সায়ীদ আবদুল মালিক : হঠাৎ অসময়ের ঝড়-বৃষ্টি। মাত্র ২০ মিনিটের বৃষ্টিতেই ভেসে গেছে ঢাকার রাজপথ। আর এতেই নগরবাসী পড়েছে পানিবদ্ধতাসহ যানজটের ভোগান্তিতে। ভুক্তভোগীদের মতে, দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার কাজ হচ্ছে না। আবার কোনো কোনো এলাকায় পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থাও নেই। যে কারণে সামান্য বৃষ্টি হলেই রাজধানীর প্রধান সড়ক থেকে অলিগলি সর্বত্রই পানিতে ডুবে যায়।
রাজধানীর ডিএনডি বাঁধসহ বহু এলাকায় একটু বৃষ্টি হলেই হাঁটুপানি জমে যায়। এতে বৃষ্টির পানি জমে থাকে দিনের পর দিন। হাঁটুপানিতেই চলাচল করতে হয় ওইসব এলাকার মানুষকে। পুরান ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা সবচেয়ে অপ্রতুল। হালকা বৃষ্টি হলেই ড্রেন ভরে রাস্তায় জমে যায় পানি। দুর্গন্ধযুক্ত ও পচা পানিতেই চলতে হয়ে পুরান ঢাকাবাসীকে। একই অবস্থা রাজধানীর অন্যান্য এলাকারও। এ ছাড়া নগরীর বিভিন্ন স্থানে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির জন্য খানাখন্দের সৃষ্টি হয়ে পানি জমে যায়। রাস্তার এসব গর্তে যানবাহন পড়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল আলম চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, গতকাল বুধবার যে বৃষ্টি হয়েছে তা অসময়ের বৃষ্টি এবং অল্প সময়ে অনেক বৃষ্টি, যে কারণে পানি নিষ্কাশন হতে কিছুটা সময় লেগেছে। অন্যদিকে সেগুনবাগচা খালের মুগদা-মানিকনগর অংশে বাঁধ দিয়ে উন্নয়ন কাজ চলার কারণেও পানি সঠিক গতিতে নি¤œাঞ্চলের দিকে যেতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুম শেষ হলে ওয়াসার পাইপলাইনগুলো ক্লিনসহ ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজ করা হয়ে থাকে। এবছর আমরা এখনও সে কাজগুলো সেরে উঠতে পারিনি। তিনি বলেন, এই ফেব্রুয়ারি ও মার্চের মধ্যে আমরা সে কাজগুলো সেরে উঠতে পারব বলে আশা রাখি। এছাড়া আমরা ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে নানা কাজ হাতে নিয়েছি। সেগুলোর কিছু কাজ শেষ হয়েছে আরও কিছু শেষের পথে রয়েছে।
এদিকে গতকাল বুধবার ভোররাতেও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় সাতক্ষীরায় সর্বোচ্চ ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। রাঙামাটিতে ৬১ এবং মাদারীপুরে ৪৭ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া বৃষ্টি হয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকু-, কুমিল্লা, ফেনী, শ্রীমঙ্গল, গোপালগঞ্জ, খুলনায়ও।
আবহাওয়া বিভাগ বলছে, পুবালি লঘুচাপের প্রভাবে আজ বৃহস্পতিবারও রাজধানী ঢাকা এবং এর আশপাশে বৃষ্টি হতে পারে। তারা জানায়, মৌসুমি বায়ু ঊর্ধ্বগামী হওয়ার কারণেও বৃষ্টি হচ্ছে। রংপুর ছাড়া সব বিভাগেই কম-বেশি বৃষ্টি হয়েছে। তবে এ ধরনের বৃষ্টি পরিমাপযোগ্য নয়। মৌসুমের শুরুতে এ ধরনের বৃষ্টি এটাই প্রথম।
গতকাল বুধবার আকাশের অবয়ব সকাল থেকেই জানান দিচ্ছিল বৃষ্টি নামতে পারে রাজধানী ঢাকায়। তার ওপর গেল রাতে ঢাকায় ও এর আশপাশের কয়েক জেলায় বৃষ্টি হওয়ায় এ সম্ভাবনা আরো বেড়ে যায়। পূর্ভাবাসও ছিল আবহাওয়া বিভাগের।
বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে আকাশ। বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে পড়তে শুরু করে শিলা, সঙ্গে ঝুম বৃষ্টিও। শেষ হয় ১১টা ৫৭ মিনিটে।
তবে বসন্তের শুরুতে এ বৃষ্টি নতুন কিছু নয়। নতুন যোগ হলো শুধু শিলা। প্রকৃতির আকস্মিক এ আচরণে অনেকটা বেসামাল কর্মব্যস্ত ঢাকার রাজপথের পথচারীরা। ঘটনার আকস্মিকতায় অনেকে বিস্মিতও হন। শিলা ও বৃষ্টির তোপ থেকে বাঁচতে ছোটাছুটি করতে দেখা যায় অনেককে। আশ্রয়ের খোঁজ পেতে পেতে অনেকে ভিজেও যান।
মাত্র সাত মিনিট স্থায়ী এ শিলাবৃষ্টিতে মহানগরীর অনেক সড়কে দেখা গেছে জলজট। এতে পথচারী ও যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হতে দেখা যায়। যানজটও লেগে যায় কোনো কোনো সড়কে। তবে বেশিক্ষণ আকাশ তার মনকে ভালো রাখতে পারেনি। চারপাশ আঁধার করে দুপুর পৌনে ৩টার দিকে আবারো ঢেলে দিল বারিধারা। এ বৃষ্টি স্থায়ী হয় ১২ মিনিট। যেন যোগ হয় নগরবাসীর আরো ভোগান্তি। ডুবে যায় রাজধানীর শান্তিনগর, কাকরাইল, বিজয়নগর মোড়, বংশালসহ আরো বেশকিছু এলাকা। শিলাবৃষ্টি হওয়ায় সেই পানি ছিল প্রচ- ঠা-া। এই ঠা-াকে উপেক্ষা করেই রাস্তায় নামতে হয়েছে ব্যস্ত মানুষগুলোকে।
এদিকে ঢাকাসহ দেশব্যাপী শিলাবৃষ্টিতে আমের মুকুলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রায় আধা ঘণ্টার বৃষ্টিতে সচিবালয়ের ভেতরে অনেক স্থানে জমে যায় পানি। শিলাও জমে প্রায় ৪ ইঞ্চি পরিমাণ। শিলার তোপে সচিবালয়ের বিভিন্ন আম গাছে আসা মুকুল প্রায় ঝরে গেছে।
সকাল ১১টার পর থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয় গুলশান এলাকায়। পরে ঝড়ো বৃষ্টি, সাথে শিলা। হঠাৎ বৃষ্টিতে কর্মব্যস্ত মানুষকে এ সময় ব্যাপক ভোগান্তির শিকার হতে দেখা যায়।
আকাশ অন্ধকার করে প্রচন্ড শিলাবৃষ্টিতে রাস্তায় কাদাপানি জমে যায়। বিপুল পরিমাণে শিলা পড়ায় রাস্তায় শিলার স্তূপ জমে যায়। সাথে সৃষ্টি হয়েছে যানজট।
হোসেইন আলম নামে এক পথচারী জানান, হঠাৎ শিলা বৃষ্টিতে কাকলী-বনানী থেকে গুলশান পর্যন্ত রাস্তার দু’ধারে যেসব আম গাছ দেখা যায়, তার প্রায় সবগুলোর মুকুল ঝরে গেছে। অসময়ে এই শিলা বৃষ্টিতে হতবাক মানুষ।
এছাড়া রাজধানীর অনেক এলাকায় শিলা বৃষ্টিতে আমের মুকুলের ক্ষতি, হালকা পানিবদ্ধতা ও যানজটের খবর পাওয়া গেছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে।
বৃষ্টির কারণে যানবাহন সঙ্কটে পড়ে ভোগান্তির শিকার হন অফিস ফেরৎ ঘরমুখো মানুষ। রামপুরা, বাড্ডা, শান্তিনগর, শাহজাহানপুর, মালিবাগ, মৌচাক, মিরপুর ও পল্টন এলাকার রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে যায়। রাজধানীর মালিবাগ মগবাজার এলাকায় ফ্লাইওভার নির্মাণ কাজের জন্য মগবাজার, মালিবাগ, তেজগাও, রাজারবাগ, মালিবাগ রেলগেট ও রামপুরা সড়কে যানবাহন চলাচলে মারাত্মক বিঘœ ঘটছে। রাস্তায় বড় বড় গর্ত সৃষ্টি হওয়ায় যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। এমনকি রিক্সা নিয়েও এসব সড়কে চলাচল করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বৃষ্টির কারণে রাজধানীর এসব সড়কে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। কয়েকটি স্থানে বাস, ট্রাক এমনকি রিক্সা গর্তে পড়ে যেতে দেখা গেছে।
সামান্য এ বৃষ্টিতে গতকাল ব্যাংক পাড়া মতিঝিলের বনশিল্প ভবন ও বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের আশপাশের এলাকা, শান্তিনগর, আরামবাগ, ফকিরাপুল, কাকরাইল দেখা গেছে হাঁটু পানি। সময় মত পানি নেমে না যাওয়ায় প্রধান প্রধান সড়কে পানি জমে যায়। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়গুলোতে পানিবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় গাড়ি চলাচলেও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও সড়কের ম্যানহোলের ঢাকনা না থাকায় অনেকেই দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়েছে। আবার পানিবদ্ধতার কারণে কোথাও কোথাও যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে থাকতেও দেখা গেছে।
মাত্র কয়েক মিনিটের বৃষ্টিতে রাস্তা তলিয়ে গেছে মালিবাগ চৌধুরীপাড়া থেকে কাকরাইল মোড়ের আগ পর্যন্ত। হঠাৎ বৃষ্টিতে পথচলায় ছন্দ হারিয়েছেন পথচারী ও গাড়ির যাত্রীরা।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ফাগুনের প্রথম বৃষ্টিতে রাজধানীর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সড়কে চলাচল অস্বাভাবিক হয়ে গেছে। রাস্তা পানিতে ডুবে গেছে। ইঞ্জিনে পানি প্রবেশ করায় পথের মাঝে বন্ধ হয়ে রয়েছে একাধিক গাড়ি। রাস্তায় পানি থাকায় হাতে জুতা নিয়ে পথ চলতে হচ্ছে সবাইকে। কেউ কেউ মাঝে মাঝে পা তুলে জুতার পানি বের করছেন।
শান্তিনগর এলাকায় শুধু মেয়েদের একাধিক স্কুল-কলেজ থাকায় বেশি সমস্যায় পড়েছে মেয়েরা ও তাদের অভিভাবকরা। অধিকাংশ মেয়ে শিক্ষার্থীকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। রাস্তায় খালি রিকশা থাকলেও কোনো রিকশাচালক যেতে চান না বলে জানায় মগবাজার গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী মাইসা ও আনিলা।
তবে এ সড়কে ফ্লাইওভারের কাজ চলায় অনেক গর্ত থাকায় গাড়ি চালাতে ভয় পাচ্ছেন বলে জানান চালকরা।
অনেক প্রাইভেটকারও অচল হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। অচল হয়ে যাওয়া একটি প্রাইভেটকারকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য তিনশ’ টাকা দিয়ে দু’জনকে ভাড়া করে গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন