মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

জঙ্গিবাদ বনাম শান্তির বাংলাদেশ

| প্রকাশের সময় : ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

রিদওয়ান বিন ওয়ালী উল্লাহ

॥ এক ॥
নয়নাভিরাম এ পৃথিবীকে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি করেছেন মানুষের বসবাসের জন্য। মানুষকে সৃজিত করেছেন সামাজিক জীবরূপে। ফলে তারা সমাজবদ্ধ জীবন ছাড়া বসবাস করতে পারে না। এটি আল্লাহ তায়া’লার মহান হিকমাত। তাই তিনি শুধু সৃষ্টি করেই ছেড়ে রাখেননি, বরং তাদের জন্য প্রণয়ন করেছেন সমাজনীতি। যেন তারা সুখে বসবাস করতে পারে।
মহান আল্লাহ তায়া’লার অশেষ রহমতে মানুষের বসবাসের উপযুগী এ পৃথিবীকে সন্ত্রাস, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা আর জঙ্গিবাদের মাধ্যমে অনুপযুগী না করতে সতর্ক করে সূরা আল কাসাস : ৭৭ নং আয়াতে ঘোষণা করা হচ্ছেÑ এবং তোমরা পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করো না। আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীদেরকে পছন্দ করেন না।
তাবেয়ীদের বর্ণনা মতে সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ। তবে কেউ বলেন, রাসূল (সা.) এর মদিনায় হিজরতের সময় সূরাটি অবতীর্ণ হয়। কারো মতে, শুধু ৫২ ও ৮৫ নং আয়াত মাদানী। অত্র সূরার ৭৬ নং আয়াতে মুসা (আ.)-এর সম্প্রদায়ের লোক কারূণ স্বীয় সম্প্রদায়ের উপর জুলুম-নির্যাতন করা, তার উপর আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করা ও তার অহমিকার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। অতঃপর আলোচ্য আয়াতাংশে আল্লাহ তায়া’লা দুনিয়াতে বিপর্যয় সৃষ্টি না করতে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
সকল আসমানী কিতাবই যমীনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা থেকে নিষেধ করেছে। পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন স্থানে এ বিষয়ে আল্লাহ তায়’ালা আলোকপাত করেছেন।
এরশাদ হচ্ছে, আর তোমরা যমীনে ফ্যাসাদ করোনা তার সংশোধনের পর এবং তাকে ডাক ভয় ও আশা নিয়ে। নিশ্চয় আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীলদের নিকটবর্তী। (সূরা আল আ’রাফ : ৫৬) আল্লাহ তায়’ালা আরো বলেন, আর তোমরা যমীনে ফ্যাসাদ করবে না তার সংশোধনের পর। এগুলো তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা মুমিন হও।  (সূরা আল আ’রাফ : ৮৫)
আল্লামা ইবনু কাইয়্যিমিল জাওযিয়াহ বলেন, আল্লাহ তায়া’লার রাসূল প্রেরণ, শরিয়তের বর্ণনা ও আল্লাহর আনুগত্য করার প্রতি আহ্বান করার মাধ্যমে যমীনকে সংশোধন করার পর তোমরা পাপাচার ও আল্লাহ ব্যতীত অন্যের আনুগত্যের দিকে আহবান করার মাধ্যমে যমীনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করো না। (বাদায়েউল ফাওয়ায়েদ : ৩/৮৫৬)
পবিত্র কোরআনে আরো বর্ণিত হয়েছে, আর যখন সে ফিরে যায়, তখন যমীনে প্রচেষ্টা চালায় তাতে ফ্যাসাদ করতে এবং ধ্বংস করতে শস্য ও প্রাণী। আর আল্লাহ ফ্যাসাদ ভালোবাসেন না।(সূরা আল-বাকারা : ২০৫)
আরো এসেছেÑ এবং সীমা লংঘনকারীদের নির্দেশের আনুগত্য করো না। যারা পৃথিবীতে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে এবং শান্তি  স্থাপন করে না। (আশ্-শুয়ারা : ১৫১-১৫২)
যুগে যুগে সতর্কবার্তা :
যুগ যুগ ধরে নবী-রাসূলগণ স্বীয় কাওমকে সব ধরনের ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা থেকে সতর্ক করেছেন।
সালেহ (আ.) স্বীয় কাওমকে বলেন, আর স্মরণ কর, যখন আদ জাতির পর তিনি তোমাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করলেন এবং তোমাদেরকে যমীনে আবাস দিলেন। তোমরা ও সমতল ভূমিতে প্রাসাদ নির্মাণ করছ এবং পাহাড় কেটে বাড়ি বানাচ্ছ। সুতরাং তোমরা আল্লাহর নিয়ামতসমূহকে স্মরণ কর এবং যমীনে ফ্যাসাদকারী রূপে ঘুরে বেড়িও না (সূরা আল আ’রাফ : ৭৪)। শোয়াইব (আ.) স্বীয় কাওমকে বলেন, আর হে আমার কাওম, মাপ ও ওজন পূর্ণ কর ইনসাফের সাথে এবং মানুষকে তাদের পণ্য কম দিও না; আর যমীনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে বেড়িও না (সূরা হূদ : ৮৫)। আল্লাহর নবী মুসা (আ.) স্বীয় ভাই নবী হারুন (আ.)-কে সম্বোধন করে বলেন, এবং মুসা তার ভাই হারূনকে বলল, আমার কওমের মধ্যে তুমি আমার প্রতিনিধিত্ব কর, সংশোধন কর এবং ফ্যাসাদকারীদের পথ অনুসরণ করো না (সূরা আল আ’রাফ : ১৪২)।
এমনিভাবে চারিত্র্যিক, সামাজিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয়, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিসহ সবধরনের ফ্যাসাদ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে প্রায় ৫০টি আয়াত রয়েছে।
আবু দাউদ (২৫০৭) ও নাসায়ীতে (৩১৮৮) এসেছে, রাসূল (সা.) বলেন, যে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যুদ্ধ করে এবং ইমামের অনুগত থাকে, নিজের উৎকৃষ্ট সম্পদ যুদ্ধে ব্যয় করে, সঙ্গীর সহায়তা করে, ঝগড়া ফ্যাসাদ ও অপকর্ম হতে বেঁচে থাকে। তার নিদ্রা ও জাগ্রত অবস্থার সব কিছুই পুণ্যে পরিণত হয়। যে গর্বভরে লোক দেখানো ও সুনামের জন্য যুদ্ধ করে এবং ইমামের অবাধ্য থাকে ও পৃথিবীতে অন্যায় কাজ করে, সে সামান্য কিছু পুণ্য নিয়েও বাড়ি ফেরে না।
ফ্যাসাদ ও জঙ্গিবাদ :
জঙ্গিবাদ শব্দটি ইংরেজি সরষরঃধহপু শব্দের অনুবাদ। মাইক্রোসফট এনকার্টা অভিধান, ঙীভড়ৎফ অফাধহপবফ খবধৎহবৎ’ং উরপঃরড়হধৎু,  গবৎৎরধস- ডবঢ়ংঃবৎ’ং ঈড়ষষবমরধঃব উরপঃরড়হধৎু-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ অভিধান দেখলে বুঝা যায় জঙ্গিবাদ শব্দটি আভিধানিক বা ব্যবহারিকভাবে খারাপ অর্থে ব্যবহৃত হতো না। শক্তিমত্তা বা উগ্র বুঝাতে, কোনো বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে চরমভাবে সক্রিয় হওয়া অর্থে শব্দটির ব্যবহার। তাই নিজেদের স্বার্থ প্রতিষ্ঠায় উগ্রভাবে সক্রিয় সকল রাজনৈতিক, আদর্শিক, পেশাজীবি ও সামাজিক দলের কর্মকা-কেই জঙ্গিবাদ বলা চলে। বরং আইনসম্মত যে কোনো প্রকারের উগ্রতা বুঝাতে (সরষরঃধহঃ, সরষরঃধহপু) জঙ্গি ও জঙ্গিবাদ শব্দদ্বয় ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আমরা বর্তমানে বাংলায় পত্রপত্রিকা, বক্তৃতা-বিবৃতি ও লেখালেখি থেকে জঙ্গিবাদ বলতে বুঝি বে-আইনি সহিংসতা ও খুনখারাবি। যার প্রকাশে সঠিক শব্দ হচ্ছে সন্ত্রাস (ঃবৎৎড়ৎরংস)।  
জঙ্গিবাদ ও ইসলাম :
প্রখ্যাত গবেষক, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)-এর মতে, “আমরা দেখছি যে, জঙ্গিবাদ শব্দটি কোনোরূপ ভাষাগত ভিত্তি ছাড়াই ‘ইসলামের নামে সহিংসতা’ অর্থে ব্যবহার হচ্ছে। অথচ মূল ভাষাগত অর্থে ইসলামের নামে, অন্য কোনো ধর্মের নামে, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে, গণতন্ত্রের নামে, সমাজতন্ত্রের নামে অন্য যে কোনো মতবাদ, আদর্শ বা অধিকারের নামে উগ্রতার আশ্রয় গ্রহণকারী মানুষকে জঙ্গি বলা চলে এবং তার মতামতকে জঙ্গিবাদ বলা চলে। ইংরেজি ব্যবহার এটিই প্রমাণ করে।” (ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ : ১০ পৃ)
সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদের সাথে ইসলামের কী সম্পর্ক?
সন্ত্রাসবাদ শুরু হয় ইহূদী উগ্রবাদীদের দ্বারা। প্রাচীন যুগে ইহূদী উগ্রবাদী ধার্মিকগণ ধর্মীয় আদর্শ ও ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সন্ত্রাসের আশ্রয় নিয়েছেন। মানব ইতিহাসে প্রাচীন যুগের প্রথম প্রসিদ্ধ সন্ত্রাসী কর্ম ছিল খৃস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী ও তার পরবর্তী সময়ে রোমান সা¤্রাজ্যের অধীনে বসবাসরত উগ্রবাদী ইহূদী যীলটদের (তবধষড়ঃং) সন্ত্রাস। যে সকল ইহূদী রোমান রাষ্ট্রের সাথে সহযোগিতা করত বা সহাবস্থানের চিন্তা করত এরা তাদেরকে গুপ্তহত্যা করত। প্রয়োজনে আত্মহত্যা করত কিন্তু প্রতিপক্ষের হাতে ধরা দিত না।
মধ্যযুগে বিশেষত ধর্মীয় সংস্কার, পাল্টা-সংস্কার (ঃযব জবভড়ৎসধঃরড়হ ্ ঃযব ঈড়ঁহঃবৎ-জবভড়ৎসধঃরড়হ) এর যুগে ক্যাথলিক ও প্রটেস্টেন্টদের মধ্যে অগণিত যুদ্ধ ছাড়াও যুদ্ধ বহির্ভূত সন্ত্রাসের অনেক ঘটনা দেখা যায়। পক্ষান্তরে ইসলামের ইতিহাসে আমরা যুদ্ধ দেখতে পেলেও সন্ত্রাস দেখি খুবই কম। সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী ঘটনা ১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস। বিন লাদেন বা তার বাহিনী তা করেছে বলে দাবি করা হলেও এখন পর্যন্ত কোনোভাবেই বিষয়টি প্রমাণ করতে পারেনি (দেখুন : ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ :১৫-১৬ পৃ)। যে কোনো এনসাইক্লোপিডিয়া বা তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থে সন্ত্রাসের ইতিহাস পড়লে বুঝা যায় যে, সন্ত্রাসের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশে মুসলমানদের ভূমিকা খুবই কম। এবং ইসলামী জঙ্গিবাদ, ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও হত্যার বিষয়ে যা বলা হয় তার অধিকাংশই ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন