স্টালিন সরকার : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা। ’৭১ সালে তার নামে ৯ মাস বাংলার দামাল ছেলেরা যুদ্ধ করে পৃথিবীর মানচিত্রে ‘বাংলাদেশের অভ্যুদয়’ ঘটায়। ১০ জানুয়ারি পালিত হলো তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস। বাংলাদেশের এই সূর্য্যসন্তানের টুঙ্গিপাড়ার ‘খোকা’ থেকে ‘জাতির পিতা’ হয়ে ওঠার পরতে পরতে ছিল ত্যাগ-তীতীক্ষা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, ব্যক্তি জীবনে আর্থিক অভাব-অনটন। ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়লে জানা যায়Ñ কিভাবে ছাত্রনেতা, যুবনেতা হিসেবে তিনি পুরান ঢাকার পার্টি অফিসে ঘুমাতেন। পত্রিকা থেকে পাওয়া সামান্য টাকা দিয়ে জীবনযাপন করেছেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছ থেকে কিভাবে সামান্য টাকা নিয়ে সংগঠন গড়েছেন; দলের কাজে ঢাকা থেকে ট্রেনে রংপুর গেছেন; আবার ফিরে এসেছেন, অথচ অর্থাভাবে পেটে দানাপানি পড়েনি। সেই বঙ্গবন্ধুর সৈনিকদের একী হাল!
ছোট্ট দু’টি ঘটনার খবর শনিবার দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশ করা হয়েছে। একটি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, অন্যটি পাবনার ঈশ্বরদীর। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিনে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ভেড়ামারা পৌরসভার মেয়র শামীমুল ইসলামের বড় ভাই সাইফুল ইসলামের মেয়ের বিয়ে হয়। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে গুলিভর্তি পিস্তল ও শর্টগান হাতে হাজির হন মেয়র শামীমুল ইসলাম। লাল-নীল আলোয় সাজানো বাড়িতে নাচগান চলছে। ওই নেতা সবার সামনেই খোলা আকাশে গুলি ছুঁড়ে উল্লাস করেন। গুলি ছোঁড়ার দৃশ্য কনের ভাই সাদমান আল সাকিব ফেসবুক আইডিতে সরাসরি (লাইভ) প্রচার করেন। ফেসবুকে আপলোড ভিডিওতে দেখা যায়, মেয়র শামীমুল শর্টগান উঁচু করে গুলি ছুড়ছেন। তাকে ঘিরে থাকা কয়েকজন তরুণ ছবি ও ভিডিও তুলছেন। মেয়র ‘দিলাম’ বলেই গুলি ছোড়েন। তারপর উল্লাস। পত্রিকায় খবর বের হয়, ফেসবুকে ভিডিও চিত্র সরাসরি দেখানোর পর কয়েকজন মন্তব্য করেন। আল-আমিন নামের একজন লেখেন, ‘এটা কোন আইনের মধ্যে পড়ে?’ জবাবে সাদমান আল সাকিব লেখেন, ‘এখানে আমরাই আইন।’ মিডিয়াকর্মীরা এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ নেতা শামীমুল ইসলাম বলেন, ‘অনুষ্ঠানে সবাই আনন্দ-উল্লাস করেছে। তখন থানার ওসি এবং ইউএনও ছিলেন। তিনি বলেন, ‘এটা তো আমার বাড়ির প্রাচীরের ভেতরে। তা ছাড়া অস্ত্র লাইসেন্স করা। আমি দু’বারের মেয়র এবং আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। আমি কি বেআইনি কিছু করতে পারি?’ তবে ভেড়ামারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শান্তিমণি চাকমা অনুষ্ঠানস্থলে ছিলেন না দাবি করে বলেন, ‘তার (শামীমুল) বৈধ অস্ত্র আছে। গুলি চালাতে পারেন, তবে কেন গুলি ছুড়েছেন তিনিই তা বলতে পারেন। আর ভেড়ামারা থানার ওসি নূর হোসেন খন্দকার বলেন, ‘নিজের লাইসেন্স করা অস্ত্র শামীমুল ব্যবহার করতেই পারেন। এ ক্ষেত্রে আইন ভাঙার কোনো ব্যাপার নেই’।
অন্য খবরটি আরো ছোট্ট। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ হেলিকপ্টারে চড়ে ঈশ্বরদী উপজেলা ও পৌর ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগ দেন। গত শুক্রবার তিনি আকাশপথে ঈশ্বরদী যান। সেখানে অবশ্য সড়ক পথে যান মহামান্য প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের ছেলে রাসেল আহমেদ তুহিন। খবর দু’টির গুরুত্ব তেমন না থাকায় অনেক পত্রিকায় এড়িয়ে গেছে। কিন্তু কিছু পত্রিকা সচিত্র খবর প্রকাশ করেছে। চুলার হাড়ির দু’একটি ভাত টিপলেই যেমন বোঝা যায় হাড়ির সব ভাত সেদ্ধ হয়েছে কিনা; তেমনি দু’টি খবরের বোঝা যায় দেশের বর্তমানে কী অবস্থা বিরাজমান। ভেড়ামারা উপজেলার ইউএনও এবং থানার ওসির বক্তব্যে প্রকাশ পায় জনগণের অর্থে পরিচালিত রাষ্ট্রের প্রশাসনযন্ত্রের লোকজন ক্ষমতাসীনদের কতবড় তল্পিবাহক। দলীয়করণ-আত্মীয়করণে কর্মকর্তা- কর্মচারীরা ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের কত বড় বিশ্বস্থ ‘জি হুজুর’ হয়ে গেছেন। এদের কর্মকা- শুনলে সিইসি কাজী রকিবউদ্দিন আহমদও হয়ত লজ্জা পাবেন। আর ছাত্রনেতার হেলিকপ্টারে চড়ে সভা-সমাবেশে যোগদানের ঘটনায় প্রমাণ করে, দেশের অর্থনীতি-উন্নয়ন কোন পর্যায়ে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু যখন ছাত্রনেতা ছিলেন, তখন তিনি অর্থের অভাবে দলীয় কার্যালয়ে ঘুমিয়েছেন, দলের শীর্ষ নেতা সোহরাওয়ার্দীর দেয়া টাকা সংগঠনের কাজে ব্যবহার করেছেন। নিজের খাওয়া-পড়ার জন্য পত্রিকায় চাকরি করেছেন; বাবার কাছ থেকে এবং বেগম মুজিবের হাত খরচের টাকা ঢাকায় এনে নিজে চলেছেন। অথচ তারই আদর্শের সৈনিক (!) দাবিদার ছাত্রনেতারা হেলিকপ্টারে সভা সমাবেশ করেন। জনপ্রতিনিধি মেয়ে-ভাতিজির বিয়েতে পিস্তলের গুলি ছুড়ে অনুষ্ঠান উদযাপন করেন।
আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, কৃষকলীগ, শ্রমিকলীগ ও মহিলালীগের নেতাকর্মীরা সবসময় নিজেকে ‘বঙ্গবন্ধুর সৈনিক’ হিসেবে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন। বঙ্গবন্ধুর মতো নেতার অনুসারী হওয়া গর্বই বটে। নিত্যদিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতারা সভা সমাবেশে এবং কাজেকর্মে সব সময় নিজেদের বঙ্গবন্ধুর সৈনিক দাবি করে আদর্শ’ বাস্তবায়নের দাবি করেন। কিন্তু বাস্তবে কী তাই? এ ঘটনা দু’টি কী সে প্রমাণ দেয়? ঘর ভাড়া নেয়ার অর্থ না থাকায় ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান দলীয় কার্যালয়ে ঘুমিয়েছে। যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমান ট্রেনে ঢাকা-রংপুর জার্নি করেছেন ক্ষুধা পেটে নিয়ে। আর তার সৈনিকদের এলাহী কা-! আওয়ামী লীগ অনুসারীদের কেউ কেউ দাবি করছেন এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আসলে কী তাই?
সরকারের তিন বছরের সাফল্য নিয়ে নিত্যদিন প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখালেখি এবং টিভির টকশোতে আলোচনা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার বাংলাভিশনে সরাসরি প্রচারিত পৌনে দু’ঘণ্টার টকশো ‘গণতন্ত্র এখন’-এ আলোচক ছিলেন মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব ড. সা’দত হুসাইন, সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার, জাসদের (রব) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন ও সম্পাদক-সাংবাদিক নাইমূল ইসলাম খান। আলোচকদ্বয় সরকারের তিন বছর উদযাপনের ঢাকঢোল প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নানান প্রসঙ্গের অবতারণা করেন। ড. সা’দত হুসেইন পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের শাসনামলে ‘উন্নয়নের ১০ বছর’ উদযাপনের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘১৯৬৯ সালের মার্চে পাকিস্তানে উন্নয়নের ১০ বছর উদযাপন করা হয়। সে সময় দেশের (পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তান) সবগুলো প্রাইমারি স্কুল, মাদরাসা, হাইস্কুল, কলেজ ব্যাপকভাবে সজ্জিত করা হয়। ঢাকঢোল পিটিয়ে পক্ষকালব্যাপী ওই উৎসব পালনের দু’তিন মাস পর আইয়ুব খান বিরোধী অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। যার সফল পরিণতি ঘটে ’৬৯ গণঅভ্যুত্থানে’। দেশের বর্তমান উন্নয়নের মূল্যায়ন করেছেন আওয়ামী লীগ অনুগত বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচিত সাংবাদিক কথাশিল্পী আনিসুল হক। শুক্রবার একটি জাতীয় দৈনিকে ‘অরণ্যে রোদন’ কলামে তিনি যা লিখেছেন তা হুবহু, ‘বাংলাদেশে আমরা একটা সত্যিকারের ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছি। পুঁজি দ্রুত গড়ে উঠছে, আমরা দ্রুত মধ্য আয়ের দেশ হচ্ছি। পুঁজি গড়ে ওঠার কাল হলো নৈরাজ্যের কাল। আর আমাদের পুঁজি তো লুটেরা পুঁজি। বন ধ্বংস করে, নদী দখল করে, ভূমিদস্যুতা করে, বাঁধে সিমেন্টের বস্তার বদলে কিছু না ফেলে, ভবনে ইস্পাতের বদলে বাঁশ ব্যবহার করে, ঘুষের টাকা বালিশে ভরে রেখে, কর ফাঁকি দিয়ে, শুল্ক ফাঁকি দিয়ে, ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে, শেয়ার মার্কেটে কারসাজি করে, টাকা বাড়িয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পালিয়ে গিয়ে, ফেনসিডিল-ইয়াবার ব্যবসা করে আমাদের পুঁজি গড়ে উঠছে। এখানে একজন স্কুলশিক্ষকও বিজ্ঞাপন দেন, ‘পাত্রী চাই, মাসিক আয় দুই লাখ টাকা’। নিশ্চয়ই সৎ ব্যবসায়ী, সৎ উদ্যোক্তা এবং দেশের কোটি পরিশ্রমী সৃষ্টিশীল মানুষেরও অবদান আছে, তবে কালোটাকা সব সময় সাদাটাকাকে অপসারিত করে অর্থনীতির এটাই নিয়ম’। আওয়ামী লীগে হাজার হাজার নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী রয়েছেন। দলটি দুর্দিনে জেল-জুলুম নির্যাতন সহ্য করেও বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন’ বাস্তবায়নে কাজ করছেন; এখনো করছেন। যারা প্রকৃত অর্থেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক; তাদের কাছে প্রশ্ন আপনাদের দলকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তথাকথিত এই সৈনিকরা?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন