সন্ত্রাস বর্তমান সময়ের সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। একবিংশ শতাব্দীর জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতার সাথে প্রতিযোগিতা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে সন্ত্রাস। সন্ত্রাস একদিকে যেমন বিশ্ব শান্তিকে হুমকির মুখে দাঁড় করে দিয়েছে অন্যদিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে সভ্যতার সৌধকে। বর্তমান বিশ্বে ইসলামকে সন্ত্রাসের সাথে একাকার করে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে। অথচ মানবসভ্যতার শুরুতেই সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার মহান ব্রত নিয়ে ইসলাম পৃথিবীতে এসেছে। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা সন্ত্রাসের সাথে ইসলামী অনুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে, এর দ্বারা ইসলামপ্রিয় জনগোষ্ঠীকে আতঙ্কিত করে তোলা হচ্ছে এবং বিশ্বে ইসলাম সম্পর্কে ভুল ধারণার সৃষ্টি করা হচ্ছে। অত্র প্রবন্ধে সন্ত্রাস এর সংজ্ঞা, কুরআন ও হাদীসে সন্ত্রাস প্রসঙ্গ, সন্ত্রাস প্রতিরোধে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা ও মহানবী সা. এর কার্যক্রম বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
সন্ত্রাস এর সংজ্ঞা ঃ সন্ত্রাস একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নির্ধারণ বর্তমান মতবিরোধপূর্ণ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে একপ্রকার অসম্ভবই বটে। কারণ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা যে কোন বিষয় বা মতবাদের সংজ্ঞার ভিন্নতা নির্দেশ করে। তাই তো দেখা যায়, এক গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে যে কর্মকান্ড সন্ত্রাসের মতো নিকৃষ্ট ও ঘৃণিত কর্ম, অপর গোষ্ঠীর দৃষ্টিতে সে কর্মকান্ডই স্বাধীনতা কিংবা স্বাধিকার আদায় সংগ্রামের মতো মহৎ ও প্রশংসনীয় কর্ম। সন্ত্রাসের সংজ্ঞায়নে বিতর্ক থাকলেও বক্ষ্যমাণ আলোচনার উদ্দেশ্য অর্জনের প্রয়োজনে সন্ত্রাসের একটি সুনির্দিষ্ট পরিচয় নির্ধারণ আবশ্যক।
সন্ত্রাস শব্দটি বাংলা ‘ত্রাস’ শব্দ উদ্ভূত। যার অর্থ ভয়, ভীতি, শঙ্কা। “ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক ও অন্যান্য সম্পাদিত, ব্যবহারিক বাংলা অভিধান, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯২, পৃ. ৫৭৩”
আর সন্ত্রাস অর্থ হলো, মহাশঙ্কা, অতিশয় ভয়, “আহমদ শরীফ সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৬, পৃ. ৫৪১” কোনো উদ্দেশ্যে মানুষের মনে ভীতি সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা, অতিশয় শঙ্কা বা ভীতি, “ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক ও অন্যান্য সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১৩’’ অতিশয় ত্রাস বা ভয়ের পরিবেশ, “শৈলেন্দ্র বিশ্বাস, সংসদ বাংলা অভিধান, কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ প্রাইভেট লিমিটেড, ২০০০, পৃ. ৮০৪” ভীতিজনক অবস্থা, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য অত্যাচার, হত্যা প্রভৃতি হিংসাত্মক ও ত্রাসজনক পরিবেশ। “রিয়াজ আহমদ, ব্যবহারিক শব্দকোষ, ঢাকা: সাহিত্য বিলাস, ২০০৮, পৃ. ২৬২” সন্ত্রাস এর সমার্থক শব্দ হিসাবে সন্ত্রাসবাদ, আতঙ্কবাদ, বিভীষিকাপন্থা, সহিংস আন্দোলন, উগ্রপন্থা, উগ্রবাদ, চরমপন্থা ইত্যাদিও ব্যবহৃত হয়। “অশোক মুখোপধ্যায়, সংসদ সমার্থ শব্দকোষ, কলকাতা: সাহিত্য সংসদ, ১৯৮৮, পৃ. ২৪৭” বর্তমানে সন্ত্রাস কোন বিচ্ছিন্ন কর্মকান্ড নয়। বর্তমানে এটি একটি মতবাদে পরিণত হয়েছে। তাই সন্ত্রাস ভিত্তিক বা কেন্দ্রিক মতবাদ ও কর্মকান্ডকে বুঝাতে সন্ত্রাসবাদ শব্দটি বহুল প্রচলিত। অভিধানে “সন্ত্রাসবাদ” অর্থ লেখা হয়েছে যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য হত্যা অত্যাচার ইত্যাদি কার্য অনুষ্ঠাননীতি, “ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক ও অন্যান্য সম্পাদিত, প্রাগুক্ত, পৃ. ১১১৩,” রাজনীতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য পীড়ন, হত্যা প্রভৃতি হিংসাত্মক ও ত্রাসজনক কর্ম অবলম্বন করা উচিত- এই মত। “শৈলেন্দ্র বিশ্বাস, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮০৪,” ইংরেজীতে সন্ত্রাস অর্থ বুঝাতে Terror: great fea/alarm terrorsm Mohammad Aland others Bangl Academy Bangla-English Dictionary, Dhaka: Bangla Academy, 1994, p. 786” extreme fear, the use of organized intimidation terrorsm [based on latin terrere oto frighten”, ”Illustrated OXFORD DICTIONARY. London: Dorling kindersley limited, 2006. p. 859” শব্দসমূহ ব্যবহৃত হয়।
আধুনিক আরবি ভাষায় সন্ত্রাস শব্দের প্রতিশব্দ হলো (ইরহাব)। “ড. মুহাম্ম ফজলুর রহমান, আধুনিক আরবী-বাংলা অভিধান, ঢাকা: রিয়াদ প্রকাশনী, ২০০৯, পৃ. ৭১” এ শব্দটি এসেছে (রাহবুন) থেকে যার অর্থ (খাফ) ভীত হলো, ভয় পেলো ইত্যাদি। “ইবনে মানযুর আল-আফরাকী আল-মিসরী, লিসানুল আরব, বৈরূত: দারুল সাদির, তা.বি.খ. ১, পৃ. ৪৩৬” আর (ইরহাব) অর্থ হলো (তাখভীফ) ও (তাফযী), “ইবরাহীম মুসতাফা ও অন্যান্য, আল-মু’জামুল ওয়াসীত, বৈরূত: দারুল দা’ওয়াহ, তা.বি.খ. ১, পৃ. ৩৭৬: আল-মুনজিদ ফিল লুগাহ, বৈরূত: দারুল মাশারিক, ১৯৯৪, পৃ. ২৮২” তথা ভীতিপ্রদর্শন, শঙ্কিতকরণ, আতঙ্কিতকরণ। “ড. মুহাম্মদ ফজলুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ২৬৪, ৩০৩” সন্ত্রাস এর শাব্দিক বা আভিধানিক অর্থের ব্যাপারে মতানৈক্য তেমন না থাকলেও এর পারিভাষিক সংজ্ঞা নির্ধারণে যথেষ্ট মতানৈক্য পরিলক্ষিত হয়। আর এই মতানৈক্যের কারণেই আজ পর্যন্ত সন্ত্রাস এর সর্বসম্মত কোন পারিভাষিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক Global terrorism এর উপর প্রকাশিত annual review 2000 এ বলা হয়েছে যে, No one defination of terrorism has gained universal acceptance অর্থাৎ সন্ত্রাসের কোন সংজ্ঞা সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। ”The Guadrdian date: 7 May, 2001” প্রত্যেক মতবাদীরাই নিজ নিজ বিশ্বাস দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি সন্ত্রাসের সংজ্ঞা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছে। ব্যক্তি থেকে শুরু করে রাষ্ট্র, দেশীয়, আঞ্চলিসক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ সন্ত্রাসের সংজ্ঞায়নে চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। বর্তমান বিশ্বে সন্ত্রাসকেন্দ্রিক আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে দুইটি প্রধান দর্শন। একটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগীদের সমন্বয়ে গঠিত পাশ্চাত্য দর্শন। অপরটি ইসলামী দর্শন। তাই সন্ত্রাস এর সংজ্ঞা নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ উভয় দর্শন থেকে প্রদত্ত সংজ্ঞাসমূহ উল্লেখ করা হলো। ১। যায়েদ ইবনু মুহাম্মদ ইবনে হাদী আল-মাদখালী বলেন, ‘ইরহাব (সন্ত্রাস) এমন একটি শব্দ বিভিন্ন আঙ্গিকে যার অনেক অর্থ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে- নিরপরাধ অন্যায়ভাবে নির্দোষ মানুষকে ভয় দেখানো ও শঙ্কি করা। কখনো নিরীহ ব্যক্তিবর্গকে হত্যার সীমাহীন ভীতি প্রদর্শন, সুরক্ষিত সম্পদ বিনষ্ট বা লুট, সতী-সাধবী নারীর সম্ভ্রমহানি করা। “প্রফেসর ফাহাদ ইবনে ইবরাহীম আবুল উসারা, লামহাত আনিলি ইরহাবি ফিল আসরিল হাযির, সউদী আরব: জামি’আ আল-ইমাম মুহাম্মাদ বিন সাউদ আল-ইসলামিয়্যাহ, ২০০৪, পৃ. ৫” ২। আল-মাওসূ’আহ আল-আরাবিয়্যাহ আল-‘আলামিয়্যাহ গ্রন্থে বলা হয়েছে, ইরহাব (সন্ত্রাস) হচ্ছে ভীতি সঞ্চারের জন্য বল প্রয়োগ করা অথবা বল প্রয়োগের মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শন করা। “আব্দুল আযীয ইবনে আব্দুল্লা, আল-ইরহাব আসবাবুহু ওয়া ওয়ায়িদুল ইলাজ, মাজাল্লাতুল বুহুছ আল-ইসলামিয়্যাহ, সউদী আরব: কেন্দ্রীয় দারুল ইফতা, ২০০৩ সংস্যা-৭০ পৃ. ১০৮-১০৯” ৩। রাবিত্বাতুল আলামিল ইসলাম’ পরিচালিত ‘ইসলামী ফিক্বহ কাউন্সিল’ ১৪২২ হিজরীতে মক্কায় অনুষ্ঠিত ১৬তম অধিবেশনে সন্ত্রাসের নিম্নোক্ত সংজ্ঞা নির্ধারণ করে, কোন ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র কোন মানুষের ধর্ম, বুদ্ধিমত্তা, সম্পদ ও সম্মানের বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে যে শত্রুতার চর্চা করে তাকে সন্ত্রাস বলে”।
এ সংজ্ঞা সব ধরনের নীতিবহির্ভূত ভীতি ও হুমকি প্রদর্শন, ক্ষতিসাধন, অন্যায় ও বিচার বহির্ভূত হত্যা, অপরাধমূলক হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার লক্ষ্যে একক ও সমষ্টিগতভাবে পরিচালিত যে কোন ধরনের অন্যায় কর্ম, সশস্ত্র হামলা, চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি, রাহাজানি, ভীতিকর ও হুমকিপূর্ণ কাজ এবং এবং লোকজনের জীবন, স্বাধীনতা, নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে, জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে এমন কর্মকান্ডকে শামিল করে। তাছাড়া পরিবেশে বিপর্যয় সৃষ্টি, ব্যক্তিগত ও জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট বা প্রাকৃতিক সম্পদকে ধ্বংস করাও সন্ত্রাস হিসাবে গণ্য হবে। “প্রফেসর ফাহাদ ইবনে ইবরাহীম আবুল উসারা, প্রাগুক্ত, পৃ. ৫”। ৪। ১৯৮৯ সালে আরব দেশসমূহের আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ প্রদত্ত সংজ্ঞা হচ্ছে- সহিংসতা সৃষ্টিকারী বা হুমকি-ধমকি প্রদানকারী এমন সব কাজ যা দ্বারা মানবমনে ভীতি-আতঙ্ক, ভয় ও ত্রাস সৃষ্টি হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন