শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

আনোয়ারা ও মিরসরাই অর্থনৈতিক জোন : কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র

প্রকাশের সময় : ২০ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

শফিউল আলম : চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও মিরসরাইয়ে বিস্তীর্ণ পরিসরে গড়ে উঠছে বিশেষ অর্থনৈতিক জোন। অর্থনৈতিক জোনকে কেন্দ্র করে ব্যাপক দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ, শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানের নতুন ক্ষেত্র উন্মোচনের অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের অনতিদূরে আনোয়ারায় এবং দেশের ‘লাইফ লাইন’ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কাছাকাছি মিরসরাইয়ে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক জোন বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। উভয় প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রামে শিল্পায়নের স্থান সংকট নিরসন হবে। এর পাশাপাশি মিরসরাইয়ে চীনা সহায়তায় বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এদিকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে সরকারের কর্মপরিকল্পনাকে সামনে রেখে আগামী ৩০ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামে সফরে আসছেন। আনোয়ারা ও মিরসরাই অর্থনৈতিক জোন দ্রুত বাস্তবায়নসহ দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামকে শিল্প-বাণিজ্য-অর্থনৈতিক গুরুত্বের আলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর চট্টগ্রাম সফরকালে সুনির্দিষ্ট দিক-নির্দেশনা বেরিয়ে আসতে পারে বলে দায়িত্বশীল সূত্রে ধারণা করা হচ্ছে। প্রসঙ্গত, এবার প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চট্টগ্রাম সফরের মূল প্রতিপাদ্য এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটেই।
দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে বন্দরের অদূরেই চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার গহিরা এলাকায় বিশেষ অর্থনৈতিক জোন স্থাপনের জন্য ৭শ’ ৭৪ একর জমি ব্যবহারের জন্য গত সেপ্টেম্বরে ১৫ জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। এর মধ্যদিয়ে শিল্পায়ন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সম্ভাবনার একটি নতুন দ্বার উন্মোচন হয়েছে। বিশেষ অর্থনৈতিক জোন প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ৫৩ হাজার ৪২০ জন লোকের কর্মসংস্থানের পথ সুগম হবে বলে আশা প্রকাশ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আনোয়ারা অর্থনেতিক জোনের অবকাঠামো নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪শ’ ২০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা। ইতোমধ্যে এই অর্থনৈতিক জোনের জন্য ২শ’ ৯১ একর খাস জমির দলিল সম্পাদন করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন।
এদিকে দেশের উদীয়মান ও রফতানিমুখী জাহাজ নির্মাণ শিল্প, ইলেকট্রিক ও ইলেট্রনিকস পণ্যসামগ্রী, ফার্নেস ও সিমেন্ট শিল্পকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে আনোয়ারায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলটি গড়ে তোলা হবে। সেখানে ৩শ’ ৭১টি শিল্প-কারখানা স্থাপন করা সম্ভব হবে। এরমধ্যে ২৫০টিই জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্য বরাদ্দ থাকবে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আনোয়ারায় অর্থনৈতিক জোনের প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ৫৩ হাজার ৪২০ জন লোকের কর্মসংস্থান হবে। প্রস্তাবিত আনোয়ারা অর্থনৈতিক জোনের কাজ ২০১৭ সাল থেকে শুরু হয়ে প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার টার্গেট ২০২০ সাল। প্রকল্প এলাকায় বর্তমানে তেমন অবকাঠামো সুযোগ-সুবিধা নেই। নেই বিদ্যুৎ ও গ্যাস লাইন, ল্যান্ড ফোন ও সুপেয় পানির সরবরাহ সুবিধা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি সংযোগ সড়ক থাকলেও তা জরাজীর্ণ বেহাল। এর পরিপ্রেক্ষিতে অবকাঠামো নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৪শ’ ২০ কোটি ৩৭ লাখ টাকা।
সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে ২০১০ সালে বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চল আইনবিধি করা হয়। এ আইনবিধির আওতায় আগামী ১৫ বছরে দেশে একশ’ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান এবং প্রতিবছর ৪০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যসামগ্রী রফতানির সুযোগ সৃষ্টি করতে চায় সরকার। এ লক্ষ্যের অংশ হিসেবে বিগত সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের সময় চীনা প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামে বিশেষ অর্থনেতিক ও শিল্পাঞ্চল স্থাপনের প্রস্তাব দেন। পরে এ বিষয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও চীনের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্তের ভিত্তিতে জমি দেবে এবং চীন সরকারের মনোনীত প্রতিষ্ঠান উক্ত জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলবে।
এদিকে উত্তর চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অপর একটি অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এর জন্য ৪ হাজার ৮শ’ একর জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক জোন (বেজা) কর্তৃপক্ষ এবং চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে ভূমি তথা প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেছেন। বামনসুন্দর থেকে অর্থনৈতিক জোন পর্যন্ত প্রকল্পের সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ হাতে নেয়া হচ্ছে। মিরসরাইয়ের ইছাখালী চরে হতে যাচ্ছে পূর্ণাঙ্গ একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল। সেখানে বড় ধরনের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের জন্য গভীর আগ্রহ ব্যক্ত করেছে চীন। এ মহাপ্রকল্পে ২ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ চীনা বিনিয়োগের লক্ষ্যে একের পর এক সফর করেছে চীনা ও দেশীয় বিশেষজ্ঞ দল। এরমধ্যে বিদ্যুৎ প্রকল্পস্থল পরিদর্শন করে বিনিয়োগে আগ্রহী চীনা প্রতিষ্ঠান ‘জিনদুন’র উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল। এ মহাপ্রকল্পে প্রতিষ্ঠানটি ১৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ব্যাপারে গভীর আগ্রহ ব্যক্ত করে। চীনা বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত করেছেন, কয়লাভিত্তিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি হবে পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব ও লাগসই উন্নততর প্রযুক্তির। তারা জানায়, সবকিছু ঠিকঠাক মতো এগুতে থাকলে এ বছরের মধ্যে এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রাথমিক কাজ শুরু করা সম্ভব হবে। চীনা প্রতিষ্ঠান ‘জিনদুন’ বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থসংস্থান ও কারিগরি সহায়তা দেয়ার আশ্বাস ব্যক্ত করে। জানা গেছে, সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পসমূহের মধ্যে দেশের মোট ৯টি অর্থনৈতিক জোনের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বড় অঞ্চল ও বৃহদাকারে বিনিয়োগের সম্ভাবনাময় প্রকল্প হচ্ছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের প্রকল্পটি। চট্টগ্রামসহ বৃহত্তর এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও শিল্পায়নে বিদ্যুতের চাহিদা সবচেয়ে ব্যাপক। ইছাখালীর চরাঞ্চলে ১৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপিত হলে এসব ক্ষেত্রে চাহিদা পূরণ হবে। এরফলে ব্যাপক কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মিরসরাইয়ে শিল্পজোন গড়ে তোলার উদ্দেশে ইতোমধ্যে ১১শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘সহায়ক প্রকল্প’ হাতে নিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। সাগরের লোনাপানি, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস থেকে শিল্পজোনকে রক্ষায় এই প্রকল্প নেয়া হয়েছে। প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পের মধ্যে গুরুত্ব পেয়েছে। পাউবো’র প্রকল্পের আওতায় সাড়ে ১৯ কিলোমিটার চার লেন বিশিষ্ট সড়ক, বেড়িবাঁধ, প্রতিরক্ষা বাঁধ, নতুন খাল খনন, পুরনো খাল পুনঃখনন ও ৯টি স্লুইস গেট স্থাপন করা হবে। এক হাজার ৮০ কোটি টাকার এই প্রকল্প পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পের ভূমি জরিপসহ প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে মিরসরাই অর্থনৈতিক জোন ও বিদ্যুৎ প্রকল্পকে কেন্দ্র করে উদ্যোক্তামহলে আশাবাদ সঞ্চার হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন