মাওলানা এসএম আনওয়ারুল করীম : প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আরব দেশের মক্কা নগরের কোরাইশ বংশে এক আলোর দূতি ঠিকরে পড়ে। যে আলোকরশ্মি প্রত্যক্ষ করতে সমগ্র সৃষ্টি অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষমাণ ছিল। সপ্তাকাশ, সাত জমিন, নক্ষত্ররাজি, আকাশ, পাতাল, বায়ু তথা নভোম-ল ও ভূম-লের সব মাখলুকাত সেই মহান অতিথির আগমনের প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছিল। শুভ্র আকাশের মেঘপুঞ্জ নেচে নেচে যার প্রশংসাগাথা গাইছিল, বাতাসের হিল্লোল যার শুভাগমন আনন্দে পাতাগুলোকে দুলিয়ে নৃত্য প্রদর্শনে বাধ্য করছিল, মহাসমুদ্রের ঢেউয়ের নাচন আনন্দের আতিশয্যে যার কদমবুচির আগ্রহে নিক্কনধ্বনি তুলছিল, পা-ুর বৃক্ষরাজি বিচিত্র পত্রপল্লবে সৃজিত পাখা নিয়ে যাকে বাতাস করে ধন্য হবার স্বপ্নবিভোর ছিলÑ তিনি বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত উম্মতের কা-ারি বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ (স.)।
হাদিসে কুদসিতে খোদ আল্লাহতায়ালা এরশাদ করেছেন, আমি মোহাম্মদকে সৃষ্টি না করলে কুল কায়েনাতের কিছুই সৃষ্টি করতাম না। সুতরাং অতি সহজেই অনুমেয় যে, যাকে সৃষ্টি না করলে বিশ্ব জাহানের কিছুই অস্তিত্বে আসতো না, যার বদৌলতে সমগ্র মাখলুকাত সৃষ্টিÑ তার আগমনে সেদিন সৃষ্টিজগত কতোটা উল্লাসে মেতেছিল, হুর-পরি কতোটা সাজে সেজেছিল।
৫৭০ খ্রিস্টাব্দের রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার সুবহে সাদিকের নির্মল প্রকৃতিতে ধরাধামে আগমন করেন হযরত মোহাম্মদ (সা.)। তবে ঐতিহাসিকগণ তার আগমন তারিখ নিয়ে মতভেদের দোলাচলে দোল খেয়েছেন। অধিকাংশের মতে, তার জন্মতারিখ ৯ রবিউল আউয়াল। এছাড়া ৭, ৮, ১১, ১২ রবিউল আউয়াল সম্পর্কেও কেউ কেউ মত দিয়েছেন। আমাদের উপমহাদেশে সুদীর্ঘকাল হতেই ১২ রবিউল আউয়াল মহানবী (সা.)-এর জন্মদিন হিসেবে পালন হয়ে আসছে। তবে ১২ রবিউল আউয়াল যে মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুদিবসÑ এতে সব ঐতিহাসিকই ঐকমত্য পোষণ করেছেন।
হিজরি সনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে আমরা মহানবী (সা.)-এর কততম জন্মদিবসে পা ফেলেছি, তা সহজেই ধারণা করা যায়। মহানবী (সা.)-এর চল্লিশ বছর বয়সে নবুয়তপ্রাপ্তির দ্বাদশ বর্ষে তিনি জন্মভূমি মক্কার মায়া ত্যাগ করে আল্লাহর রাজ কায়েমের নিমিত্তে তিনি পুণ্যভূমি মদিনায় হিজরত করেন। ইসলামের ইতিহাস মতে, চল্লিশ বছর বয়সে হযরত মোহাম্মদ (সা.) নবুয়তপ্রাপ্ত হন। সে মতে দ্বাদশ বর্ষে তার বয়স হয় বায়ান্ন বছর। অর্থাৎ বায়ান্ন বছর বয়সে তিনি হিজরত করেন। হিজরতের পরও তিনি এগার বছর জীবিত ছিলেন। বর্তমানে হিজরি ১৪৩৮ সাল চলছে। সেই সাথে এগার বছর যোগ করলে ১৪৪৯ বছর হয়।
মোহাম্মদ (সা.) বিশ্বনবী। পৃথিবী সৃষ্টির পর হতে মানুষকে হেদায়েতের পথে আনতে আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে প্রায় দু’ লক্ষ চব্বিশ হাজার নবী-রাসুল পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তন্মধ্যে মাত্র একশ’ চারজন রাসূলের ওপর আসমানি কিতাব অবতীর্ণ হয়। এ একশ’ চারজন কিতাবপ্রাপ্ত নবী ছাড়াও দু’ লক্ষাধিক নবী-রাসুলই মহানবী (সা.)-এর উম্মত হওয়ার জন্যে আল্লাহতায়ালার দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন। অন্যান্য নবী-রাসুল আগে পৃথিবীতে আগমন করলেও মহানবী (সা.)-কে আকর্ষণ হিসেবে আল্লাহতায়ালা সর্বশেষ হিসেবে বিশ্বমাঝে প্রেরণ করেন। তাইতো তিনি শেষ নবী তিনি খাতামুন্নাবিয়্যীন।
মোহাম্মদ (সা.) এক আদর্শ মহামানব। এর স্বীকৃতিস্বরূপ আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে এরশাদ করেনÑ নিশ্চয় তোমাদের জন্যে আল্লাহর রাসুল মোহাম্মদ (সা.)-এর জীবনে রয়েছে অনুপম আদর্শ। তিনি মানবজীবনের সকল ক্ষেত্রে আদর্শ। শিশু, যুবা, আবালবৃদ্ধবনিতা নির্বিশেষে তিনি সবার জন্যেই আদর্শ। ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, পেশাজীবীÑ সবার জীবনেই তিনি আদর্শ। নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক গ্রন্থে মহানবী (সা.)-এর আগমন মুহূর্ত সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনি মা আমেনার পবিত্র গর্ভ হতে অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুর ন্যায় ভূমিষ্ট হননি। শুভ্র বসনের এক প্যাকেটজাত প্রক্রিয়ায় তিনি ধরাধামে আগমন করেন। একই সাথে অন্যান্য শিশুর ন্যায় চিৎ হয়ে ভূমিষ্ট না হয়ে তিনি পৃথিবীতে আগমন করেন উপুড় হয়ে। অর্থাৎ লজ্জাস্থান যে মানুষের দৃষ্টি হতে চরম হেফাজতের বস্তু, তা’ শিশুনবীর জন্মের মাধ্যমেই পৃথিবীবাসী অবলোকন করতে সক্ষম হয়েছে।
মহানবী (সা.) তখন শৈশবের গ-ি পেরিয়ে সতের বছরের বালক। তিনি দেখলেন, আরব দেশে বংশানুক্রমে গোত্রবিভেদ চরম আকার ধারণ করে আছে। একে কেন্দ্র করে ক’দিন পরপরই মারামারি হানাহানি হয়। বালক মোহাম্মদের অন্তরাত্মায় ব্যাপারটি দারুণভাবে বেদনার শলাকাবিদ্ধ করলো। তিনি ভাবলেনÑ যে করেই হোক মানবতাকে এ দুর্বিষহ জীবন হতে মুক্তি দিতেই হবে। কিন্তু প্রক্রিয়া কী? আরববাসীর অস্তিমজ্জায় বংশ পরম্পরায় যে প্রতিশোধের দাবানল জ্বলে আছে, তা’ হতে অতো সহজেই কি তাদেরকে মুক্তবিহঙ্গে নিয়ে আসা যাবে? তিনি নিজ বয়সী তেরজন বালককে তার ব্যথাটি বোঝাতে সক্ষম হলেন। তারা বালক মোহাম্মদকে এ ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতা করতে প্রত্যয়দীপ্ত হলেন। তিনি মাত্র সতের বছর বয়সে প্রতিষ্ঠা করলেন সেবামূলক সংগঠন ‘হিলফুল ফুজুল’। এ হিলফুল ফুজুলের পরশে এসে সে যুগের যুবসমাজ এক বেহেশতী পরিবেশ খুঁজে পেলো। ক্রমেই গোত্রবিদ্বেষ ছাইচাপা পড়তে শুরু করলো। যৌবনের তারণায় যুবসমাজ যেসব অপকর্মে লিপ্ত হয়, বালক মোহাম্মদের পাশে এসে তারা হয়ে উঠলো সোনার মানুষ। উলঙ্গপনা, বখাটেপনা, ইভটিজিং, মাদকাসক্তি যে বয়সি যুবকদের নিত্যদিনের কর্ম, তারা মোহাম্মদের মিশনে যোগ দিয়ে হয়ে উঠলো এর প্রতিরোধ আন্দোলনের জানবাজ সৈনিক। তাইতো বালক মোহাম্মদ এক অতুলনীয় আদর্শ। আজকের সমাজ যদি বালক মোহাম্মদের এ নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা হতে শিক্ষা নিতো, তাহলে অবশ্যই আমরা এক সোনালি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে সক্ষম হতাম।
আমানতদারির ক্ষেত্রে মোহাম্মদ (সা.)-এর তুলনা দুষ্প্রাপ্য। সেই জাহেলি যুগের পৌত্তলিকতায় আচ্ছন্ন মানুষগুলো পর্যন্ত মহানবী (সা.)-কে শ্রেষ্ঠ আমানতদার বলে বিশ্বাস করতো। তাইতো তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকে ‘আল-আমিন’ বা ‘মহাবিশ্বাসী’ বলে উপাধি দিয়েছিল। অতএব, আমানতদারির ক্ষেত্রে মোহাম্মদ (সা.)-এর মতো দ্বিতীয় কাউকে বিশ্বইতিহাসে খুঁজে পাওয়া শাদা কাকের ন্যায়ই বিরল।
শ্রমিকের অধিকার সম্পর্কে মহানবী (সা.) অনুপম আদর্শ। ‘শ্রমিকের ঘাম শুকাবার আগেই তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দাও’Ñ বলে বিশ্বনবী (সা.) যেই চিরন্তন উক্তি উচ্চারণ করে গেছেন, তা’ কালের আবর্তে গবেষণার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। শ্রমের সঠিক মূল্য না পাওয়ার কারণেই আমাদের দেশে ক’দিন পর পর আন্দোলন-সংগ্রাম তীব্র আকার ধারণ করে। আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যে আট শ্রমিক জীবন বিলিয়ে দিয়েছে, তাদের স্মরণ করতো আজ বিশ্বপরিম-লে আন্তর্জাতিক শ্রমিক অধিকার দিবস পালিত হয়ে থাকে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে শ্রমিকদরদী মোহাম্মদ (সা.)-এর প্রদত্ত উপর্যুক্ত উক্তি যদি আজকের মালিকসমাজ সঠিকভাবে গ্রহণ করে, তাহলে মানুষ সত্যিই এক অনুপম পরিবেশ খুঁজে পেত। একইভাবে মহানবী (সা.)-এর আদর্শে গড়ে ওঠা শাসক ওমর (রা.)-এর নিজে উটের লাগাম ধরে পালাক্রমে শ্রমিককে উপরে বসিয়ে টেনে নেয়ার নজির গোটা বিশ্বে দ্বিতীয়টি আছে কি?
নারীর অধিকার বাস্তবায়নে মহানবী (সা.)-এর অনুপম আদর্শ বিশ্বনন্দিত। যেই যুগে মেয়েসন্তান জন্মানোকে লাঞ্ছনার চাবিকাঠি মনে করা হতো, মেয়েসন্তান জন্মালে তাকে জীবিত গর্তে প্রোথন করে হত্যা করা হতো। এহেন অমানবিক ও জঘন্য অপরাধ আরব সমাজকে বিশ্ব দরবারে আজও নিন্দিত ও ধিক্কার দিয়ে আসছে। বিশ্বনবী (সা.) জাহেলি যুগের সেই কলুষিত অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে আরব জাতিকে সুসভ্য জাতিতে পরিণত করেছিলেন। হযরত দাহিয়া কালবী রাজি. হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর কাছে তার জাহেলি যুগের ঘটনা বর্ণনা করে বলেন, আমার একটি কন্যা ছিল। সে আমাকে খুব ভালোবাসতো। তাকে নাম ধরে ডাকলে সে দৌড়ে কাছে আসতো। একদিন আমি তাকে ডাকলাম। তাকে সাথে নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। পথে একটি কুয়া পেলাম। তার হাত ধরে ধাক্কা দিয়ে তাকে কুয়ার মধ্যে ফেলে দিলাম। তার যে শেষ কথাটি আমার কানে ভেসে এসেছিল। তা হলোÑ হে আব্বা! হে আব্বা! একথা শুনে রাসুলুল¬াহ (সা.) কেঁদে ফেললেন। তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো।
উপস্থিত লোকদের মধ্যে একজন বললেন, ওহে! তুমি রাসূলুলা¬হ (সা.)-কে শোকার্ত করে দিয়েছো। রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমরা তাকে বাধা দিও না। যে বিষয়ে তার কঠিন অনুভূতি জেগেছে সে বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করতে দাও। তারপর তিনি বললেন, তোমার ঘটনাটি আবার বর্ণনা করো। সে ব্যক্তি আবার তা শুনালেন। ঘটনাটি আবার শুনে তিনি এত বেশি কাঁদতে থাকলেন যে, চোখের পানিতে তার দাড়ি মোবারক ভিজে গেল। এরপর তিনি বললেন, জাহেলি যুগে যা কিছু করা হয়েছে আল্লাহ তা’ মাফ করে দিয়েছেন। এখন নতুন করে জীবন শুরু করো। (সুনানু দারামি)
লেখক : ভাষ্যকার, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন; বিভাগীয় প্রধান (হাদিস) আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন