মুহাম্মাদ রাশিদুল হক : রূপ-সৌন্দর্য, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, অনুগ্রহ এবং আত্মার সম্পর্ক এই চার বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হয়। ভালোবাসা পাবার জন্য মানুষের মধ্যে যতগুলো বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার তার সব কটিই রাসূলুল্লাহ সা. এর মধ্যে পূর্ণরূপে বিদ্যমান ছিল।
রাসূলুল্লাহ সা. ছিলেন সৌন্দর্যের আধার। সারা দুনিয়ায় তাঁর সৌন্দর্যের কোনো জুড়ি নেই। দুধে আলতা বর্ণের সুঠাম দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ছিল সুগঠিত। হযরত জাবের ইবনে সামুরা রাযি. বলেন- এক চাঁদনী রাতে আমি রাসূলুল্লাহ সা.কে দেখছিলাম। একবার ফিরছিলাম চাঁদের দিকে, আরেকবার দেখছিলাম লাল ডোরা কাটা পোশাকে আবৃত প্রিয় রাসূলুল্লাহ সা.-এর দিকে। শেষ পর্যন্ত আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম পূর্ণিমার চাঁদের চেয়ে বেশি সুন্দর। (শামায়েলে তিরমিযী) প্রিয় নবীজী সা.কে নিয়ে রচিত একটি কবিতায় হযরত আয়েশা রাযি. চমৎকার করে বলেছেন তাঁর সৌন্দর্যের কথা। সেটির সরল অনুবাদ করলে দাঁড়ায়Ñ “আমারও আছে একটি সূর্য। যেমন আছে আকাশের। তবে আমার সূর্যটিই ভালো। আকাশের সূর্যটি উদিত হয় ফজরের পরে। আর আমার সূর্য আলো দেয় ইশার পরে। যদি জুলাইখাকে ভর্ৎসনাকারী নারীরা আমার রাসূলুল্লাহ সা.-এর ললাট দেখত, তাহলে হাত নয়, নিজের কলিজায় ছুরি চালিয়ে দিত।”
বাহ্যিক সৌন্দর্যের মত একটি মানুষের প্রিয় পাত্র হওয়ার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মানুষের অভ্যন্তরীণ গুণ-গরিমা। এটি মূলত মানুষের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য। সভ্য মানুষের কাছে প্রিয়ভাজন হওয়ার জন্য যেসব গুণের প্রয়োজন হয় রাসূলুল্লাহ সা.-এর মধ্যে এর সবগুলোই পূর্ণ মাত্রায় ছিল। মানুষের অভ্যন্তরীণ গুণাবলী নির্ভর করে সাধারণত তার গুণগরিমা ও বোধশক্তির উপর। তিনি ছিলেন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জ্ঞানের আধার। হাদীস শরীফে আছে ‘পূর্বাপর সকলের জ্ঞান আমি প্রাপ্ত হয়েছি’।
এমনিভাবে রাসূলুল্লাহ সা.-এর বোধশক্তিও ছিল দুনিয়ার সব মানুষের চেয়ে বেশি। শায়েখ শিহাবুদ্দীন লিখেছেনÑ ‘আল্লাহ মানুষকে দেয়া বোধশক্তি প্রথমত দুই ভাগে বিভক্ত করেছেন। এক ভাগে নিরাব্বই শতাংশ অন্য ভাগে এক শতাংশ। প্রথম ভাগটি তিনি রাসূলুল্লাহ সা.কে দান করেছেন। আর দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ অবশিষ্ট এক শতাংশ গোটা দুনিয়ার মানুষকে ভাগ করে দিয়েছেন। (আওয়ারিফুল মাআরেফ) সুতরাং তিনি মানুষের যাবতীয় গুণ-গরিমার আধার হবেন এটাই স্বাভাবিক।
কথায় আছে, মানুষ অনুগ্রহের দাস। মানবজাতির উপর রাসূলুল্লাহ সা.-এর অনুগ্রহ গুণে শেষ করা সম্ভব নয়। দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত সবখানেই তাঁর অনুগ্রহ আমাদের উপর বিরাজমান। তিনি মানবজাতিকে জাহান্নামের অতল গহ্বর থেকে রক্ষা করে চিরস্থায়ী শান্তির আবাস জান্নাতে প্রবেশের মাধ্যমে মানুষের সফলতার সোপান উন্মোচিত করেছেন। এর চেয়ে বড় অনুগ্রহ আর কী হতে পারে। তাছাড়া তিনি উম্মতের জন্য পেশ করেছেন একটি সহজ-সরল পথের দিশা।
আত্মীয়তা বা বংশগত কারণে মানুষের মধ্যে এক প্রকার টান বা ভালোবাসা গড়ে ওঠে। এদিক বিচারেও তিনি সব মুমিনদের কাছে প্রিয়ভাজন ব্যক্তি। ইরশাদ হচ্ছে “নবী মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা অধিক ঘনিষ্ঠ এবং তাঁর স্ত্রীগণ তাদের মাতা।” (আহযাব: ৬) আয়াতের আলোকে প্রতীয়মান হয় যে, আত্মীয়তার বন্ধনের কারণে মানুষ যতটুকু প্রিয় হয় রাসূলুল্লাহ সা. মুসলমানদের কাছে এর চেয়েও বেশি প্রিয়ভাজন হওয়া উচিত। কারণ মানুষের সৃষ্টি দুটি জিনিসের সমন্বয়ে। প্রথমত রুহ এবং দ্বিতীয়ত শরীর। মানুষের শরীর ধ্বংসশীল। কিন্তু রুহ ক্ষয়হীন-লয়হীন। সৃষ্টির পর এর আর মরণ নেই। শরীর রুহের অনুগত তাই শারীরিক সম্পর্কে মূল রুহের সাথে সম্পর্কের মূল্য এবং স্থায়িত্ব বেশি। আত্মীয়স্বজনের সাথে মানুষের সম্পর্কটি শারীরিক। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ সা.-এর সাথে মানুষের যে সম্পর্ক সেটি রুহানী সম্পর্ক। মোটকথা রূপ-সৌন্দর্য, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, অনুগ্রহ এবং আত্মার সম্পর্ক যাই বলি না কেন, ভালোবাসা পাবার জন্য মানুষের মধ্যে যতগুলো বৈশিষ্ট্য থাকা দরকার প্রিয় নবীজী সা.-এর মধ্যে সব ক’টিই পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। তাই তিনি আমার এবং আমাদের কাছেই সবার চেয়ে বেশি প্রিয়।
লেখক: সিনিয়র মুহাদ্দিস, ইমাম ডেমরা জামে মসজিদ
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন