মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

অপতৎপরতা রোধে আলেম সমাজ

| প্রকাশের সময় : ৩১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

ড. আহমদ আবদুল কাদের : আলেম সমাজ আমাদের সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এদেশে ইসলাম আবির্ভাবের সময় থেকেই আলেম সমাজের আবির্ভাব। এদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই আলেম সমাজ সামাজিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রতি যুগেই আলেমগণ সমাজে দ্বীনি শিক্ষার প্রচার, প্রসার ও প্রতিষ্ঠা এবং সংরক্ষণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তৎসঙ্গে যে কোন ইসলামবিরোধী শক্তির মোকাবেলায় তারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। তাছাড়া মুসলিম ভূখ-বিরোধী তথ্য দেশবিরোধী যে কোন আগ্রাসী শক্তির মোকাবেলায়ও আলেমগণ সাধ্যমত অংশ নিয়েছেন। মূলত আলেমগণ সমাজের অভিভাবক হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছেন।
এদেশে সুলতানী আমল ও মুঘল আমলে উলামা সমাজ সামাজিক শক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। একমাত্র সম্রাট আকবরের শাসনামলেই অত্যাচার ও জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে উলামা সমাজকে দুর্বল ও অকর্মন্য করার পদক্ষেপ নেয়া হয়। আলেম সমাজের ব্যতিক্রম হিসেবে শাইখ মোবারক ও তার পুত্রদ্বয় আবুল ফজল ও ফাইজীর মতো দরবারি আলেম নিকৃষ্টতম ভূমিকা পালন করে (যেমন আজকেও কতিপয় আলেম নামধারী লোক একই ভূমিকা পালন করছে। যদিও আকবরের আমল ও জাহাঙ্গীরের আমলের প্রাথমিক কয়েকটি বছর উলামা সমাজের সংগ্রামী ভূমিকা কঠোরভাবে দমন করা হয়। তা সত্ত্বেও আলেম সমাজের ধর্মীয় সামাজিক ভূমিকা অব্যাহত ছিল। বিশেষ করে শায়খ আহমদ সেরহিন্দ (রহ.) (মুজাদ্দেদে আলফেসানী)-এর ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রচেষ্টার ফলে আকবর সৃষ্ট ‘দ্বীনি ইলাহী’র ফেতনা নির্মূল হয়ে যায়।
ব্রিটিশ আমলে প্রথম একশ বছর আলেম সমাজই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের কার্যকর ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রহ.)-এর প্রবর্তিত আন্দোলন, সৈয়দ আহমদ বেরেলভী (রহ.) ও শাহ ইসমাঈল (রহ.)-এর আন্দোলন, বাংলায় তিতুমীর (রহ.) ও হাজী শরিয়তুল্লাহ (রহ.) আন্দোলন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। ধর্মীয়-সামাজিক ক্ষেত্রেও এসব আন্দোলন আলোড়ন সৃষ্টি করে। এরপর ব্রিটিশের অত্যাচার, নির্যাতন ও ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিতে আলেম সমাজ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়ে। তারপরও ব্রিটিশ শাসনের পরবর্তী নব্বই বছর আলেম সমাজের সামাজিক ভূমিকা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্বদানের প্রধান ভূমিকায় না থাকলেও সামাজিক শক্তি হিসেবে তাদের ভূমিকা বরাবরই অব্যাহত ছিল। হাজী এমদাদুল্লাহ মোহাজেরী মক্কী (রহ.) ও মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহ.)-এর দেওবন্দ মাদ্রাসাকেন্দ্রিক সহিহ্্ দ্বীনি শিক্ষা আন্দোলন। মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী (রহ.)-এর নেতৃত্বে রেশমী রুমাল আন্দোলন, মাওলানা মোহাম্মদ আলী (রহ.) ও মাওলানা শওকত আলীর (রহ.)-এর নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ শাসনে প্রবর্তিত পাশ্চাত্যের শিক্ষাব্যবস্থার ফলে প্রথমবারের মতো এ উপমহাদেশে দু’ধরনের শিক্ষিত শ্রেণীর জন্ম হয় ঃ  ১. উলামা শ্রেণী ও ২. আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণী। এর ফলে সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রগুলোতে আলেম সমাজের ভূমিকা ক্রমশই দুর্বল হয়ে আসতে শুরু করে। আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণীর ভূমিকা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। তারপরও উলামা সমাজের ধর্মীয় সামাজিক ভূমিকা অব্যাহত ছিল। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তাদের ভূমিকা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ.), মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.), মাওলানা শিব্বির আহমদ উসমানী (রহ.), মুফতী মুহাম্মদ শফি (রহ.)-এর অবদান অস্বীকার করা যাবে না। পাকিস্তান আমলে আলেম সমাজ দেশ গঠনে এবং বিভিন্ন ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যু কার্যকর ভূমিকা রাখার চেষ্টা করেন। সেই সময়ে যেসব ওলামায়ে কেরাম নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মাওলানা জাফর আহমদ উসমানি (রহ.), মাওলানা আতাহার আলী (রহ.), মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ.), মাওলানা সিদ্দিক আহমদ (রহ.) প্রমুখ ওলামায়ে কেরাম।
বাংলাদেশ আমলের প্রাথমিককালে আলেম সমাজের ভূমিকা দুর্বল করার ষড়যন্ত্র ও অপচেষ্টা করা হয়। কিছুদিনের মধ্যেই তারা আবার ঘুরে দাঁড়ান এবং সামাজিক শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করা শুরু করেন। জিয়ার আমলে সংবিধানে ‘আল্লাহর প্রতি আবিচল আস্থা ও বিশ্বাস’ মূলনীতিটি সংযোজনের বিষয়টির স্বপক্ষে গণভোটে আলেম সমাজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের আলেম সমাজ ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, শিক্ষাব্যবস্থা, দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। বিশেষ করে আশির দশকে হযরত হাফেজ্জী হুজুরের (রহ.) আন্দোলন উলামা সমাজের মধ্যে ও সাধারণ দ্বীনদার মানুষের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। মাওলানা আবদুল রহীম (রহ.), মাওলানা আবদুল জাব্বার (রহ.), মাওলানা ফজলুল করীম (রহ.) প্রমুখ আলেমের নেতৃত্বে ১৯৮৭ সালে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে জনগণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে। উলামা সমাজ নব্বইর দশকের শুরুর দিকে নাস্তিক-মুরতাদবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে বিতর্কিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করে। পরবর্তী সময়ে শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.) আহূত বাবরী মসজিদ অভিমুখে লংমার্চ ব্যাপক সাড়া সৃষ্টি করে। বসনিয়া মুসলিম গণহত্যার প্রতিবাদে মুজাহিদ সংগ্রহ অভিযান জাতির মধ্যে আলোড়ন তোলে। তাছাড়াও ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে পানি আন্দোলনও দেশের জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২০০১ সালে ফতোয়াবিরোধী রায়ের প্রতিবাদে যে ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি হয় তার ফলশ্রুতিতে দীর্ঘসময় পর হলেও হাইকোর্ট ফতোয়ার অধিকার নিশ্চিত করে রায় প্রদান করেন। এই সময়ে আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন মুফতী ফজলুল হক (রহ.), মাওলানা মুহিউদ্দিন খান, দা.বা. প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় আলেম। এছাড়াও বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামে দেশের সার্বভৌমত্ববিরোধী শান্তিচুক্তিবিরোধী আন্দোলনে দেশের আলেম সমাজের সোচ্চার ভূমিকা জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এসব ক্ষেত্রে বায়তুল মোকাররমের সাবেক খতিব মাওলানা ওবায়দুল হক (রহ.)সহ শীর্ষস্থানীয় সকল ওলামায়ে কেরাম জাতির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব সংরক্ষণ, দেশের নারী শিক্ষা ও উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, উন্নতর সমৃদ্ধ, অর্থনীতি, শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার প্রতিষ্ঠা, একটি দুর্নীতিমুক্ত ও ইনসাফপূর্ণ সামাজ গঠন, ধর্মীয়, নৈতিকতা ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানে সমৃদ্ধ একটি উন্নত শিক্ষানীতি প্রণয়নসহ একটি আলোকিত সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে এক সুদূরপ্রসারী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে হেফাজতকে বা হেফাজতের পৃষ্ঠপোষকতায় একটি আরো ব্যাপক ও গণসম্পৃক্ত আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তাহলে হেফাজতের আন্দোলন একটি সফল পরিণতি পাবে। দেশের জনগণ সেদিনের প্রতীক্ষায় দিন গুনছে। আমরা সবাই আরাধ্য লক্ষ্যপাণে তাকিয়ে আছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফিক দিন যাতে করে পীর আওলিয়ার দেশ, লক্ষ শহীদের রক্তপাত এ পুণ্যভূমি ও আলেম-ওলামার পদচারণায় মুখরিত বাংলাদেশকে একটি ইসলামী সামাজ ও রাষ্ট্রে পরিণত করতে পারি।
লেখক: মহাসচিব, খেলাফত মজলিস

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (2)
কামরুল হিমু ৩১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:২২ পিএম says : 0
লেখক এখানে সংক্ষিপ্ত করেছেন। আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আছে। আমি আশা করবো আরো ব্যাপক ভিত্তিক আলোচনা করবেন। এদেশের আলেম সমাজের মধ্যে উম্মাহর ঐক্য সৃষ্টির একটি মহান উদ্যোগ ছিল-- হয়তো নিজেদের ভুলে সেটা মিলিয়ে গেছে। সেসব ভুল থেকে শিক্ষা না নিলে, প্রকৃত ঐক্য গঠন করতে না পারলে, আল্লাহর রজ্জুকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে না ধরলে বিফল হতেই তবে। পদদলিত-অপমানিত হতেই থাকবেন। আর সেজন্য কীরকম মনোভঙ্গি, কী ধরনের মেধা ও মনীষা দরকার সেটাও একটু ভাবুন। এখন তো অঢেল সময় অপচয় হচ্ছে। একটু ভিত্তিটা গড়ে নেয়া যাক। তাই না ভাই। আধুনিক সময়ের চলমান দুঃসময়ের চ্যালেঞ্জ কীভাবে উৎরানো যাবে তার যোগ্য না হলে তো আবারো বিপর্যয়....
Total Reply(0)
৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১১:২৩ পিএম says : 0
উলামায়ে কেরামকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন