শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

মুসলিম ইতিহাসে অমুসলিমদের সঙ্গে সম্পর্ক

| প্রকাশের সময় : ২৯ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক : ইতিহাস বিকৃতি একট অমার্জনীয় অপরাধ। অথচ তা চলে অবিরত। কখনও ইতিহাস লুকানো হয়, কখনও বিকৃতি করা হয়। পাশ্চাত্যের কিছু বিদ্যান এ সব করেন। তবে উপমহাদেশেও তা কম হয় না। আর এর শুরু হয় এখানে বৃটিশদের আসার পরে। এর ছবক তারা আমাদের প্রতিবেশীদেরও দিয়ে যায়। আমরা আজ তিনজন প্রখ্যাত মুসলমান শাসকের হিন্দু নীতি নিয়ে কিছু উদাহরণ টানব। এসব তথ্য আমরা সংগ্রহ করেছি আব্দুুল্লাহ মামুন আরিফ আল মান্নানের চমৎকার বই ‘ইসলাম সম্পর্কে অমুসলিমদের ভুল ধারণা’ বই থেকে।
মানবতার মহান প্রতীক বাদশাহ্ নাসিরুদ্দিন
বিশাল রাজ্যের অধিপতি হয়েও বাদশাহ্ নাসিরুদ্দিন ফকিরের মতো জীবনযাপন করতেন। বাদশাহ্র দরবার ছিলো সবার জন্য উন্মুক্ত। সবসময় তিনি সুযোগ দিতেন অন্য ধর্মাশ্রয়ীদের। সব রকমের সাহায্য-সুবিধা তাদের দিতেন। একদিনের ঘটনা। একজন লোক এসেছে। তার সাথে আর একজন দুগ্ধপোষ্য শিশু। খোদ বাদশাহ্রে সাথে দেখা করতে চায়, দেখা না করে কিছুতেই যাবে না। বাদশাহ্ তড়িঘড়ি হুকুম দিলেন, ওদের খাবার দিতে। বেগমকে এসে বললেন, তার নিজের জন্য যে রান্না তা এক্ষুণি দিয়ে দাও। বেচারীরা বহুদূর থেকে বুঝি এসেছে। ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে কোলের শিশুটি।
কিন্তু আগন্তুক সে খাবার খেতে রাজি নয়। সে জানালো, সে জাতিতে হিন্দু। বাদশাহ্-বাড়ির পাক খেলে তারা বিপাকে পড়বে।
বাদশাহ্ বললেন, বেশ তাহলে তোমরা রান্না-বান্নার আয়োজন কর। যা যা প্রয়োজন লাগে হাজির হবে। একটুখানি শুধু কষ্ট করতে হবে।
আগুন্তক আবার বলল, তাও হয় না। আমরা কুলীন ব্রাহ্মণ। আর আপনি দাস মুসলমান। আপনার ঘরে খাওয়া মানে আমার জাত যাওয়া।
বাদশাহ্ এক মুহূর্তে ভাবলেন। পরে বললেন, আচ্ছা ময়রার দোকান থেকে মিষ্টি আনুক। তোমরা খাওয়া-দাওয়া করো। তারপর কথা হবে।
খাওয়ার পর অবশেষে আগন্তুক তার আরজি পেশ করলো। তার নালিশ জনৈক রাজপোষ্যের বিরুদ্ধে। তার ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে দিয়েছে। তার বাড়িঘর ছারখার করে ফেলেছে। রাজদরবারে এর সুবিচার চাই।
বাদশাহ্ তখনই তৈরি হয়ে নিলেন। সরেজমিনে তিনি সব জানতে চান। তারপর কথিত আসামিকে কঠোর সাজা দেবেন। আগন্তুক হয়তো এতোটা ভাবতে পারেনি বাদশাহ্ নিজে যাবেন বিচার করতে, এ তার কল্পনার অতীত।
বাদশাহ্ সেখানে পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে সাক্ষ্য প্রমাণ নিলেন। জনে জনে জিজ্ঞেস করলেনÑ কি ব্যাপার, কি ঘটেছে।
লোকে বলল, ও লোকটা শঠ। শয়তান। পরের সাথে প্রতারণা করা ওর পেশা। এমনি করে ওর দিন গুজরান হয়। স্বয়ং বাদশাহ্কে তকলিফ দেয়ার জন্য লোকে ততোধিক ধিক্কার দিল। বাদশাহ্র কাছে তারা করজোড়ে ক্ষমাপ্রার্থী, বাদশাহ্ যেন ক্ষমা করেন।
তাদের সবাইকে হতচকিত করে দিয়ে বাদশাহ্ বললেন, চলো ভাই, তোমার বাড়িতে বসি। সেই সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। তোমার বাড়িতে দুটো মুখে দিই।
বেশিক্ষণ বাদশাহ্ অবশ্য অপেক্ষা করলেন না। তার যে এখনো অনেক কাজ পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়া চাই। ব্রাহ্মণের বাড়িতে বসে বাদশাহ্ তাকে নিরিবিলি বললেন, তোমার কোন ভয় নেই। দোষ তোমার নয়, আমার। আমি বাদশাহ্ হয়ে তোমার অভাব মেটাতে পারিনি। আল্লাহ্ আমাকে মাফ করবেন কিনা জানি না। তবে তুমি আমাকে মাফ করো।
ব্রাহ্মণ তখন লুটিয়ে পড়েছে বাদশাহ্র পায়ে। বাদশাহ্ তাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন, ছিঃ ভাই, ওঠো। আমার যে কিছুই খাওয়া হয়নি। কই কিছু খেতে দাও। ঘরে যা আছে তাই আমি খাবো। আর বসবার সময় নেই।
ব্রাহ্মণ কেঁদে-কেটে বলে, আমি অশুচি-অপবিত্র। আমার হাতে আপনি খাবেন। বাদশাহ্ হেসে বলেন, ছিঃ ভাই মানুষ হয়ে মানুষকে ঘৃণা করে। ইনকার করে। ইসলাম তা বলে না। ধর্মের বিধান তা নয়।
বাদশাহ্ তারপর সঙ্গে নিয়ে আসলেন সেই ব্রাহ্মণকে। তাকে বুঝিয়ে বললেন, সে যেনো আর কোনো গর্হীত কাজ না করে। তার যখন যা প্রয়োজন বাদশাহ্র কাছে পাবে।
বখতিয়ার খিলজীর মহানুভবতা
বিজয়ী বীর বখতিয়ার খিলজী তখন বাংলা শাসন করছেন। রাজা লক্ষ্মণ সেন পালিয়ে গেছেন। মুসলমানদের শাসনে রাজ্যের হিন্দুরা বেশ সুখেই আছে। রাজ্যের সুখের সংবাদ চাপা থাকলো না। সর্বত্র সুখের সংবাদ ছড়িয়ে গেলো। পৌঁছলো রাজা লক্ষ্মণ সেনের কানে। রাজমাতা শুনলেন, রানী শুনলেন। নিতান্ত অবিশ্বাসের মাঝেও বিশ্বাস করতে বাধ্য হলেন। এরই মধ্যে বিশ্বস্ত প্রমাণ তারা পেয়েছেন। বিশ্বাস না করে পারেন?
লক্ষ্মণ সেনের একমাত্র কন্যা শুনে উতলা হয়ে উঠেছেন। তার স্থির সংকল্প তিনি ফিরে যাবেন সাধের নবদ্বীপ ধামে। রাজবাড়ি না হোক, রাজপথেই বাসা বাঁধবেন।
একদিন সত্যি সত্যিই দেখা গেলো রাজবাড়িতে কে যেনো চুপিসারে ঢুকছে। প্রহরী রুখে দাঁড়ালো, কে, কি তার পরিচয়। রাজদুহিতা নির্ভয়ে জানালেনÑ যা বলার তিনি রাজার কাছে বলবেন। তার সাথে তিনি সাক্ষাৎ করতে চান। দ্বাররক্ষক তাকে সম্মানে নিয়ে চললো রাজ সন্দর্শনে। সংবাদ নিয়ে বললো, একটু অপেক্ষা করতে। একটু পরে উনি আসছেন। রাজদুহিতা দেখতে পেলেন কে যেনো নামাজ পড়ছেন। খোলা দরজা দিয়ে তাকে দেখা যাচ্ছে। সৌম্য প্রশান্ত বদন। সুললিত কণ্ঠস্বর।
এরপর রাজদুহিতার আরো অবাক হবার পালা। নামাজ শেষে সেই ব্যক্তিই তার সামনে হাজির হয়েছেন। তিনি বিন¤্রভাবে তাকে আহ্বান জানাচ্ছেন অন্দরে আসতে।
অসংকোচে রাজদুহিতা বললেনÑ তিনি রাজার সাথে সাক্ষাৎ করবেন। তার বিশেষ প্রয়োজন।
সরদার ঘোড়সওয়ার আবার আপ্যায়ন জানালেনÑ আসুন, ভিতরে আসুন। সে কণ্ঠে কি যাদু ছিলো কে জানে। রাজদুহিতা সম্মোহিতের মতো তার পিছু অনুসরণ করলেন। এ বাড়ির সবকিছুই তার নখদর্পণে। সব অলিগলি, আনাচকানাচ তার কতো চেনা। কতো না আপন। সেই বিশাল হলঘরে বসে রাজদুহিতা অবাক হলেন। সে আগের মতই সব সাজানো গোছানো আছে। সবকিছু পরিপাটি ছিমছাম। এ কথা সে কথার পর রাজদুহিতা তাড়া দিলেনÑ রাত হয়ে এলো। আমি এবার ফিরে যাবো। একবার শুধু রাজার দেখা চাই।
কথায় কথায় রাজদুহিতা অবশ্য মুগ্ধ হয়ে গেছেন। কথার ফাঁকে ফাঁকে প্রকাশ করেছেন তার পরিচয়। আনন্দের আতিশয্যে এতোটুকু গোপন রাখেননি। কথার পিঠেই কথা দিয়ে সরদার ঘোড়সওয়ার দুঃখ প্রকাশ করলেন সত্যিই রাত হয়েছে তার খেয়াল হয়নি। তিনি অনুতপ্ত।
এবার সাদর আহ্বান এলোÑ আপনার বিশ্রামের প্রয়োজন। আর আপনার আহারের আয়োজন হয়ে গেছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। তারপর রাজদুহিতাকে হতচকিত করে দিয়ে সরদার  ঘোড়সরওয়ার তার হাতে তুলে দিলেন চাবির গোছা। পরম প্রত্যয়ের সুরে বললেনÑ যে ঘরে ইচ্ছা আপনি থাকতে পারেন। যে ঘর আপনার পছন্দ, সেই ঘর বেছে নিন। আর যে পাচক-পাচিকাকে প্রয়োজন তাকে দিয়েই রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করুক। এ ঘর-দোর আপনাদের। আমি রক্ষণাবেক্ষণ করছি মাত্র। বিনয়ে বিগলিত রাজদুহিতার বিস্ময়ের ঘোর তখনো কাটেনি। তিনি বেশ বুঝতে পেরেছেন, যাকে খুঁজছেন তাকে পেয়েছেন। শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে যিনি সবার হৃদয় জয় করেছেন, এই সেই বিজয়ী বীর বখতিয়ার খিলজী। নদীয়া নবদ্বীপ ধাম অভিযানের সরদার ঘোড়সওয়ার, যার নাম লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে আছে। তারপরে এ কথা সে কথার পর রাজদুহিতা সহাস্যে বলেনÑ আমরা যে অলক্ষে বলি আপনি যবন, তা জানেন?
তেমনি হাসিমুখেই বখতিয়ার খিলজী জানালেনÑ জানি।
রাজদুহিতা বললেনÑ আপনি মুসলমান। আর আমি হিন্দুর ঘরের মেয়ে। বরং বলতে পারেন আপনার চির শত্রুর কন্যা। তবু আমরা নতুন করে জানলামÑ আপনি সত্যি মহান, মহানুভব। আপনার তুলনা হয় না। আপনি খাঁটি মানুষ। খাঁটি মুসলমান। আপনাকে সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি। বখতিয়ার খিলজীর চোখে-মুখে তখন জয়ের গৌরব। পবিত্র ইসলামের পূত বাণী স্মরণ করে তিনি বলেনÑ আল্লাহর কাছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ নেই। সব মানুষকে সমানভাবে ভালোবাসার নাম ইসলাম। আমি তারই একজন নগণ্য খাদেম। ইসলামের শিক্ষাই আসল শিক্ষা।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন