গাজী মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম জাবির
॥ শেষ কিস্তি ॥
আমি তাদের কার্য আটকা করে রাখার জন্য নিযুক্ত আছি। এ বলে কতগুলো আমল বেছে নিয়ে বলেন, এগুলো ঈর্ষাকারী ব্যক্তির আমল, এগুলো নিয়ে আমলকারীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দাও। যারা জ্ঞানে ও পরহেজগারিতে এদের সমকক্ষ হয়েছে, এরা তাদের প্রতি ঈর্ষাপোষণ করে থাকে এবং তিরস্কার করে। হাফাজাহ ফেরেশতাগণ সেগুলো ফেলে অবশিষ্ট আমলগুলো নিয়ে ষষ্ঠ আসমানে উপনীত হন। ষষ্ঠ আসমানের ফেরেশতা বাধা প্রদানপূর্বক বলেন- দাঁড়াও তোমাদের হাতের আমলগুলো পরীক্ষা করে দেখতে হবে। এ বলে তিনি অনেকগুলো আমল বেছে নিয়ে বলবেন, এগুলো এমন ব্যক্তিদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছে, যারা দুস্থ ও বিপন্ন মানুষের প্রতি দয়া করে না। বরং পরের দুঃখ-কষ্ট দেখে তারা আনন্দিত হয়। আমি রহমতের ফেরেশতা, আমি নির্দয় ব্যক্তিদের আমলকে বাধা প্রদান করার জন্য নিযুক্ত আছি। অতএব তোমরা এ আমলগুলো নিয়ে তাদের মুখের ওপর নিক্ষেপ কর। হাফাজাহ ফেরেশতাগণ অন্যান্য আমলগুলোকে নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।
এ আমলগুলো নামাজ, রোজা, ছদকা, খয়রাত, পরহেজগারী প্রভৃতি আমলে পরিপূর্ণ বলে উহাদের জ্যোতি-সূর্যের ন্যায় দীপ্তমান এবং শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্ত্বের কারণে বজ্রধ্বনির ন্যায় ঘর ঘর শব্দে আসমান কম্পিত করে অগ্রসর হতে থাকে। উহাদের অনুপম জ্যোতিতে সমগ্র আসমান উদ্ভাসিত হয়ে পড়ে। প্রচ- বেগে অগ্রসর হয়ে সপ্তম আসমানের দ্বারে পৌঁছিবা মাত্র সেখানে রক্ষী ফেরেশতা পথ অবরোধ করে বলতে থাকেন যাদের এবাদতে আল্লাহপাকের সন্তোষ লাভ উদ্দেশ্য ছিল না, বরং সুধী ও জ্ঞানী সমাজে নিজের প্রাধান্য প্রদর্শন এবং সুনাম-সুখ্যাতি ও প্রতিপত্তি লাভ করাই উদ্দেশ্য ছিল, তাদের আমলগুলোকে এ আসমানের ওপর দিয়ে অতিক্রম করার অনুমতি প্রদান না করতে আমি আদিষ্ট হয়েছি। অতঃপর তিনি কতগুলো আমল বেছে বলবেন, এগুলো নিয়ে আমলকারীদের মুখের ওপর নিক্ষেপ কর। ফেরেশতাগণ সেগুলোকে ফেলে দিয়ে অন্যান্য আমলগুলো নিয়ে আল্লাহতায়ালার দরবারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এ বাছা বাছা আমলগুলো সৎস্বভাব, তাসবীহ্-তাহ্লিল এবং নানা প্রকারের এবাদত।
এ আমলগুলোর সৌন্দর্য ও মাধুর্যে মগ্ধ হয়ে ফেরেশতাগণ আল্লাহপাকের দরবারে পৌঁছাবার জন্য সঙ্গে গমন করতে থাকেন এবং সমবেত কণ্ঠে সাক্ষ্য প্রদান করতে থাকেনÑ হে আল্লাহ এ আমলগুলো দোষত্রুটি হতে পবিত্র। স্থানে স্থানে আমলগুলোকে যাচাই-বাচাই করা হয়েছে। তখন আল্লাহপাক বলেন, হে ফেরেশতাগণ তোমরা মানবের কার্যাবলীর তত্ত্বাবধায়ক মাত্র। তোমরা মানুষের কার্যাবলীর দোষত্রুটিই কেবল যাচাই করতে পার। আমি তাদের আত্মার পরিদর্শক, কোন কাজ কোন ব্যক্তি কোন সংকল্পে করেছে, তা একমাত্র আমিই জানি। যারা আমার উদ্দেশ্যে কার্য করেনি, তাদের প্রতি আমার ধিক্কার, এটা শুনে ফেরেশতাগণ বলবে, হে আল্লাহ! যার উপর তুমি আল্লাহর লানত, তার উপর আমাদেরও লানত॥ রিয়াকারীর জঘন্য পরিণাম সম্পর্কে এরূপ বহু হাদিস রয়েছে। (১) যে ক্ষেত্রে সওয়াব লাভের আশা আদৌ থাকে না, কেবল লোকের প্রসংশা লাভের উদ্দেশ্যে কার্য করা হয়। সে স্থলে রিয়া অতিশয় জঘন্য। যেমন জনসমাজে মিশিয়ে অপরের শ্রদ্ধা ও প্রশংসা অর্জনের আশায় নামাজ পড়ে এবং রোজা রাখে, কিন্তু নির্জন থাকলে নামাজ পড়ে না এবং রোজাও রাখে না। এ জাতীয় রিয়ার জন্য পরকালে ভীষণ শাস্তি ভোগ করতে হবে। (২) মানুষের শ্রদ্ধা আকর্ষণের সংকল্পই প্রবল, তবে সওয়াবের আশাও আছে। এরূপ ব্যক্তি জনসমাজে অতি আগ্রহের সহিত এবাদত করে, কিন্তু নির্জনে হলে হয়ত করত না। এরূপ রিয়া প্রায় প্রথম শ্রেণির রিয়ার ন্যায় জঘন্য। সামান্য সওয়াবের সংকল্প আল্লাহপাকের ক্রোধ অসন্তোষ হতে তাকে রক্ষা করতে পারবে না। (৩) সওয়াবের নিয়ত প্রবল থাকলে লোক নির্জনেও নামাজ-রোজা করে থাকে, কিন্তু অন্তরে রিয়ার ভাব থাকা বশত অপর ব্যক্তিকে দেখলে এবাদতের মধ্যে আনন্দ ও উৎসাহ পেয়ে থাকে। এরূপ এবাদত বাতিল এবং এর সওয়াব সম্পূর্ণ ভাবে বিনষ্ট হবে না; বরং যে পরিমাণ রিয়ার নিয়ত থাকবে, সে পরিমাণ আজাব ভোগ করতে হবে কিংবা সওয়াবও কমে যেতে পারে। (৪) উভয়বিধ নিয়ত সমান সমান হলে সওয়াব ও আজাব সমপরিমাণে বিভক্ত হতে পারে। মানুষ এ জাতীয় রিয়ার ফলে একেবারে নিরাপদে নিষ্কৃতি পাবে না; বরং রিয়ার পরিমাণে শাস্তি ভোগ করতে হবে।
নেক কাজ ধ্বংস করে রিয়া : রিয়াকারীর মনোভাব কখনো কখনো এবাদতের প্রারম্ভে, কোন কোন সময় এবাদতের মধ্যে আবার কোন কোন সময় এবাদতের পরক্ষণে উদিত হয়। এবাদতের প্রারম্ভে অন্তরে রিয়ার মনোভাব উদিত হলে এবাদতকে সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট করে ফেলে। তাই নিয়তের অভাবে এবাদতও বিনষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু যদি মূল এবাদতের মধ্যে রিয়া না হয়ে আনুষঙ্গিক কোন কার্যে লোক দেখানো মনোভাব থাকে, তবে মূল এবাদত নষ্ট না হয়ে কেবল সেই আনুষঙ্গিক কার্যের সওয়াব বিনষ্ট হবে। খালেস নিয়তে নামাজ সমাধা করার পরে যদি কারো অন্তরে রিয়ার ভাব উদয় হয় লোকের শ্রদ্ধা অর্জনের ইচ্ছায় যদি উক্ত এবাদত প্রকাশ করে ফেলে, তবে মূল নামাজ বিনষ্ট হবে না, কিন্তু লোকেরা শ্রদ্ধা অর্জনের বাসনায় এবাদত প্রকাশ করার দরুন আজাব ভোগ করতে হবে। শুধু মানুষের শ্রদ্ধা ভক্তি অর্জনের উদ্দেশ্যে যতপ্রকার সৎকার্যই করা হোক না কেন একটি সৎকার্যেরও সওয়াব মিলবে না, বরং এর ধরুন কঠোর শাস্থি ভোগ করতে হবে।
সময় ও কারণ বিশেষে এবাদত প্রকাশ করা যায় : মহান আল্লাহপাক বলেছেন, “যদি তোমরা সদকা প্রকাশ্যভাবে দান কর, তবে তা অতি উত্তম কার্য। আর যদি তা গোপন রাখ এবং ফকিরদিগকে দান কর, তবে তা তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক। ”একদিন প্রিয় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিছু অর্থের প্রয়োজন হলে আনসার গোত্রের একজন সাহাবী থলিপূর্ণ কিছু অর্থ এনে হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর সামনে হাজির করলেন। তার দেখা দেখি অন্যান্য সাহাবীরাও নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী ধন-সম্পদ এনে নবীজির খেদমতে হাজির করলেন। তা দেখে হুজুর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন- অপর লোকেরাও দেখাদেখি অনুসরণ করবে, এ উদ্দেশ্যে যে ব্যক্তি কোন সৎপ্রথা প্রবর্তন করে, সে ব্যক্তি নিজের কৃতকার্যের সওয়াব লাভ করবে এবং অনুসরণকারী লোকদের সৎকার্যের সমপরিমাণ সওয়াব ও পুরস্কার প্রাপ্ত হবে।
সৎ কার্য প্রকাশ্যভাবে করার নিয়ম : (১) এবাদত বা সৎকার্য দেখে অপর ব্যক্তি অনুসরণ করার সম্ভাবনা থাকলে সৎকার্য প্রকাশ করা আবশ্যক। অন্যথায় প্রকাশ্যভাবে না করাই শ্রেয়। (২) নিজের অন্তরের প্রতি গভীর দৃষ্টি করে উত্তমরূপে লক্ষ্য রাখতে হবে যে, অন্তরে রিয়ার মনোভার আছে কিনা। কারো অন্তরে যদি বিন্দুমাত্র রিয়ার ভাব থাকে, তবে তার পক্ষে প্রকাশ্যে এবাদত না করা উচিত। রিয়ার ভাব নেই এমন ব্যক্তিদের উচিত প্রকাশ্যভাবে এবাদত করে মানুষকে এবাদতের প্রতি আগ্রহ করা।
রিয়া থেকে মুক্তি লাভের উপায় : এবাদতকারী ব্যক্তির অন্তরে রিয়া অপেক্ষা জঘন্যতম আর কোন রোগ জন্মিতে পারে না। রিয়া দূর করার জন্য এবাদতকারীকে আপ্রাণ চেষ্টা করা কর্তব্য। এ জঘন্যতম রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করা অপরিহার্য। মানুষ ইহজগতে যা কিছু করে, তা শুধু কিছুক্ষণের আরাম ও সুখ শান্তির জন্যই করে থাকে। এটা মানুষের স্বভাব। কিন্তু মানুষ যখন নিশ্চিতরূপে জানবে যে, ইহলোকে ক্ষণিকের আরাম ও সুখ শান্তির জন্য মানুষ যা কিছু করছে পরকালে এ কাজের জন্য কঠিন দুঃখ ও যন্ত্রণাময় আজাব তাকে ভোগ করতে হবে। তখন অবশ্যই ক্ষণস্থায়ী সুখাস্বাদনের মোহ পরিত্যাগ করা মানুষের পক্ষে খুবই সহজ হয়ে পড়বে। যেমন মধুকে বড় তৃপ্তিকর, সুস্বাধু ও লোভনীয় পানীয় দ্রব্য বলে সকলেই জানে এবং দেখামত্র পান করার জন্য সকলেই একান্ত আগ্রহান্বিত হয়ে উঠে। যদি জানতে পারে মধুতে বিষ মিশানো আছে, তবে মধু দেখে পান করার দুর্দমনীয় লোভ হওয়া সত্ত্বেও বিষের ক্রিয়ায় প্রাণ হারাবার ভয়ে উক্ত মধু পানের লোভ সংরক্ষণ করা প্রত্যেক মানুষের পক্ষেই সহজ হয়ে পড়বে। মানুষ এবাদতে নিজের সুখ্যাতি ও প্রশংসা কামনা বা মানুষের নিকট থেকে কোন কিছুর পাওয়ার উদ্দেশ্যে যেন না করে বরং সমস্ত এবাদত যেন আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করে। পরকালে এ রিয়ার কারনে কতই না অপমান পেতে হবে। মহাবিচারের দিন সমস্ত জিন ও মানুষের সামনে ফেরেশতাগণ রিয়াকার ব্যক্তিকে তিরস্কার করবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন