক করে। “ড. আব্দুল আযীয উমর আল খতীব, “মাসউলিয়্যাতু সাই‘কিস সাইয়্যারা ফী দুইল ফিকহিল ইসলামী” মাজাল্লাগু আল আদল, আইন মন্ত্রণালয়, সৌদি আরব, সংখ্যা ৩২, রজব ১৪২৭ হি.পৃ.১৫৩”।
এমন কোন প্রাণ বা সম্পদ নেই, ইসলামে যার কোন মূল্য নেই বা যা নষ্ট হলে কারো কোন দায় নেই এবং কোন ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। এ কারণেই দুটি বিষয়ের সংরক্ষণকে ইসলাম মৌলিক পাঁচটি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত করেছে, যেগুলো সংরক্ষণ শরীয়াহর উদ্দেশ্য তথা মাকাসিদুশ শরীয়াহ হিসেবে গণ্য। “আশশাতিবী, আল মুওয়াফাকাত (কায়রো : দারুল হাদিস, ২০০৬ খ্রি.) খ.পৃ. ১০”। ক্ষতির বিনিময় প্রদানের আওতায় প্রাণহানির ক্ষতির বিনিময়ও অন্তর্ভুক্ত। যার কিছু নির্ধারিত যেমন দিয়াত (প্রাণহানির ক্ষতিপূরণ) কিছু অনির্ধারিত যেমন আরশ “শব্দটি এর বহুবচন। অর্থ জখমের দিয়্যাত (আহমদ আল-ফাইয়ূমী, আল-মিসবাহুল মুনীর (বৈরুপ : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাাহ, ১৪১৪ হি.), মাদ্দা: আরশ)”। (অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ক্ষতিপূরণ)। এছাড়া বিভিন্ন বস্তু ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর বদলা যা হবে তাও এর অন্তর্ভুক্ত। “ফায়যুল্লাহ, নায়ারিয়্যাতুযযামান,পৃ.১৪”।
সুতরাং অন্যের জানমালে যে কোন ক্ষতি সাধন হারাম ও তার ক্ষতিপূরণ আবশ্যক হওয়া কুরআন ও হাদিসের বিভিন্ন নস দ্বারা সাব্যস্ত দ্বীনের একটি মূলনীতি। হাদিস ও ফিকহের ইমামগণ এ বিষয়ে একমত হয়েছেন যে, শরীয়াহে মানুষের জানমাল সম্মানিত। মানুষের জানমালের ক্ষেত্রে মূলবিধান হলে এগুলোর ক্ষতি সাধন নিষিদ্ধ। আর ন্যায়সঙ্গত কোন কারণ ছাড়া কারো প্রাণ ও সম্পদ অন্যের জন্য হালাল নয়। “ইবন কুদামাহ, আল মুগনী, খ.৭.পৃ.৩৬০ও খ.১১.পৃ.৪৪৩; আবু আবদুর রহমান দিমাশকী, রহমাতুল উম্মাহ ফী ইখতিলাফিল আইম্মা (বৈরুপ: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ ১৪০৭হি.) পৃ.১৭৩।”
এ সম্পর্কিত কিছু ফিকহী মূলনীতি ও তার ব্যাখ্যা নিম্নে দেওয়া হলো : কারো ক্ষতি করা যাবে না এবং কারও ক্ষতির অনুরূপ বদলাও গ্রহণ করা যাবে না’। “এ মূলনীতিটি একটি হাদিসে উদ্ধৃত হয়েছে। দ্রষ্টব্য : মুহাম্মদ ইবন ইয়াযীদ ইবন মাযাহ, আসসুনান (ইস্তম্বুল : আল মাকতাবাতুল ইসলামীয়্যাহ, সনবিহনি) বাবু মান বানা ফী হাক্কিহি মা ইয়াদুররু বিজারিহি, খ.২.পৃ.৭৮৪, হাদিস নং ২৩৪০ ও ২৩৪১।” মূলনীতিতে বর্ণিত শব্দদুটির মধ্যে অর্থগত ব্যবধান কী তা নিয়ে একাধিক মত রয়েছে। কেউ কেউ বলেন “অন্যের ক্ষতি করা” আর (যের দিয়ে) অর্থও অন্যের ক্ষতি করা। সুতরাং দ্বিতীয় শব্দ প্রথম শব্দকে কেবল অর্থগত দৃঢ়তা দান করছে। তবে এ বিষয়ক মতসমূহের মধ্যে উত্তম মত হলো ‘অন্যের যেকোন ক্ষতি সাধন করা’। আর প্রতিশোধ হলো ও বদলা হিসেবে অন্যের ক্ষতিসাধন।“ইবনুল আছীর, আন নিহায়াহ ফী গারীবিল হাদিস (বৈরুপ : দারুল ফিকর,সনবিহীন), খ.৩.পৃ.৮১; ইবন মানযুর লিসানুল আরব (বৈরুপ: দারু সাদির ১৪১০হি.) খ...পৃ...: মাদ্দাহ (যারার)।”
এ মূলনীতি ইঙ্গি করে, কোন ক্ষতির বদলা হিসেবে অনুরূপ ক্ষতিসাধন শরীয়াহর দৃষ্টিতে কাম্য নয়। (তবে কিসাস বা এ জাতীয় বিধান এই মূলনীতির আওতাভুক্ত নয়)। বরং যার ক্ষতি হয়েছে তার কর্তব্য হলো ক্ষমা করা অথবা ক্ষতির বিনিময় গ্রহণ করা। সুতরাং ইচ্ছাকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃতভাবে কারো গাড়ি যদি অন্যের গাড়ির ক্ষতিসাধন করে সে অবস্থায় অপর গাড়িকে আঘাত করার অধিকার এ গাড়ির মালিকের নেই।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন