মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

সুখের সংসার বিনির্মাণে স্বামী-স্ত্রী

| প্রকাশের সময় : ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুফতী পিয়ার মাহমুদ

॥ এক ॥
তাবৎ দুনিয়ার সকল মানুষের আশা থাকে সুখি সমৃদ্ধ দাম্পত্য জীবনের। কারণ দাম্পত্য জীবনে অশান্তি ও কলহ থাকলে তা পরিণত হয় সাক্ষাৎ নরকে। যার নজির আমরা প্রত্যক্ষ করছি দিবারাত্রি। আর যদি দাম্পত্য জীবন সুখের হয় তাহলে তা পরিণত হয় সুখের স্বর্গে। এ জন্য স¦ামীর প্রয়োজন নিজ অবস্থান ও দায়িত্ব কর্তব্য সম্পর্কে মাত্রাসচেতনতা আর স্ত্রীরও কর্তব্য নিজ মযার্দা ও দায়-দায়িত্বের মাত্রাজ্ঞান। এরপর সে অনুসারে জীবন নির্বাহ করলে এবং দ্বিপাক্ষিক আচরণে তার চর্চা করলে একটি শান্তিপূর্ণ ও সুখের সংসার গড়ে উঠতে পারে। এ জন্য প্রথমেই দরকার দাম্পত্য জীবনে স্বামী স্বীর সম্পর্কের ধরন নির্ণয় করা। তাদের সম্পর্ক কি মনিব চাকরানী বা মনিবা চাকর জাতীয় যে একজন কর্তৃত্ব করবে আর অপরজন হবে তার আজ্ঞাবাহী। নাকি তারা সমমানের দুই কর্তার মত যারা একে অন্যের উপর প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তারের সংগ্রামে লিপ্ত থাকবে। না তাদের মাঝে এমন সম্প্রীতির সম্পর্ক যে, একে অন্যের সম্পূরক হিসেবে সহযোগিতামূলক আচরণ করবে এবং অপরের লাভ-লোকসান নিজের লাভ-লোকসান মনে করবে এবং অন্যের সুখ-দুঃখে নিজেকে হিস্যাদার গণ্য করবে? এ প্রশ্নের যথাযথ উত্তর পেতে চাইলে আমাদের তাকাতে হবে আল কুরআনের দিকে। আরও তাকাতে হবে আল কুরআনের বাস্তব নমুনা মহানবীর সা. জীবন চরিতের দিকে। দেখতে হবে এ ব্যাপারে ইসলামের দর্শন কি? কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে- “এবং তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে একটি হলো, তিনি তোমাদের মধ্য হতে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের যাওজ তথা সঙ্গিনীদেরকে, যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি লাভ কর এবং তোমাদের মাঝে সৃষ্টি করেছেন পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া। নিশ্চয় চিন্তশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে রয়েছে বহু নিদর্শন।” (সূরা রুম : ২১) উক্ত আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্ত্রীর জন্য ‘যাওজ’ শব্দ ব্যবহার করেছেন যার অর্থ জোড়া, সঙ্গীনী, সম, সংযুক্ত ইত্যাদি। মানব জাতিতে সর্বপ্রথম যিনি স্ত্রীর পদমর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছিলেন সেই আদিমাতা হযরত হাওয়া আলাইহিস সালামের জন্যও এ ‘যাওজ’ শব্দই ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর সৃজন রহস্যের প্রতি ইঙ্গিত করে মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, “তিনিই তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এক ব্যক্তি (আদম) হতে এবং তারই হতে সৃষ্টি করেছন তার ‘যাওজ’ তথা স্ত্রীকে যাতে সে তার  নিকট গিয়ে  প্রশান্তি লাভ করতে পারে। (আরাফ: ১৮৯) মজার ব্যাপার হলো, কুরআন হাদীস ও আরবী ভাষায় স¦ামীর জন্যও এই ‘যাওজ’ শব্দই ব্যবহার হয়ে থাকে। কেবল পাশাপাশি ব্যবহার বা ক্ষেত্র বিশেষ লিঙ্গ নির্দেশের উদ্দেশ্যে স্ত্রীর জন্য তা বর্ণ যোগে ‘যাওজাতুন’  বলা হয়ে থাকে। না হয় স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য ‘যাওজ’ শব্দই প্রচলিত। বাংলা ভাষার স্বামী, পতি ও স্ত্রী, পতœী, ভার্যা ইত্যাদি অপেক্ষা ‘যাওজ’ শব্দটি অত্যন্ত শোভন ও তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা স্বামী, পতি ইত্যাদি শব্দের অর্থ মালিক, অধিপতি, প্রভূ, মনিব ইত্যাদি যা নির্দেশ করে যে, স¦ামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কর্তা-ভৃত্যা ও মালিক-চাকরানী জাতীয়। স্বামী কর্তা আর স্ত্রী তার আজ্ঞাবাহী। স্বামী মালিক, স্ত্রী তার চাকরানী। পক্ষান্তরে ‘যাওজ’ শব্দের অর্থ জোড়া, সঙ্গীনী, সম, সংযুক্ত ইত্যাদি। যা এ কথা স্পষ্ট করে দেয় যে, স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের জোড়া। তাদের সম্পর্ক প্রভূত্বমূলক নয়, মনিব - গোলামের নয় এবং তারা পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বীও নয় ; বরং তারা দুয়ে মিলে এক। একে অপরের সম্পূরক। তাদের সম্পর্ক সখ্যের সম্পর্ক। তারা পরস্পর সখা-সখী। এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে আয়াতের এই অংশে “যাতে তোমরা তাদের নিকট প্রশান্তি লাভ কর এবং তোমাদের মাঝে সৃষ্টি করেছেন পারস্পরিক ভালবাসা ও দয়া।” (সূরা রুম : ২১) বলা বাহুল্য, সম্পর্ক যেখানে কর্তৃত্বসূলভ এবং দাস-মনিবের সেখানে দেহের আরাম যতই হোক মন ও আত্মার আরাম কখনও আশা করা যায় না। আর প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক সম্পর্কের সাথে তো শান্তি ও প্রেম প্রীতি যায়ই না। তা যায় কেবল সখ্য ও সম্পূরকের  সম্পর্কের সাথেই। সম্পর্কটা যদি হয় সখ্যের, মৈত্রীর আর সম্পূরকের সত্যিকারের ভালবাসা আর প্রীতি সেখানেই সম্ভব এবং সেটাই হতে পারে প্রকৃত শান্তির ঠিকানা। সেখানেই মিলতে পারে দেহ ও মনের শান্তি। মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পুণ্যাত্মা স্ত্রীদের সাথে যে হৃদ্যতাপর্ণূ আচরণ করতেন, তা এই সখ্য ও মৈত্রীরই ধারণা দেয়। হাদীস ও সীরাতের কিতাবগুলোতে পাওয়া যায় যে, তিনি তাঁদের চিত্বরঞ্জনের চেষ্টা করতেন, তাদের  অনুভব-অনুভূতির মূল্যায়ন করতেন, তাদের যুক্তিযুক্ত পরামর্শ গ্রহণ করতেন। গৃহস্থলির কাজ-কর্মে তাদের সাহায্য সহযোগিতাও করতেন, তাদের মান অভিমান ও খুনসুটি উপভোগ করতেন, তাদের সাথে গল্প করতেন ও তাদের সাথে হাস্যরসে যোগ দিতেন। এসব প্রমাণ করে মহানবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় স্ত্রীদেরকে কতটা সম্মানজনক স্থানে রেখেছিলেন। তাঁরাও নিজেদের দাসী-চাকরানী ভাবতেন না; ভাবতেন প্রাণের সখী। তবে এটা ভিন্ন ব্যাপার যে, তিনি আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর মহান চরিত্র মাধূরী ও অনুপম আচার-ব্যাবহারের কারণে তাঁরা ছিলন তাঁর প্রতি উৎসর্গিতপ্রাণ। তাঁর সুমহান সত্তার সামনে নিজেদের দাসী-বাদী গন্য করাকেও গৌরবজনক মনে করতেন। আজো তো দুনিয়ার সকল নর-নারী নবী মুহাম্মাদুর রাসূলূল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর দাস-দাসী বলতেই গৌরববোধ করেন। মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। কুরআন-হাদীস ও নবী জীবনের দিকে তাকালে আমরা এ শিক্ষাই পাই যে, স¦ামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক হবে মৈত্রী ও সখ্যের। তারা হবে সখী-সখা। জীবনের উৎকর্ষ সাধনে, সুখের সংসার ও শান্তির ঠিকানা বিনির্মাণে তারা হবে একে অপরের সহযোগী। বিস্তৃত কর্ম জীবনে পরস্পর হবে একে অন্যের সম্পূরক। তারা দু’জনই দু’জনার বড় আপনার। কে বড়, কে ছোট আর কে উত্তম, কে অধম সে প্রশ্ন অবান্তর। জীবনের শেষ অবধি শান্তি-সুখের প্রধান নির্ভরতা হয়ে থাকবে একে অপরের। একের কষ্ট বেদনায় অপরে মাখাবে সান্ত¡নার প্রলেপ। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তরে কিংবা একান্ত নির্জনে দু’জন দু’জনের কাছে খুলে বলবে মনের কথা। এক কথায় বিয়ের বন্ধন এত মজবুত এবং স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক এত গভীর ও নিবিড় যার তুলনা পৃথিবীতে নেই। এজন্যই এ সম্পর্ককে কুরআন মাজীদে ‘লিবাস’ শব্দে চিত্রায়িত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের জন্য ‘লিবাস’ (পোশাক-পরিচ্ছদ) এবং তোমরাও তাদের জন্য ‘লিবাস’ স্বরূপ।” (বাকারা:১৮৭) উক্ত আয়াতে লিবাস তথা পোশাক শব্দের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা ও গভীরতাকে যতটা শিল্পময় ভঙ্গিতে তুলে ধরা হয়েছে তার উপমা বিরল। কারণ পোশাকের চেয়ে মানব শরীরের সান্নিধ্যে আর কিছুই বাস করে না। ঠিক সেভাবে স্বামী তার স্ত্রীর অথবা স্ত্রীর তার স্বামীর যতটা সান্নিধ্যে বাস করে পৃথিবীর অন্য কোন নারী বা পুরুষ যত পরম আত্মীয়ই হোক না কেন এতটা সান্নিধ্যে বাস করে না। আয়াতটি এ কথারও ইঙ্গিত করে যে, স্বামী-স্ত্রীর একের প্রতি অপরের ঠেকাটা ঠিক পোশাকের মতই। পোশাক তার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। পোশাক ছাড়া কোন সভ্য মানুষ চলতে পারে না। ঠিক তেমনি কোন পুরুষ স্ত্রী ছাড়া এবং কোন নারী স্বামী ছাড়া চলতে পারেন। একের প্রতি অন্যের প্রয়োজনটা পোশাকের মতই অপরিহার্য। তারা একে অপরের শোভা-সৌন্দর্য। এভাবে আরও অনেক কিছু।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন