শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

জান-মাল ও ইজ্জত সংরক্ষণে রাসূল সা.-এর শিক্ষা

| প্রকাশের সময় : ১৭ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

প্রফেসর ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান

॥ শেষ কিস্তি ॥
ডাকাতি সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন, “যারা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে (অর্থাৎ ডাকাতি করে) এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করে বেড়ায়, তাদেরকে হত্যা করা হবে কিংবা ক্রুশবিদ্ধ করা হবে কিংবা বিপরীত দিক থেকে তাদের হাত ও পা কেটে ফেলা হবে কিংবা তাদের দেশ থেকে নির্বাসিত করা হবে। দুনিয়ায় এটা তাদের জন্য লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্য মহাশাস্তি” (সূরা মায়েদা : ৫ : ৩৩)।
হজরত জাবির ইব্ন ‘আব্দিল্লাহ্ (রা.) থেকে বণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রকাশ্যে লুটপাট বা ছিনতাই করে, সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়” (সুনানু ইব্ন মাজাহ্, বাবুন্-নাহয়ি ‘আন্-নুহবাতি, হাদীস নং ৩৯২৫; সুনানু আবী দাউদ, বাবুল কাত‘ঈ ফিল-খুলসাতি ওয়াল-খিয়ানাতি, হাদীস নং ৩৮১৭; মুসনাদু আহ্মাদ, হাদীস নং ১৪৫৩৯)।
রাসূলুল্লাহ্ (সা.) সর্বদা অন্যের মাল-সম্পদ রক্ষায় যতœশীল হওয়ার ব্যাপারে নির্দেশ দান করেছেন। অন্যায়ভাবে কারো মাল হস্তগত করা যাবে না। এ উদ্দেশ্যেই তিনি চৌর্যবৃত্তি, ডাকাতি, ছিনতাই, আত্মসাৎ, জবরদখল, ধোঁকা-প্রতারণা, ওজনে কম দেয়া, সুদ, ঘুষ ও জুয়া প্রভৃতি কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে প্রত্যেকের মাল-সম্পদ সংরক্ষণের শিক্ষা প্রদান করে গিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর বাণীসমূহ দ্বারা মাল-সম্পদ রক্ষা ও মালিকানার অধিকার নিশ্চিত করেছেন।
‘ইজ্জত সংরক্ষণ
আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ তথা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ হিসাবে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। তাই প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব ‘ইজ্জত বা সম্মান রয়েছে। প্রত্যেক ব্যক্তির নিকট তার ‘ইজ্জত-সম্মান অতীব প্রিয়। কারো সম্মান নষ্ট করার অধিকার কারো নেই। ইসলাম জাতি-ধর্ম-বর্ণ, ধনী-দরিদ্র, শাসক-শাসিত নিবিশেষে গোটা মানব জাতিকে সম্মানিত করেছে। আল্লাহ্ তা‘আলা ঘোষণা করেন, “নিশ্চয় আমি সন্তান-সন্ততি (মানবজাতি)-কে মর্যাদা দান করেছি” (সূরা বনী ইসরাঈল, ১৭ : ৭০)। হজরত আবুদ্-দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
“রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-কে আমি বলতে শুনেছি, যে কোনো মুসলমান তার কোনো মুসলমান ভাইয়ের মান-সম্মান বিনষ্ট করা থেকে অন্যকে বিরত রাখে, তখন আল্লাহ্র উপর অপরিহার্য হয়ে যায় যে, কিয়ামতের দিন তিনি তার উপর থেকে দোযখের আগুন প্রতিহত করবেন। অতঃপর তিনি কোরআনের এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন, “এবং ঈমানদারদের সাহায্য করা আমার উপর অপহিার্য কর্তব্য” (সূরা রুম : ২০ : ৪৭) (মিশকাতুল মাসাবীহ্, হাদীস নং ৪৯৮২)।
অপর হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “কোনো মুসলমানের ‘ইজ্জত বা সম্মানের উপর অযথা ও অন্যায় আক্রমণ খুব নিকৃষ্ট ধরনের বাড়াবাড়ি” (সুনানু আবী দাউদ)। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বিদায় হজের ভাষণে ঘোষণা করেন, “তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ এবং তোমাদের ‘ইজ্জত বা সম্মান তোমাদের মধ্যে ঠিক তেমনি পবিত্র, যেমন তোমাদের আজকের এইদিন এই মাস এই শহর পবিত্র” (সুনানু ইব্ন মাজাহ্, হাদীস নং ৩০৫৫)।
প্রত্যেক ব্যক্তির ‘ইজ্জত ও মর্যাদার নিশ্চয়তা দিয়েছে ইসলাম। কারো কাজ বা কথা নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করা, কারো দৈহিক গঠন বা পোশাক-আশাক দিয়ে উপহাস করা, কারো সততা বা পবিত্র সম্পর্কে ভিত্তিহীন কথা বলা, কারো সম্পর্কে অহেতুক খারাপ ধারণা পোষণ করা, কারো দোষ-ত্রুটি খোঁজ করা, কারো দুর্বলতা খুঁজে বের করা এবং কারো বংশ-মর্যাদা সম্পর্কে কটাক্ষ করা অত্যন্ত নিন্দনীয় ও গর্হিত কাজ। এতে উক্ত ব্যক্তির ‘ইজ্জত বা সম্মানের হানি হয়। আল্লাহ্ তা‘আলা এরূপ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “হে ঈমানদারগণ! পুরুষেরা যেন অন্য পুরুষেদেরকে বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর কোনো নারীরাও যেন অন্য নারীদের বিদ্রূপ না করে, হতে পারে তারা বিদ্রূপকারীদের চেয়ে উত্তম। আর তোমরা একে অপরের নিন্দা বা দোষারোপ করো না এবং তোমরা একে অপরকে মন্দ বা খারাপ উপনামে ডেকো না। ঈমান গ্রহণের পর মন্দ নাম কতই না নিকৃষ্ট। আর যারা তওবা করে না, তারাই তো যালিম। হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক অনুমান বা ধারণা থেকে দূরে থাক। নিশ্চয় কোনো কোনো অনুমান বা ধারণা তো পাপ বা গুনাহ্। আর তোমরা কারো দোষ-ত্রুটি বা গোপন বিষয় অনুসন্ধান করো না; এবং একে অপরের গীবত করো না” (সূরা আল-হুজুরাত : ৪৯ : ১১-১২)।
কোরআনের নির্দেশমতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) এমন এক কল্যাণ সমাজ বিনির্মাণ করেছিলেন, যাতে প্রত্যেকেই নিজের ‘ইজ্জতের পূর্ণ নিরাপত্তা লাভ করেছিলেন। কেউ কারো ‘ইজ্জত বা মান-সম্মানের ওপর আঘাত হানতো না। সবাই পারস্পরিক ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বের সুকঠিন ডোরে আবদ্ধ ছিল। ছোটরা বড়দের শ্রদ্ধা করতো, আর বড়রা ছোটদের ¯েœহ করতো। উপর্যুক্ত আয়াত দুটিতে মোট ছয়টি বিষয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এক. কাউকে ঠাট্টা ও উপহাস করা : এ নির্দেশ সাহাবীদের অন্তরে অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। প্রথমে পরুষের প্রতি পুরুষের উপহাস করার নিষেধাজ্ঞা এসেছে এবং পরবর্তীতে নারীর প্রতি নারীর উপহাস করার বিষয়টি আনুষঙ্গিকভাবে এসেছে। কেননা নারীরা তাদের স্বল্প বুদ্ধি ও অজ্ঞতার কারণে অধিকাংশ সময় একে অন্যকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও উপহাস করে থাকে। (তাফসীরুল মাযহারী, খ. ৯, পৃ. ১৮-১৯)। এ আয়াত দ্বারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ ও উপহাস করা সকল ঈমানদারগণের জন্য হারাম করা হয়েছে। ঠাট্টা-বিদ্রূপের ফলে মানুষের ‘ইজ্জত, মর্যাদা ও সম্মানের হানি হয়। এছাড়া আল-কোরআন যে সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায় সে সমাজ হবে উন্নতমানের কৃষ্টি ও সু-আচরণ দ্বারা পরিবেষ্টিত। সেখানে থাকবে না ‘ইজ্জতে আঘাত সৃষ্টিকারী কোনো কু-আচরণ। সে সমাজে প্রতিটি ব্যক্তি এমন ‘ইজ্জত ও মর্যাদার অধিকার ভোগ করবে যা অলঙ্ঘনীয়। ব্যক্তির সম্মান তার চোখে সমষ্টির সম্মানেরই অংশ এবং ব্যক্তির প্রতি কটাক্ষ ও অসদাচরণ সমষ্টির প্রতি অসদাচরণেরই অংশ। এজন্য এ আয়াতে নারী-পুরুষ উভয়কে পরস্পরের প্রতি ঠাট্টা-বিদ্রূপ করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেননা যাকে বিদ্রূপ করা হয় সে আল্লাহ্র দৃষ্টিতে বিদ্রূপকারী অথবা বিদ্রূপকারিণীর চেয়ে ভালো হতে পারে। (ফী যিলালিল কোরআন, খ. ৬, পৃ. ৩৩৪৪)। হজরত আব্দুল্লাহ্ ইব্ন মাস‘উদ (রা.) বলেন, “কোনো কুকুরকেও উপহাস করতে আমার ভয় লাগে, যে না জানি আমি কখন কুকুর হয়ে যাই।”
দুই. একে অপরের নিন্দা বা দোষারোপ করা : এ আয়াতে কোনো মানুষকে অযথা কথা, কাজ এবং ইঙ্গিতের মাধ্যমে দোষারোপ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারো দোষ বের করা, নিন্দা করা এবং দোষের কারণে ভর্ৎসনা করাকে আল্লাহ্ তা‘আলা নিষেধ করেছেন। কারণ অন্যের দোষ প্রকাশ করা নিজের দোষ প্রকাশ করার শামিল। যে কেউ কারো দোষ প্রকাশ করলে সেও তার দোষ প্রকাশ করবে। দোষ থেকে কোনো মানুষ মুক্ত নয়। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেন, “সকল মু’মিন এক ব্যক্তিতুল্য। যদি তার মাথাব্যথা হয়, তখন তার সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গে ব্যথা অনুভূত হয়। যদি তার চোখে ব্যথা লাগে তখন তার সকল অঙ্গে ব্যথা অনুভূত হয়” (সহীহ মুসলিম, কিতাবুল র্বির ওয়াস্-সিলাহ্, বাবু তারাহুমিল মু’নিনীনা ওয়া তা‘আতুফিহিম ওয়া তা‘আযুদিহিম, হাদীস নং ৪৬৮৭)।
তিন. কাউকে মন্দ নামে ডাকা : মন্দ নামে কাউকে ডাকা হারাম করার কারণ হলো এই যে, এতে ব্যক্তির অবমাননা ও অমর্যাদা হয়। যেমন কাউকে ফাসিক, মুনাফিক, কাফির, খোঁড়া, অন্ধ ও কানা বলা। অথবা কাউকে তার নিজের কিংবা মা-বাবার কিংবা বংশের কোন দোষ-ত্রুটির সাথে সম্পর্কযুক্ত করে ডাকা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Mazid ১১ নভেম্বর, ২০২০, ৪:৫৪ পিএম says : 0
ইচ্ছাকৃতভাবে শিরক-কুফরী-তাগুত-মুনাফেকীতে লিপ্ত হয়ে ঈমানহারা মুসলিম নামধারী প্রমাণিত মুশরিক-কাফের-তাগুত-মুনাফেকদেরকে চিহ্নিত না করলে অন্যান্য মুসলিমরা তার দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন