বিচার নিয়ে আজও হতাশ পরিবার
মোঃ ফজলুর রহমান, হবিগঞ্জ থেকে : ছাত্রজীবনে ছিলেন অদম্য মেধাবী। পেশাগত জীবনে ছিলেন সবার থেকে এগিয়ে। রাজনীতিরও শুরু শীর্ষ থেকে। জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে চেষ্টা করতেন সবার পাশে থাকার। ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি শীতের বিকেলে তিনি এসেছিলেন প্রিয় মানুষগুলোর কাছে। কিন্তু নির্মম গ্রেনেড হামলায় তাকে চলে যেতে হয়েছে পৃথিবী ছেড়ে। দেশ হারায় শাহ এএমএস কিবরিয়াকে।
আজ থেকে ১২ বছর আগের সেই ঘটনা এখনো নাড়া দেয় সবাইকে। আলোচিত বৈদ্যের বাজার ট্রাজেডীর কথা ভুলতে পারেননি কেউ। সেদিনের নির্মম হামলায় আহতরা এখনও কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। বিভাষিকাময় সেই দিনের কথা মনে করে আঁতকে উঠেন তারা।
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি বিকেলে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে ঈদ পরবর্তী এক জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন তৎকালীন হবিগঞ্জ-৩ আসনের এমপি ও সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া। বক্তব্য শেষে যখন মঞ্চ থেকে নেমে সহকর্মীদের নিয়ে বৈদ্যের বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গেইটে আসেন হঠাৎ করেই আর্জেস গ্রেনেডের আঘাতে তিনিসহ অনেকেই ক্ষতবিক্ষত হন। শাহ এএমএস কিবরিয়া ও তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সভাপতি অ্যাড. মোঃ আবু জাহিরের প্রচ- রক্তক্ষরণ কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছিল না। স্থানীয় প্রশাসন ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করা হয় হেলিকপ্টারের জন্য। কিন্তু দ্রুত তার ব্যবস্থা করতে না পেরে সিদ্ধান্ত হয় অ্যাম্বুলেন্সে রওয়ানা দেয়ার। একই অ্যাম্বুলেন্সে করে কিবরিয়া ও আবু জাহিরকে ঢাকার উদ্দেশ্যে পাঠানো হয়। পথিমধ্যে আরো একটি অ্যাম্বুলেন্স পেলে তাদেরকে আলাদাভাবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঢাকা যখন অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছায় তখন চিকিৎসক শাহ এএমএস কিবরিয়াকে মৃত ঘোষণা করেন। গ্রেনেড হামলায় আরও মৃত্যু হয় ভাতিজা শাহ মনজুরুল হুদা, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলী প্রাণ হারান। আহত হন কমপক্ষে ৭০ নেতাকর্মী।
সিআইডি’র তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান মামলাটি তদন্ত করে ১০ জনের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২০ মার্চ ১ম অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ওই অভিযোগপত্রে তৎকালীন জিয়া স্মৃতি ও গবেষণা পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি আবদুল কাইয়ুম, জেলা বিএনপির কর্মী ও ব্যাংক কর্মকর্তা আয়াত আলী, কাজল মিয়া, জেলা ছাত্রদলের সহ-দপ্তর সম্পাদক সেলিম আহমেদ, জিয়া স্মৃতি গবেষণা পরিষদ জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক সাহেদ আলী, বিএনপি কর্মী তাজুল ইসলাম, বিএনপি কর্মী জয়নাল আবেদীন জালাল, ইউনিয়ন বিএনপি নেতা জমির আলী, ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জয়নাল আবেদীন মোমিন ও ছাত্রদল কর্মী মহিবুর রহমানকে অভিযুক্ত করা হয়। আব্দুল কাইয়ুমকে স্বীকারোক্তির জন্য ৪৭ দিন রিমান্ডে নেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।
অভিযোগপত্র দেয়ার পর মামলার বাদী অ্যাডভোকেট আবদুল মজিদ খান ২০০৬ সালের ৩ মে সিলেট দ্রুত বিচার আদালতে না-রাজি আবেদন করেন। আদালত তার আবেদন খারিজ করলে ১৪ মে তিনি হাইকোর্টে আপিল করেন।
আবেদনের প্রেক্ষিতে মামলার মূল নথি সিলেট দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে থাকায় বিচারক রাজিব কুমার বিশ্বাস উপনথির মাধ্যমে আবেদনটি সিলেটে পাঠানোর নির্দেশ দেন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি হত্যাকা-ের অধিকতর তদন্তের অভিযোগপত্রের নারাজি আবেদন গ্রহণ করেন সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক দিলীপ কুমার বণিক। তিনি সিনিয়র পুলিশ অফিসারের মাধ্যমে মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য নির্দেশ দেন।
২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হবিগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট রোকেয়া আক্তারের আদালতে কিবরিয়া হত্যা মামলার ৩য় সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডি সিলেট অঞ্চলের তৎকালীন সিনিয়র এএসপি মেহেরুন নেছা পারুল। অভিযোগপত্রে নতুন ১১ জনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অন্তর্ভুক্ত আসামীরা হলেন সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জ পৌর মেয়র জি কে গউছ, বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, মুফতি আব্দুল হাই, মুফতি তাজ উদ্দিন, মুফতি সফিকুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, বদরুল, মহিবুর রহমান, কাজল আহমেদ, হাফেজ ইয়াহিয়া। একই সাথে পূর্বের চার্জশীটভুক্ত ইউসুফ বিন শরীফ, আবু বক্কর আব্দুল করিম ও মরহুম আহছান উল্লাহকে চার্জশীট থেকে অব্যাহতির আবেদন করেন। ৩ ডিসেম্বর মামলার শুনানিকালে অভিযোগপত্রে ত্রুটির কথা উল্লেখ করে সংশোধিত অভিযোগপত্র জমা দেয়ার আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা। এ প্রেক্ষিতে ২১ ডিসেম্বর সংশোধিত অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আদালত। একই সাথে পলাতক আসামীদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারির আদেশ দেয়া হয়। ২৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রে ৩৫ জনকে আসামী ও ১৭১ জনকে সাক্ষী করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা মেহেরুন নেছা পারুল।
এদিকে হত্যা মামলাটি সিলেটের দ্রুত বিচার আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। বিস্ফোরক মামলাটিও বিচারের জন্য প্রস্তুত হয়েছে।
বৈদ্যার বাজার ট্র্যাজেডিতে অনেকই এখনও পঙ্গু অবস্থায় জীবন যাপন করছেন। সেই ভয়াল স্মৃতি এখনও তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাড মোঃ আবু জাহির এমপি বলেন, আমি বেঁচে থাকার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভারতে গিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ হলেও এখনও আমার গায়ে গ্রেনেডের শত স্পিøন্টার। পায়ে স্টিল লাগানো। তবে আল্লাহর রহমতে বেঁচে আছি এটাই বড় কথা। তিনি দ্রুত বিচার কাজ শেষ হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
গ্রেনেড হামলায় নিহত আব্দুর রহিমের স্ত্রী আফিয়া খাতুন জানান, তিনি সরকারের কাছে কিছুই চান না। মৃত্যুর আগে তার স্বামী হত্যার বিচার দেখে যেতে চান। নিহত ছিদ্দিক আলীর ছেলে কুদ্দুছ মিয়া জানান, বিচার কাজ শুরু হলেও কবে শেষ হবে এ নিয়ে তার পরিবার হতাশ।
শাহ এ এম এস কিবরিয়ার ছেলে ড. রেজা কিবরিয়া বর্তমানে বিদেশে আছেন। তবে তার আমেরিকা প্রবাসী মেয়ে অধ্যাপক ড. নাজলী কিবরিয়া দেশে এসেছেন। তিনিও মামলার বিচার দ্রুত শেষ করার দাবী জানান।
মৃত্যুবার্ষিকীর কর্মসূচি : ২৭ জানুয়ারি সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ১২তম মৃতুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা ও হবিগঞ্জে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোহিতা, শোক র্যালি, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভা। পৃথকভাবে এ কর্মসূচিগুলো পালন করবে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠন এবং কিবরিয়া স্মৃতি সংসদ। এছাড়া ঢাকায় মরহুমের গোরস্থানে সকাল ৯টায় পুষ্পস্তবক অর্পণ করবে কিবরিয়া পরিবার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন