শাব্বীর আহমদ মোমতাজী : আমি বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বলে থাকি মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর জন্ম না হলে মাদরাসা শিক্ষার ইতিহাস অন্যরকম হতো। সত্যিই তাই। মাওলানা হুজুরের সুদূরপ্রসারী চিন্তার ফসল আজকের পুনর্গঠিত জমিয়াতুল মোদার্রেছীন তার সুযোগ্য নেতৃত্বে ১৯৭৬ সন থেকে নব উদ্যোগে দেশের বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের অরাজনৈতিক বৃহত্তর প্লাটফর্ম তিলে তিলে আজকের এ অবস্থানে এসেছে। এর একমাত্র কৃতিত্বের দাবিদার মরহুম হুজুর। তিনি অনুভব করেছিলেন অবহেলিত ও বঞ্চিত এ সমাজকে বঞ্ছনা ও অবহেলা থেকে মুক্ত করে সমাজ ও দেশ উন্নয়নের কাজে লাগাতে হবে এবং আগত আলেম সমাজকে কোরআন, হাদিস, ফিক্হ, তাসাওফ শিক্ষার সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী করে গড়ে তুলতে হবে। সেই লক্ষ্যকে সামনে নিয়েই তিনি দেশের সেরা আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখদের নিয়ে বড় বড় সম্মেলন, সভা-সেমিনার করেছেন এবং মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যক্রমে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজকে মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীগণ কোরআন, হাদিস, আরবি, ফিক্হ, আকায়েদ, ইসলামের ইতিহাস, তাসাউফসহ ধর্মীয় শিক্ষার সাথে সাথে তথ্য ও প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, পৌরনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি, ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা শিক্ষাসহ সকল বিষয়ে শিক্ষা লাভ করে মাদরাসার শিক্ষার্থীগণ নীতি-নৈতিকতার সাথে দেশ ও সমাজ উন্নয়নে ভূমিকা পালন করছেন।
হুজুরের স্বপ্ন ছিল মাদরাসার শিক্ষার্থীগণ খাটি ওয়ারেছাতুল আম্বিয়া হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সাথে সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানে পরিপূর্ণ একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে আলেম সমাজ মাথা উঁচু করে দেশ ও জাতীর সেবায় আত্মনিয়োগ করবে। তার সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তারই সুযোগ্য জেষ্ঠ্য পুত্র আলহাজ এ এম এম বাহাউদ্দীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন সু-সংগঠিতভাবে এগিয়ে চলছে, আজ বাংলাদেশের সকল উপজেলা, জেলা, মহানগরী ও জাতীয় পর্যায়ে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়। সকল ভেদাভেদ ও ইখতিলাফ ভুলে গিয়ে সর্বস্তরের শিক্ষক-কর্মচারী জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের ঐক্যকে সুদৃঢ় করেছেন আন্তরিকতার সাথে। আজ মনে পরে মরহুম হুজুর ঢাকার মহাখালীর আমতলিতে জমিয়াতের অফিস ভাড়া নিয়ে নিজের অর্থ ও সময় ব্যয় করে যাত্রা শুরু করেছিলেন। অফিস থেকে বাসার দূরত্ব সামান্য হলেও মাঝেমধ্যে পক্ষকাল বাসায় যাওয়ার সুযোগ হয়নি। নিজেকে উৎসর্গ করেছেন জমিয়াতের তরে, একদিকে সংগঠনকে ঢেলে সাজানো অন্যদিকে সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে এবং আন্তর্জাতিকভাবে দেশের আলেম-ওলামাদের পরিচিতি ও সুখ-দুঃখের কথা তুলে ধরে নিয়েছেন বিভিন্ন পরিকল্পনা। দেশের আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখদের গুণ কীর্তন করতে কার্পণ্য করতেন না কোন মহলে।
দেশের বাইরে কয়েকটি আন্তর্জাতিক সেমিনারে হুজুরের সাথে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয়েছিল তখন দেখেছি তিনি কিভাবে আলেমদের প্রশংসা করছেন, তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল বেশ কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সাথে। হৃদয়ের সম্পর্ক ছিল আউলিয়া-কেরামদের উত্তরসূরিদের সাথে, যার ফলশ্রুতিতে বড়পীর আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.)-এর ওয়াক্ফ স্টেট থেকে অর্থ এনে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দৃষ্টিনন্দন মসজিদ ও বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন কমপ্লেক্স। আমি মনে করি হুজুরের এটা কেরামত। জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ছিল হুজুরের প্রাণ। জমিয়াতের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায়। মনে পরে, তিনি তখন অসুস্থ। দুটি কিডনিই বিকল, ডায়ালাইসিস করতে হয়। একদিন পর পর এ অবস্থায়ই তিনি বরিশাল বিভাগীয় সম্মেলনে যোগ দিতে যাবেন, যাত্রার যাবতীয় ব্যবস্থা করা হলো। রকেট স্টিমারে যাওয়ার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা বেশ কয়েকজন সফরসঙ্গী সদরঘাটের স্টিমারঘাটে গিয়েছিলাম। হুজুরকে সংবর্ধনা জানানোর প্রস্তুতি চলছে কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে, ইতিমধ্যে খবর এলো হুজুরের ডায়ালাইসিস শেষ হতে ঘণ্টা দু’য়েক বিলম্ব হবে।
এ নিয়ে শুরু হলো যাত্রীদের মধ্যে কানাঘোষা। ঠিকই হুজুর আসলেন দুঘণ্টা বিলম্বে। ইতোমধ্যে যাত্রীদের মধ্যে এ নিয়ে শুরু হলো হৈ-হুল্লোড়, একথা-সেকথা। ভোররাতে রকেট আটকা পড়লো চাঁদপুর পার হয়ে এক চরে, সকলেরই মন খারাপ, দেখলাম হুজুরকে উৎফুল্ল। তিনি বললেন এরা গত সন্ধ্যায় রকেট বিলম্ব করায় হৈ-হুল্লোড় করলো এখন কি করবে? আমরা ঠিকই চলে যাব। আল্লাহপাক আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করবেন, কারণ আমরা যাচ্ছি আলেম-ওলামাদের খেদমতে। ওখান থেকে মোবাইলে ঢাকা বা কোথাও যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। কিন্তু ঠিকই হুজুর যোগাযোগ করে তিনটি স্পিড বোটের ব্যবস্থা করলেন। অনেক কষ্টে হুজুরসহ আমরা কজন জাহাজ থেকে স্পিড বোটে উঠলাম। আমার জীবনের এটাই ছিল প্রথম বোটে ওঠা, তাই খুব ভয় হচ্ছিল। এটা হুজুর ঠিকই বুঝলেন। আমাকে ওনার কাছে বসতে দিয়ে হুজুরের বিভিন্ন সফরের অভিজ্ঞতা বলে আমার ভয় কাটানোর ব্যবস্থা করলেন। প্রায় দেড়ঘণ্টা প্রখর রোদে বোটে বরিশালে বিভাগীয় সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে সুদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন হুজুর। হুজুর সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে জমিয়াতের পতাকাতলে থেকে মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করা, মাদরাসার লেখা-পড়ার মান উন্নয়ন, নকলমুক্ত পরীক্ষা গ্রহণসহ সববিষয়ে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখলেন। একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে, সুন্দর ব্যবস্থাপনায় বরিশাল বিভাগের সব মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারী উপস্থিত হয়েছিলেন। সাথে অন্যান্য শিক্ষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দও উপস্থিত হয়েছিলেন।
আজ হুজুর নেই। হুজুরের সাথে যারা নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে জমিয়াতের পরিপূর্ণতায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন তারা অনেকেই আজ জান্নাতবাসী। হাতেগোনা কয়েকজন আজ অবসর জীবন যাপন করেও সর্বদাই জমিয়াতের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে ইবতেদায়ী বৃত্তি, ৮ম শ্রেণীর বৃত্তি, শিক্ষকদের বেতন-বৈষম্য দূর হয়েছে। জমিয়াতের প্রাণের দাবি ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছে। মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে চলছে। শুরু হয়েছে অগ্রযাত্রা। এ অগ্রযাত্রায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিকতার কোন কমতি নেই। বার বার শুধু মনে পড়ে হুজুরের একটি কথা। তিনি বলতেন, আমি এত দিন চেষ্টা করে তোমাদের জন্য মাত্র ২৫% দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়েছি, পরিবেশ তৈয়ার করে রেখে গেলাম, আমার প্রাণের প্রিয় সংগঠন জমিয়াতুল মোদার্রেছীন। সকলেই যদি ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস চালাও তবে নিশ্চয়ই বাকি ৭৫% দাবি-দাওয়া আদায় হবে।
তাই আজ আমি হুজুরের ওফাত বার্ষিকীতে মাদরাসার সকল শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতি অনুরোধ করবো, আসুন আমরা সবাই সবপ্রকার হীনম্মন্যতা ভুলে গিয়ে মরহুম হুজুরের হাতে গড়া সংগঠনকে শক্তিশালী করে মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়ন, বিশেষ করে মাদরাসার ছাত্র-ছাত্রীদের নীতি-নৈতিকতা সম্পূর্ণ আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে আত্মনিয়োগ করি। তাহলেই আমাদের প্রাণপ্রিয় মরহুম নেতা মাওলানা এম এ মান্নান (রহ.)-এর আত্মা শান্তি পাবেন। আল্লাহপাক আমাদের সকলকে কবুল করুন। (আমীন)
লেখক : মহাসচিব, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন