মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

‘ইসলাম’ সন্ত্রাস নয়, শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম

| প্রকাশের সময় : ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

\ দুই \
একটি বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য জনগণের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করার সুসংগঠিত পন্থাই হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ”। ৬. মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা FBI সন্ত্রাসকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে, The unlawful use force and valence against persons of property to intimidate or coerce a government, the civilian population, or any segment thereof, in furtherance of political of social objectives (28. C.F.R. Section 0.85) www.fbi.gov/stats-services/publications/ terrorism-2002-2005”
অর্থাৎ- সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে কোন সরকার, বেসকারি জনগণ বা অন্য যে কোন অংশকে ভীতি প্রদর্শন বা দমনের জন্য ব্যক্তিবর্গ বা সম্পদের উপর অবৈধ শক্তি প্রয়োগ বা সহিংস ব্যবহারকে সন্ত্রাস বলা হয়।
যে কর্মকান্ড সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, জানমালের ক্ষতি সাধন, দেশ ও সমাজে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি, শান্তি ও নিরাপত্তা ক্ষুণœ, স্থাপনা ও স্থাপত্য ধ্বংস এবং সর্বস্তরের নাগরিকদের আতঙ্কিত করে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে হুমকির সম্মুখীন করে তাকে বলা হয় সন্ত্রাস। মোটকথা যে কর্মকান্ড জনগণের মাঝে ভয়-ভীতি ও আতংকের সৃষ্টি করে এবং জানমালের ক্ষতি সাধন করে তাই সন্ত্রাস এবং যে বা যারা এসকল কর্মকান্ডের সাথে জড়িত তারাই সন্ত্রাসী।
কুরআনে সন্ত্রাস প্রসঙ্গ ঃ ইসলামী আইনের প্রধান উৎস আল-কুরআনুল কারীমে সন্ত্রাস প্রসঙ্গ দুইভাবে এসেছে: শাব্দিক অর্থে ও পারিভাষিক অর্থে। সন্ত্রাস-এর আরবী প্রতিশব্দ ‘ইরহাব’ কে ভিত্তি ধরে শাব্দিক অর্থ হলো- প্রথমত: আল্লাহকে ভয় করা অর্থে এর শব্দমূলের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। যেমন: আল্লাহ বলেন: “মূসার ক্রোধ যখন প্রশমিত হলো তখন সেগুলো তুলে নিলো। যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে তাদের জন্য তাতে যা লিখিত ছিল মধ্যে ছিল পথনির্দেশ ও রহমত।” “আল-কুরআনুল,৭: ১৫৪” অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন: “হে বনী ইসরাঈল! আমার সেই অনুগ্রহকে তোমরা স্মরণ কর যা দ্বারা আমি তোমাদেরকে অনুগৃহীত করেছি এবং আমার সঙ্গে তোমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ করব। আর তোমরা শুধু আমাকেই ভয় কর।” “আল-কুরআনুল, ২: ৪০।” আল্লাহ অপর এক আয়াতে উল্লেখ আছে, “আল্লাহ বললেন, তোমরা দুই ইলাহ গ্রহণ কর না; তিনিই তো একমাত্র ইলাহ। সুতরাং আমাকেই ভয় কর”। “আল-কুরআন, ১৬: ৫১।”
দ্বিতীয়ত: মানুষকে ভয় দেখানো বা সন্ত্রস্ত করা অর্থেও ইরহাব (ইরহাব) শব্দের সরাসরি ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। আল্লাহ বলেন: “তোমরা তাদের মোকাবেলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখবে এর দ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত্র করবে আল্লাহর শক্রকে, তোমাদের শত্রুকে এবং এ ছাড়া অন্যদেরকে যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাদেরকে শত্রুকে এবং এ ছাড়া অন্যদেরকে যাদেরকে তোমরা জান না, আল্লাহ তাদেরকে জানেন। আল্লাহর পথে তোমরা যা কিছু ব্যয় করবে তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে দেয়া হবে এবং তোমাদের প্রতি যুলুম করা হবে না।” “আল-কুরআন, ৮:৬০।”
সামান্য পরিবর্তিত ফর্মে শব্দটি ব্যবহার করে আল্লাহ অন্যত্র বলেন: “সে (মূসা) বলল, তোমরাই নিক্ষেপ কর। যখন তারা (যাদুকররা রজ্জু ও লাঠি) নিক্ষেপ করল তখন তারা লোকের চোখে জাদু করল, তাদেরকে আতংকিত করল এবং তারা এক রকমের জাদু দেখালো।” “আল-কুরআন, ৭: ১১৬।”
প্রচলিত অর্থে সন্ত্রাস বলতে যা বুঝায় তা প্রকাশের জন্য ইরহাব শব্দের ব্যবহার কুরআনে পাওয়া যায় না। সন্ত্রাস বা সন্ত্রাসী কার্যক্রম বুঝানোর জন্য কুরআনে ‘ফিতনাহ’ এবং ‘ফাসাদ’ শব্দদ্বয়ের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত সীরাত বিষয়ক উর্দু বিশ্বকোষ ‘নুকুশ’ এর বর্ণনা নিম্নরূপ; “পবিত্র কুরআন গভীরভাবে অধ্যয়ন ও গবেষণা করলে এ কথা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, মানুষের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রæ, ঈমান, কায়-কারবার ইত্যাদি যার কারণে হুমকি ও বিপর্যয়ের মুখে পতিত হয় তা-ই হলো ‘ফিতনা’ এবং যার কারণে মানুষের জীবনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, তা-ই হলো ‘ফাসাদ’।” “মো: মুখলেছুর রহমান, সন্ত্রাস নয়, শান্তি ও মহানুভবতার ধর্ম ইসলাম, ঢাকা: এন আরবি গ্রæপ, ২০১১, পৃ. ১৫।”
আল-কুরআনে ‘ফিতনা’ প্রসঙ্গ ঃ আল-কুরআনে ‘ফিতনা’ শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃতক হয়েছে। যেসব আয়াতে ‘ফিতনা’ কে সন্ত্রাস কাছাকাছি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে তার কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো-
১। আল্লাহ অস্বীকার করা, তাঁর অংশীদার সাব্যস্ত করা, ইবাদতে বাধা প্রদান ও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা ফিতনার অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ বলেন, “পবিত্র মাসে যুদ্ধ করা সম্পর্কে লোকে তোমাকে জিজ্ঞাসা করে। বল, তাতে যুদ্ধ করা ভীষণ অন্যায়। কিন্তু আল্লাহর পথে বাধা দান করা, আল্লাহকে অস্বীকার করা, মসজিদুল হারামে (প্রবেশে) বাধা দেয়া এবং তার বাসিন্দাকে তা হতে বহিষ্কার করা আল্লাহর নিকট তদপেক্ষা অধিক অন্যায়; ফিতনা (দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা, নির্যাতন) হত্যা অপেক্ষা গুরুতর অন্যায়।” “আল-কুরআন, ২: ২১৭”
২। দুর্বলের উপর অত্যাচার করা, তাদের ন্যায্য অধিকার হরণ করা, তাদের ঘর-বাড়ি জবরদখল করা এবং তাদের বিভিন্ন পন্থায় কষ্ট দেয়াও ফিতনার আওতাভুক্ত। আল্লাহ বলেন: “যারা নির্যাতিত হওয়ার পর হিজরত করে, অতঃপর জিহাদ করে এবং ধৈর্য ধারণ করে, তোমার প্রতিপালক এসবের পর, তাদের প্রতি অবশ্যই ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। “আল-কুরআন, ১৬:১১০।”
জবরদস্তিমূলক সত্যকে দমন করা এবং সত্যগ্রহণ থেকে মানুষকে বাধা দেয়। আল্লাহ বলেন: “ফির‘আউন ও তার পারিষদবর্গ নির্যাতন করবে এই আশংকায় মূসার স¤প্রদায়ের এক দল ব্যতীত আর কেউ তাঁর প্রতি ঈমান আনে নাই। বস্তুত ফির‘আওন ছিল দেশে পরাক্রমশালী এবং সে অবশ্যই সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত।” “আল-কুরআন, ১০: ৮৩।”
৪। মানুষকে বিভ্রান্ত করা, বিপথে চালিত করা এবং সত্যের বিরুদ্ধে প্রতারণা, ধোঁকা, বিশ্বাসঘাতকতা ও বল প্রয়োগের চেষ্টা করা। আল্লাহ বলেন: “আমি তোমার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করেছি তা হতে তারা পদঙ্খলন ঘটানোর চেষ্টায় প্রায় চূড়ান্ত করেছিল যাতে তুমি আমার সম্বন্ধে তার বিপরীত মিথ্যা উদ্ভাবন কর; তবেই তারা অবশ্যই তোমাকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতো”। “আল-কুরআন, ১৭: ৭৩।”
৫। বিশ্বাসীদের বিপদে ফেলা। আল্লাহ বলেন: “যারা বিশ্বাসী নর-নারীদেরকে বিপদাপন্ন করেছে এবং পরে তাওবা করেনি তাদের জন্য আছে জাহান্নামের শাস্তি, আছে দহন যন্ত্রণা”। “আল-কুরআন, ৮৫: ১০”
৬। অসত্যের প্রতিষ্ঠা, অসৎ ও অবৈধ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য যুদ্ধ, হত্যা ও রক্তপাত করা। আল্লাহ বলেন: “যদি বিভিন্ন দিক হতে তাদের বিরুদ্ধে শত্রæদের প্রবেশ ঘটত, অতঃপর তাদেরকে বিদ্রোহের জন্য প্ররোচিত করা হতো, তবে তারা অবশ্য তাই করত, তারা এতে কালবিলম্ব করত না।” “আল-কুরআন, ৩৩: ১৪।” আল-কুরআনুল কারীমে ‘ফাসাদ’ শব্দটি বিভিন্ন আয়াতে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যে সব আয়াতে ‘ফাসাদ’ শব্দকে সন্ত্রাসের কাছাকাছি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে তার কয়েকটি উদাহরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো।
১। অন্যায় শাসন ও হত্যাকান্ড, দুর্বলদের প্রতি অবিচার ও সম্পদ লুটপাট করা। আল-কুরআনে আল্লাহ ফির‘আউনকে ‘ফাসাদ’ সৃষ্টিকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন, কারণ সে তার প্রজাদের মাঝে শ্রেণী ও বর্ণগত পার্থক্য সৃষ্টি করতো এবং স্বৈরাচারী শাসন চালাতো, দুর্বলদের ও বিরোধীদের অন্যায়ভাবে হত্যা করতো এবং তাদের সম্পদ লুট করতো।
আল্লাহ বলেন: “ফিরআউন দেশে পরাক্রমশালী হয়েছিল এবং সেখানের অধিবাসীদেরকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করে তাদের একটি শ্রেণীকে সে হীনবল করেছিল; তাদের পুত্রদেরকে সে হত্যা করত এবং নারীদেরকে জীবিত থাকতে দিত। সে তো ছিল বিপর্যয় সৃষ্টিকারী।” “আল-কুরআন, ২৮:৪”
২। ন্যায়ানুগ পন্থার বিপরীতে বিকৃত পথে জীবন চালানো। প্রাচীনকালের আদ, সামুদ, লুত, মাদায়েনবাসীসহ বিভিন্ন জাতিকে আল-কুরআনে আল্লাহ ফাসাদকারী হিসেবে গণ্য করেছেন। কারণ তারা সত্য ও ন্যায়নিষ্ঠভাবে জীবন-যাপনের পরিবর্তে বিকৃত পথে জীবনকে চালিত করেছিল।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Azir Uddin Ahmed ৭ এপ্রিল, ২০১৯, ১১:৫১ পিএম says : 0
আস্ সালামু'আলাইকুম,পবিত্র কুরআন এ ফেতনা / ফ্যাসাদ ও সন্ত্রাস বিষয়ে জানতে পেরে খুবই উপকৃত হলাম, আমিন।
Total Reply(0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন