রিদওয়ান বিন ওয়ালী উল্লাহ
॥ শেষ কিস্তি ॥
জিহাদ ও জঙ্গিবাদ :
ইসলামে জিহাদের সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা রয়েছে। রয়েছে নির্দিষ্ট শর্ত ও নির্দিষ্ট পদ্ধতি-পন্থা। জিহাদের সঙ্গে জঙ্গিবাদের ন্যূনতম সম্পর্কও নেই। প্রকৃতই কিছু মুসলিম ইসলামের নামে, ইসলাম বা ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে বা অন্যায়ের প্রতিবাদের নামে যে হত্যা বা ধ্বংসাত্মক কর্মে লিপ্ত হচ্ছে তা সম্পূর্ণ ইসলাম বহির্ভূত কাজ। আসলে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ ইসলামী দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও তাদের দেশগুলোর নীরব ইসলামায়ন রোধে জঙ্গিবাদ ইস্যুকেই সর্বোত্তম বিবেচনা করেন। ইসলামকে কলঙ্কিত করতে, ইসলামী দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নতি বন্ধ করতে এবং এ সকল দেশে সামরিক আধিপত্য বিস্তার করতেই তারা গোপন অর্থায়নে কিছু মুসলিম যুবককে বিভ্রান্ত করে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করেছেন।
রাসূল (সা.) বলেন, তোমাদের মধ্যে এমন একটি সম্প্রদায় বের হবে, যাদের সালাতের পাশে তোমাদের সালাত তোমাদের কাছেই নগণ্য বলে মনে হবে, যাদের সিয়ামের পাশে তোমাদের সিয়াম তোমাদের কাছেই নগণ্য বলে মনে হবে, যাদের নেককর্মের পাশে তোমাদের কর্ম তোমাদের কাছেই নগণ্য ও অপছন্দনীয় বলে মনে হবে, যারা কোরআন পাঠে রত থাকবে, কিন্তু কোরআন তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তীর যেমন শিকারের দেহের মধ্যে প্রবেশ করে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে যায়, তেমনি তারা দ্বীনের মধ্যে প্রবেশ করে আবার বেরিয়ে যাবে। (বুখারি)
জঙ্গিবাদ হারাম :
উপরোল্লিখিত আয়াত ও হাদিসসমূহ দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে যে, ফ্যাসাদ, হত্যা, জঙ্গিবাদ সন্ত্রাসসহ সবধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের ভয়াবহতা সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করা কিংবা যমীনে ফ্যাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া যে কাউকে হত্যা করল, সে যেন সমস্ত মানুষকেই হত্যা করল। আর যে তাকে বাঁচাল, সে যেন সব মানুষকে বাঁচাল (আল-মায়েদা :৩২)। আল্লাহ তায়’ালা আরো বলেন, আর বৈধ কারণ ছাড়া তোমরা সেই প্রাণীকে হত্যা করো না, আল্লাহ যা হারাম করেছেন (আল-আনআ’ম : ১৫১)।
রাসূল (সা.) বলেন, যদি কোনো ব্যক্তি মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে বসবাসকারী অমুসলিম নাগরিক বা মুসলিম দেশে অবস্থানকারী অমুসলিম দেশের কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করে তবে সে জান্নাতের সুগন্ধও লাভ করতে পারবে না, যদিও জান্নাতের সুগন্ধ ৪০ বৎসরের দূরত্ব থেকে লাভ করা যায়। (বুখারি)
রাসূল (সা.) বলেন, অন্যায়ভাবে একজন মুমিন হত্যা করা আল্লাহর নিকট অধিকতর ভয়াবহ সারা দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার চেয়েও।
রাসূল (সা.) আরো বলেন, কিয়ামতের দিনে মানুষের মধ্যে সর্বপ্রথম যে বিচার করা হবে, তা তাদের মধ্যে সংঘটিত রক্তপাত ও হত্যার বিচার। আল্লাহর রাসূল বলেন, মুসলিমকে গালি দেয়া সীমালংঘনমূলক কাজ, আর তাকে হত্যা করা কুফুরি কাজ। (মুসলিম)
আল্লাহর রাসূল আরো বলেন, অর্থাৎÑ “মনে রেখো যদি কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিম নাগরিকের উপর নিপীড়ন চালায়. তার অধিকার খর্ব করে তার সাধ্যের অতিরিক্ত কোনো কিছু তার উপর চাপিয়ে দেয়, তার কোনো বস্তু জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেয় তাহলে কিয়ামতের দিন আমি আল্লাহর আদালতে তার বিরুদ্ধে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষ অবলম্বন করব।” (আবু দাউদ : ১৬৫৪)
হত্যার পরকালীন শাস্তি :
এরশাদ হচ্ছে, আর যে ইচ্ছাকৃত কোনো মুমিনকে হত্যা করবে, তার প্রতিদান হচ্ছে জাহান্নাম, সেখানে সে স্থায়ী হবে। আল্লাহ তার উপর ক্রুদ্ধ হবেন, তাকে লা’নত করবেন এবং তার জন্য বিশাল আজাব প্রস্তুত করে রাখবেন। (আন্-নিসা :৯৩)
জঙ্গিবাদের কারণ :
সা¤্রাজ্যবাদী নিপীড়ন, আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্র
মুসলিম দেশে ইসলাম দমন
বেকারত্ব ও হতাশা
ইসলামের শিক্ষার বিকৃতি
সমাজে অন্যায়-অবিচারের মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া
ধর্মীয় জ্ঞানহীন শিক্ষা
জঙ্গিবাদ দমনের উপায় :
সমাজ ও রাষ্ট্রের করণীয় :
কারণ নিয়ন্ত্রণ : জঙ্গিবাদের মৌলিক কারণগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়ে যাবে।
বেকারত্ব দূর করা
হতাশা ও অজ্ঞতা দূর করা : বঞ্চিত, বেকার ও হতাশ যুবক সহজেই জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ে। কারণ তার কোনো কর্ম নেই এবং তার পাওয়ার আশার বিপরীতে হারানোর তেমন কিছুই থাকেনা।
সংশোধন নীতি গ্রহণ : চরমপন্থা বা জঙ্গি কর্মকা-ে লিপ্তদেরকে যথাসম্ভব সংশোধ করে সমাজের মূলধারায় সংযুক্ত করাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। বিশেষত যারা হত্যা বা অনুরূপ অপরাধে জড়িত হয়নি তাদেরকে সংশোধনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
প্রকৃত অপরাধীকে শাস্তি দেয়া ও নিরপরাধীকে শাস্তি থেকে রক্ষা করা।
জঙ্গিবাদ দমনের নামে ইসলামী দাওয়াতের কণ্ঠরোধ না করা।
সাধারণ শিক্ষাব্যবস্থায় অধিকতর ইসলামী ও নৈতিক শিক্ষার সংযোজন করা।
ধর্মীয় ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করা : জুমআর খুতবায় বিশেষ গুরুত্বের সহিত আলোচনা করা।
সমাজের ও দেশের প্রাজ্ঞ আলিমগণের সমন্বয়ে বিশেষ বোর্ড গঠন করে জঙ্গিবাদ সম্পর্কে জাতিকে সঠিক ধারণা দেয়া। তাদের বক্তব্য সকল গণমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থা করা।
আল্লাহর নেয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে তার নির্দেশ মেনে চলতে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা। কেননা আল্লাহর আদেশ অমান্য করতে থাকলে বিভিন্ন রকম আসমানি শাস্তি ও গজব আল্লাহ নাযিল করেন।
আলিম ও দা’ঈগণের করণীয় : বিভ্রান্তির তাত্ত্বিক পর্যালোচনা করা, বিভ্রান্ত মানুষকে সঠিক জ্ঞান দান করা, ইসলামী শিকক্ষার বিকৃতি রোধকল্পে রাসূল (সা.) ও সাহাবীদের পথ অনুসরণের নির্দেশনা দেয়া আলিমগণের কর্তব্য। ইসলামী দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নেয়া। দুনিয়ামুখিতা বা ফলাফল-মুখিতা বর্জন করে একান্ত সুন্নাতের আলোকে দ্বীন প্রচার করা। পরস্পর ঘৃণা ও অসহিষ্ণুতা বর্জন করা।
পারিবারিকভাবে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শরিয়তসম্মত পদ্ধতিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। ছোট থেকেই সন্তানদেরকে নৈতিক শিক্ষায় গড়ে তোলা।
অবশেষে বলতে পারি, সকল দুর্যোগ থেকে রক্ষার নিমিত্তে একটি পথই কেবল নির্ভুল। আর তা হচ্ছে কোরআন-সুন্নাহকে শক্ত করে আকড়ে ধরা। এতেই সম্ভব জঙ্গিবাদকে সমূলে উৎখাত করা। কোরআন-সুন্নাহর অনুসরণই পারে আগামী প্রজন্মের জন্য একটি সুখী সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ উপহার দিতে।
লেখক : এম. ফিল গবেষক, ইবি। প্রভাষক, জয়নারায়ণপুর ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, নোয়াখালী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন