ফিরোজ আহমাদ : ভাষা একটি জাতির স্বাধীনতা, সংস্কৃতি ও গৌরবের প্রতীক। ভাষা বৈচিত্র্যের মধ্যে আল্লাহর কুদরতের সবচেয়ে বড় নিদর্শন নিহিত রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘আকাশমালা ও যমীনের সৃষ্টি, তোমাদের পারস্পরিক ভাষা ও বর্ণ বৈচিত্র তার (কুদরতের) নিদর্শন; অবশ্যই জ্ঞানবান মানুষের জন্যে এতে অনেক নিদর্শন রয়েছে।’ (সূরা রূম: ২২)। আল্লাহ এক আদম থেকে বহু আদম সৃষ্টি করেছেন। কালের পরিক্রমায় নিজেদের মধ্যে পরস্পর বিভিন্ন বিষয়ে মতানৈক্য ও বিভেদ দেখা দিলে এক আদমের অনুসারীরা বহু গোত্র, দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বহু দলে বিভক্ত হয়ে পড়া আদমকে আল্লাহ তা‘য়ালা খাবার, বায়ু ও পানি দেয়ার পাশাপাশি একে অপরের নিকট মনের ভাব প্রকাশের জন্যে পৃথক পৃথক ভাষা ও মর্যাদা দিয়েছেন। আর নিজের ভাষায় প্রত্যেকের স্বকীয়তা প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছেন। মায়ের ভাষা কথা বলা গৌরবের ব্যাপার। বাংলা আমাদের মায়ের ভাষা। বাংলা ভাষার জন্যে আমরা গর্ববোধ করি। এই ভাষার জন্যে আমরা মহান প্রভুর নিকট শুকরিয়া আদায় করি। ইরশাদ হয়েছে, ‘যদি তোমরা (আমার অনুগ্রহের) কৃতজ্ঞতা আদায় করো তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের জন্যে (এ অনুগ্রহ) আরো বাড়িয়ে দেবো।’ (সূরা ইব্রাহিম:৭)। প্রত্যেক বছর একুশে ফেব্রুয়ারি আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়। বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য ভাষার মানুষেরা ও এই দিবসটি পালন করেন। কোরআনেও আল্লাহ তা‘য়ালা নেয়ামতের বিশেষ দিনসমূহ স্মরণের জন্য তাগিদ দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, তুমি তাদের আল্লাহর (অনুগ্রহের বিশেষ) দিনগুলোর কথা মনে করাও।’ (সূরা ইব্রাহিম:৫)।
মায়ের ভাষায় দ্বীন প্রচারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য রয়েছে। মায়ের ভাষা সকলের নিকট সহজ ও অত্যন্ত পরিচিত ভাষা। মায়ের ভাষায় যে কোন বিষয় জানতে বুঝতে সুবিধা। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি কোন নবীই এমন পাঠাইনি, যে (নবী) তার জাতির (মাতৃ) ভাষায় (আমার বাণী তাদের কাছে পৌঁছায়নি), যাতে করে সে তাদের কাছে (আমার আয়াত) পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে পারে।’ (সূরা ইব্রাহিম:৪)। হযরত মোহাম্মদ (সা.) আরব ভূ-খ-ে জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর মাতৃভাষা ছিল “আরবী”। আরবের লোকেরা আরবী ভাষায় কথা বলেন। হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর নিকট প্রথম ওহী আসে আরবী ভাষায়। হযরত জিব্রাঈল আমিন মহান প্রভুর নিকট থেকে ওহী নিয়ে এসে হযরত মহানবী (সা.) কে বললেন, “ইকরা”। যারা বাংলা অর্থ হলো পড়ন। হযরত রাসূল (সা.) তার মনের ভাব সহজে যেন মানুষের নিকট প্রকাশ করতে পারেন। আল্লাহ তা‘য়ালার প্রদত্ত ওহীগুলো যেন সহজে বর্ণনা করতে পারেন। মনের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে যেন রাসূল (সা.)-এর কোন প্রকার কষ্ট না হয় এবং আরবের লোকজনও যেন সহজে রাসূল (সা.)-এর ভাষা বুঝতে পারে। সেজন্যে আল্লাহ আরবী ভাষায় কোরআন নাজিল করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি যদি এ কোরআন (আরবী ভাষার বদলে) আজমী (অনারব ভাষায়) বানাতাম, তাহলে এরা বলতো, কেন এর আয়াতগুলো (আমাদের ভাষায়) পরিষ্কার করে বর্ণনা করা হলো না; কোরআন আজমী ভাষায় অথচ এর বাহক আরবী ভাষার লোক।’(সূরা হা-মীম আস সাজদাহ: ৪৪)। আল্লাহ কোরআনে ঘোষণা করেন, ‘এভাবেই (হে নবী!) আরবী কোরআন আমি আপনার ওপর অবতীর্ণ করেছি, যাতে করে আপনি (এর দ্বারা) মক্কাবাসীদের ও তার আশেপাশে যারা বসবাস করে তাদের সতর্ক করে দিতে পারেন।’ (সূরা আশ শুরা: ৭)।
দ্বীনি দাওয়াতি কাজে মাতৃভাষা ব্যবহারের প্রতি কোরআনে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। মাতৃভাষাতে কথা বলতে সকল দেশের মানুষ স্বাছন্দ্যবোধ করে। মাতৃভাষায় কোরআনের আলোচনা ও নসিহতসমূহ শুনতে অনেকে বেশি শ্রুতি মধুর লাগে। বিশ্বায়নের যুগে অপরের ভাষায় কথা বলতে পাড়াকে অনেকে আধুনিকতা বলে মনে করেন। কোমল মতি শিশুদের শুদ্ধ বাংলা ভাষা চর্চার চেয়ে ইংরেজী শিক্ষার প্রতি অভিভাবকের ঝোঁক বেশি। বাংলা ভাষার চেয়ে শিশুরা কতটা ইংরেজী পড়তে, বলতে ও লিখতে পারল। এসবের প্রতি অভিভাবকরা বেশি তৎপর। মাতৃভাষাকে ভালবাসা প্রত্যেক জাতি গোষ্ঠীর ঈমানী দায়িত্ব। বাংলা ভাষায় দ্বীনি দাওয়াতি কাজের প্রতি আমাদেরকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। ইহার ফলে বাংলা ভাষা চর্চা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভাষা সংক্রান্ত বিষয়ে কোরআনের নির্দেশনার প্রতিও যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা হবে। বাংলা ভাষায় কোরআন ও হাদিস বুঝার জন্যে সহজ অনুবাদ প্রয়োজন। বইয়ের দোকানে বিশুদ্ধ বাংলায় আরবী পুস্তকাদির সরবরাহ কম। বাংলা ভাষায় কিভাবে কোরআনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আরোও সহজভাবে করা যায় তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা প্রয়োজন। তাহলে মাতৃভাষা আরো সমৃদ্ধ হবে। দ্বীনি দাওয়াতি কাজও সম্প্রসারিত হবে।
লেখক : ইসলামিক চিন্তাবিদ ও সূফিতাত্ত্বিক গবেষক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন