মুফতী পিয়ার মাহমুদ
॥ শেষ কিস্তি ॥
নেতা বা দলপতি ছাড়া কোন যৌথ কারবার চলে না। কোন সমাজ বা রাষ্ট্র অস্তিত্ব লাভ করে না। মোটকথা সংঘবদ্ধ কোন কিছুই কারও নেতৃত্ব ছাড়া এগুতে পারে না। তাই শাশ^তকাল থেকেই পরিবার ও সমাজ নেতৃত্বকে মেনেই চলে আসছে। এ জন্যই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছন, “যখন তোমরা তিন ব্যক্তি কোন ভ্রমণে বের হও (ভ্রমণটি যত ক্ষুদ্রই হোক) তখন একজনকে আমীর বা নেতা বানিয়ে নাও। তো ছোট একটি ভ্রমণেও যখন একজনকে আমীর বানানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তখন মানব জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য অংশ দাম্পত্য জীবনের এই দীর্ঘ সফরে, যেখানে দুজন নর-নারী একসঙ্গে দীর্ঘ পথ পাড়ী দিবে, সেখানে এটি বাধ্যতামূলক হবে না কেন? সংসার জীবনকে সুন্দর, সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য স্বামী-স্ত্রী দু’জনের একজনকে আমীর বানানো অবশ্যই জরুরি হবে। এখন প্রশ্ন হলো, দু’জনের কাকে আমীর বানানো হবে? হয় স্বামীকে আমীর বানানো হবে, স্ত্রী হবে তার অধীন। অথবা স্ত্রীকে আমীর বানানো হবে, স্বামী হবে তার অধীন। এখানে তৃতীয় আর কোন পথ নেই।
আপনি যদি মানবীয় সৃষ্টি, সৃষ্টিগত স্বভাব, শক্তি, যোগ্যতা, বিবেক, বুদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে বিবেচনা করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, মহান আল্লাহ বড় বড় কাজ করার যে শক্তি ও যোগ্যতা পুরুষকে দান করেছেন, তা নারীকে দান করেননি। কাজেই এই নেতৃত্বের কাজটা একজন পুরুষই সঠিকভাবে আঞ্জাম দিতে সক্ষম। তাই দাম্পত্য জীবনে পুরুষকে নেতা বা তত্ত্বাবধায়ক বানানো হয়েছে। এ দায়িত্ব তার উপর অর্পিত হয়েছে তার উপযুক্ততার বিবেচনায়। মহাপ্রজ্ঞাময় আল্লাহ তাআল পুরুষকেই এ কাজের উপযুক্ত করে বানিয়েছেন। কুরআন মাজীদে ইরশাদ হয়েছে, “পুরুষগণ নারীদের তত্ত্বাবধায়ক এ করণে যে, আল্লাহ তাদের কতককে (গুণাবলী ও যোগ্যতায়) কতকের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছেন এবং এ কারণে যে, তারা তাদের অর্থ সম্পদ ব্যয় করে। (নিসা: ৩৪) এই বিশ^ সংসার সুষ্ঠভাবে পরিচালানার জন্য যার দ্বারা যে কাজ নেওয়া দরকার বিশ^পতি তাকে তার যোগ্যতা দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। তিনি তো অন্তরজামী। কাজেই কার দ্বারা কি কাজ নিবেন সেটা তার একান্ত ব্যাপার। এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোন সুযোগ নেই। এখানে প্রশ্ন তোলা বাতুলতা বৈ কিছু নয়। যেমন মানব প্রজন্ম বিস্তারের জন্য আল্লাহ তাআলা নারীকে মা করে বানিয়েছেন। এ কাজের উপযুক্ত করেই তিনি নারী জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তাই গর্ভে সন্তান ধারণ এবং শিশু সন্তানের লালন-পালন ও পরিচর্যার জন্য যে সুকুমার গুণাবলীর প্রয়োজন ছিল তা দিয়েই তিনি নারী জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। তার দেহমনকে এর উপযোগী করেই তৈরী করেছেন। সেই সাথে মা যেন তার আপন দায়িত্ব সুচারুরূপে পালন করতে পারে সে জন্য তার নিজের ও সন্তানের সুরক্ষাসহ অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান প্রভৃতি সমাধার ভার থেকে তার মুক্ত থাকার দরকার ছিল। তাই তাকে ভার মুক্ত রেখে আল্লাহ তাআলা এগুলোর দায়-দায়িত্ব অপর্ণ করেছেন পুরুষের কাঁধে। আর এ জন্য যে গুণাবলী ও যোগ্যতা দরকার ছিল তা দিয়েই তিনি পুরুষকে সৃষ্টি করেছেন। মূলত এ সুবাদেই পুরুষ নারীর কর্তা ও তত্ত্বাবধায়ক। তো স্বামী-স্ত্রী উভয়ে এই মাত্রাজ্ঞান নিয়ে দাম্পত্য জীবন নির্বাহ করলে গড়ে উঠবে পরম সুখের সংসার। দাম্পত্য জীবন পরিণত হবে সুখের স্বর্গে। হাসিল হবে বিবাহ বন্ধনের আসল মাকসাদ।
কিন্তু সমাজের চিত্র আজ সম্পূর্ণ উল্টো। স্বামী নিজেকে মনে করে কর্তা ও মালিক আর স্ত্রীকে মনে করে হুকুমের গোলাম। এদিকে শ্বশুর-শাশুড়ি বিয়ে করিয়েই পুত্রবধূকে বানিয়ে ফেলে চাকরানী। রান্না-বান্না ও কাপড় কাচাসহ সংসারের যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দিতে হবে পুত্রবধূকেই। এ ক্ষেত্রে তার কোন ওযর-আপত্তিই স্বামীর সংসারে গ্রহণ হবে না। অপরদিকে কোন কোন সংসারে স্ত্রীই সংসারের সর্বেসর্বা। তার ভালই ভাল; তার মন্দই মন্দ। সংসারের অন্য কারো কথার কোন মূল্যই তার কাছে নেই। এই দু’টি প্রান্তিক অবস্থাই ইসলামের দৃষ্টিতে চরম নিন্দিত। এ ব্যাপারে ইসলামের দর্শন হচ্ছে এ দু’য়ের মাঝামাঝি। ইসলাম বলে স্বামী স্ত্রীর জন্য কর্তা বা শাসক নয় যে, সকল কিছু তার খেয়াল-খুশি মতে চালাবে। স্ত্রীও শ্বশুরবাড়ির চাকরানী নয় যে, শ্বশুরবাড়ির সকল কাজ-কর্মই তাকেই করতে হবে। আবার এমনও নয় যে, স্ত্রী সকল কিছুর কর্তা বনে সকলের উপর লাঠি ঘুরাবে। বরং স্ত্রীর কর্তব্য হলো সে মনে করবে স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক, তাদের কর্মকা- কেবলই দুনিয়াবী ব্যাপার নয়। নফসের চাহিদা পূরণই এর মূলকথা নয়। বরং এটা দ্বীনী ব্যাপারও। কারণ, কোন স্ত্রী যদি মনে করে স্বামীর ব্যাপারে আমার উপর আরোপিত এই হুকুম আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে। এ সম্পর্কের উদ্দেশ্য হল, স্বামীকে খুশী করার মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলাকে সন্তুষ্ট করা। এ ফিকিরের মাধ্যমে যদি কোন স্ত্রী দাম্পত্য জীবনের সকল দায়িত্ব পালন করে যায়, তাহলে সংশ্লিষ্ট সকল কাজই ইবাদতে পরিণত হবে। মেয়েরা সংসারের যে সব কাজ-কর্ম করে, তারা যদি এগুলো স্বামীর সন্তুষ্টির জন্য করে তাহলে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কৃত সমস্ত কাজ সওয়াবের কাজ হিসেবে পরিগণিত হবে এবং আল্লাহর দরবারে এর প্রতিদানও মিলবে। রান্না-বান্নার কাজ, ঘরবাড়ি তত্ত্বাবধায়ন, সন্তানের লালন-পালন এবং স্বামীর সাথে হাসি কৌতুক ও মিষ্টভাষণও তখন সওয়াবের যোগ্য হয়ে যাবে। বিশুদ্ধ নিয়তের বরকতে এসব কাজেরও প্রতিদান পাওয়া যাবে আল্লাহ তা’আলার দরবারে। এখানে ইসলামী ফিকহবিদগণ একটি নাজুক মাসআলা বলেছেন, যে মাসআলাটি বললে অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেন। মাসআলাটি হল, ঘরের রান্না-বান্না করা স্ত্রীদের জন্য শরঈ দায়িত্ব নয়। অর্থাৎ তাদেরকে রান্নাবান্না করতেই হবে, এটা ফরয, এমন কোন নির্দেশ শরীয়ত দেয়নি। এমনকি ফুকহায়ে কিরাম এও বলেছেন, মেয়েদের মধ্যে দু’টি শ্রেণী আছে। ১. যারা পারিবারিকভাবে বাবার সংসারে ঘরকন্নার কাজ করে অভ্যস্ত। ২. যারা পারিবারিকভাবে বাবার সংসারে ঘরকন্নার কাজ করে অভ্যস্ত নয়। বরং চাকর নওকরের সাহায্যে তার গৃহস্থালী কাজগুলো করায়। দ্বিতীয় শ্রেণীর মেয়েদের সম্পর্কে মাসআল হল, এরা স্বামীর ঘরে আসায় পর খানা পাকানো তাদের দায়িত্ব বলে বিবেচিত হবে না। ইসলামের দৃষ্টিত্বে এটা তাদের দায়িত্ব নয়। বরং স্ত্রী স¦ামীকে এ কথা বলার অধিকার রাখে যে, আমার ভরণ-পোষণ তোমার দায়িত্ব। রান্নাবান্না করা আমার দায়িত্ব নয়। কজেই প্রস্তুতকৃত খাবার আমাকে দিতে হবে। ফকীহগণ লিখেছেন, স্ত্রী যদি এমন দাবি করে তাহলে স্বামীর দায়িত্ব হলো, স্ত্রীকে প্রস্তুতকৃত খাবার এনে দেয়া। এ ব্যাপারে স্বামী বাধ্য থাকবে। স্বামী রান্নাবান্নার জন্য স্ত্রীকে চাপ প্রয়োগ করতে পারবে না। এ দিকে ইঙ্গিত করেই মহানবী সা. ইরশাদ করেছেন, ‘স্ত্রীদের উপর তোমাদের অধিকার হলো, তারা তোমাদের গৃহে অবস্থান করবে এবং তোমাদের অনুমতি ছাড়া বাইরে যেতে পারবে না। এ ছাড়া তাদের উপর আর কোন অধিকার তোমাদের নেই। আর মেয়েটি যদি এমন হয় যে, বাবার সংসারে রান্নার কাজে অভ্যস্ত ছিল, তাহলে রান্না করা আইনগতভাবে তার কর্তব্য নয়; তবে ধার্মিকতা, দীনদারী ও মানবিক বিচারে নিজের খাবার নিজে রান্না করে খাওয়া তার অবশ্য কর্তব্য। স¦ামী সন্তানের খাবার রান্না করা তার দায়িত্ব নয়। (বুখারী: ১/১৩; হাদীস, ৮৩০, মিশকাত:২/২৬৮; ইসলাহী খুতুবাত ২/২২২)
দাম্পত্য জীবনকে সুখি-সমৃদ্ধ করতে হলে আইনের শুষ্ক সীমারেখা অতিক্রম করে অনুসরণ করতে হবে রাসূলের সুন্নত ও আর্দশের। স্ত্রী লক্ষ্য রাখবে স্বামীর সন্তুষ্টি ও মনোরঞ্জনের আর স্বামী খেয়াল রাখবে স্ত্রীর সন্তুষ্টি ও মনোরঞ্জনের। কে কার সঙ্গে কতটা সদাচারের পরিচয় দিতে পারে সর্বদা উভয়ের সে প্রতিযোগিতায় থাকা উচিত। স্ত্রী ঘরের কাজ আঞ্জাম দিবে আর স্বামী বাইরের কাজ সমাধা করবে। যেমন হযরত আলী রা. ও ফাতেমা রা. নিজেদের মাঝে কাজ বণ্টন করে নিয়েছিলেন যে, হযরত আলী আঞ্জাম দিতেন বাইরের কাজ আর ফাতেমা রা. ঘরের কাজ আঞ্জাম দিতেন। এটিই নবীজীর সন্নত। প্রতিটি দম্পতিকে এ নিয়মই পালন করা উচিত। (ইসলাহী খুতুবাত:২/২২৬,২৫৫-৫৬) স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে এভাবে জীবন গাড়ীকে চালালে সুখ-শান্তিতে ভরে উঠবে সংসার এবং দাম্পত্য জীবন হয়ে উঠবে সুখের জীবন্ত স্বর্গ-রাজ্য ইনশাআল্লাহ।
লেখক: গ্রন্থ প্রণেতা, ধর্মীয় গবেষক ও মুহাদ্দিস, জামিয়া মিফতাহুল উলুম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন