মহসিন রাজু, বগুড়া থেকে : বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একজন মহিলা ইন্টার্নিকে ‘সিস্টার’ বলে সম্বোধন করার কথিত অপরাধে এই হাসপাতালের চতুর্থ তলায় অবস্থিত মডিক্যাল ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আলাউদ্দিন সরকার (৬৫) নামের একজন বৃদ্ধ রোগীর (অ্যাটেনডেন্ট) যুবক পুত্রকে দলবেঁধে ইন্টার্নি ডাক্তাররা দফায় দফায় অমানবিকভাবে মারধর করে গুরুতর আহত করেছে। ইন্টার্নিরা আব্দুর রউফ (৩৫) নামের ওই যুবককে শুধু অমানবিক ও বর্বর কায়দায় মারধর করেই ক্ষান্ত হয়নি তাকে করজোড়ে ক্ষমা চাওয়ানো ছাড়াও কান ধরে ১শ’বার ওঠবস করতেও বাধ্য করেছে। নিজের যুবক পুত্রের এই বেহাল দশা দেখে ক্ষোভে-দুঃখে লজ্জা অপমানে মুমূষূু দশায় উপনীত হয়েছেন আলাউদ্দিন সরকার।
পরে এই ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ইন্টার্নিরা নাটকীয়ভাবে ইন্টার্নিদের প্রণীত ৭ দফা দাবিতে ধর্মঘট আহŸান করে হাসপাতালে তালা দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে চিকিৎসা কার্যক্রম অচল হয়ে পড়ায় রোগীরা দলে দলে হাসপাতাল ত্যাগ করছে বলে লক্ষ্য করা গেছে। রোববার দুপুরে এ ঘটনার পর হাসপাতালের রোগী, অ্যাটেনডেন্ট ও কর্মচারী, নার্স এবং সিনিয়র ডাক্তাররা ইন্টার্নিদের এই কর্মকাÐ দেখে হতভম্ব হয়ে পড়েন।
খবর পেয়ে হাসপাতালে খবর সংগ্রহের জন্য সাংবাদিকরা ঘটনাস্থলে পৌঁছলে উন্মত্ত ইন্টার্নিরা সাংবাদিকদের খবর সংগ্রহ ও ছবি তোলার কাজেও বাধা দেয়।
তবে ঘটনা সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনার শিকার, কিছু ডাক্তার, নার্স ও কর্মচারীরা জানান, শনিবার দিবাগত রাতে বগুড়ার পার্শ্ববর্তী সিরাজগঞ্জ জেলা সদরের কোনাগাঁতি গ্রামের আলাউদ্দিন সরকারকে (৬৫) হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বগুড়া শহীদ জিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের ৪৭৫ নম্বর কক্ষে ভর্তি করা হয়। বৃদ্ধ আলাউদ্দিন সরকারের হৃদরোগের পাশাপাশি অ্যাজমাও ছিল। গতকাল রোববার সকাল সাড়ে ১১টায় ফ্যানের বাতাসে তার শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে তার অ্যাটেনডেন্ট ও বড় ছেলে রউফকে (৩৫) ফ্যান বন্ধ করতে বলেন। রউফ ফ্যানের সুইস কোথায় তা জানার জন্য সেখানে উপস্থিত একজন মহিলা ইন্টার্নিকে সিস্টার বলে সম্বোধন করে ফ্যানের সুইস কোথায় জানতে চান। এতে ভীষণভাবে মাইন্ড করে ওই ইন্টার্নি ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন, আমি আয়া নাকি?
রউফ ও মহিলা ইন্টার্নির এই কথোপকথনের মধ্যেই উত্তেজিত হয়ে এক পুরুষ ইন্টার্নি রউফের কলার চেপে ধরে ঘুষি মেরে বলে, এই তুই ডাক্তারের সাথে খারাপ ব্যবহার করছিস কেন? এ নিয়ে দু’জনের উত্তপ্ত কথোপকথনের মধ্যেই অন্য ইন্টার্নিরা একজোট হয়ে রউফকে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি-লাথি মারতে থাকে। পরে রউফকে পুলিশে দেয়ার কথা বলে একটি ঘরে আটকে রাখে। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত ওই ঘরে আটক রউফকে ইন্টার্নিদের বিভিন্ন গ্রæপ এসে খাঁচায় আটক পশুর মতো মারধর করতে থাকে। সিনিয়র ডাক্তাররাও এই অমানবিক ঘটনারোধে উন্মত্ত ইন্টার্নিদের নিবৃত করতে পারেননি। এদিকে ছেলের ওপর এই বর্বোরোচিত মারধরের ঘটনা থেকে অসুস্থ বৃদ্ধ আল্উাদ্দিন সরকারের অসুস্থতা গুরুতর আকার ধারণ করলে কয়েকজন সিনিয়র ডাক্তার তাকে মেডিক্যাল ওয়ার্ড থেকে আইসিইউ ইউনিটে শিফট করে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যান আলাউদ্দিন সরকার। এদিকে দফায় দফায় মারধরের পরও জিঘাংসা না মেটায় ইন্টার্নিরা রউফকে কয়েক দফা কানে ধরা অবস্থায় ওঠবস করায়।
অনেক বাধা-বিপত্তির পর ইন্টার্নিদের বাধার মুখেও মেডিক্যাল ফাঁড়ির টিএসআই শাহআলম রউফ সরকারকে উদ্ধার করে তাদের হেফাজতে নেয়। অসুস্থ পিতা আলাউদ্দিন ও ইন্টার্নিদের হামলায় আহত ভাইকে দেখতে আলাউদ্দিনের কন্যা বীনা ও নিকটাত্মীয় সেতু হাসপাতালে এসে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাসুদ আহসানকে পেয়ে তার কাছে বিচার চাইলে পরিচালকের সামনেই ওই দু’জন মহিলাকে নির্লজ্জ কায়দায় শারীরিকভাবে নাজেহাল করে। কয়েকজন সাংবাদিক এ ব্যাপারে পরিচালককে জিজ্ঞেস করলে তিনিও ইন্টার্নিদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, ‘আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনছিলাম, কিন্তু উনারই (বীনা ও সেতু ) তো অভিযোগ করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করল?
বেলা ৪টার দিকে হাসপাতালের পরিচালকসহ অন্য কর্মকর্তারা জরুরি বিভাগের তালা খোলাসহ চিকিৎসা কার্যক্রম শুরুর কথা সাংবাদিকদের বললেও ইন্টার্নিদের মুখপাত্র কুতুব উদ্দিন জানান, বেলা সাড়ে ১২টা থেকে আমরা জরুরি বিভাগ বন্ধসহ কর্মবিরতি করছি ডাক্তারদের নিরপত্তাসহ ৭ দফা দাবিতে আমাদের আন্দোলন চলবে। ৭ দফা দাবি পূরণ না হলে আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ইন্টার্নিদের ডাকা ধর্মঘটে জরুরি বিভাগ বন্ধ থাকায় হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া রোগী, শিশুসহ অন্তত শতাধিক রোগী হাসপাতাল ছেড়ে গেলেও চিকিৎসাধীন রোগী ও তাদের অ্যাটেনডেন্টরা চরম শঙ্কায় পড়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন