মাওলানা মুহাম্মদ রেজাউল করিম
\ এক \
শিক্ষা মানুষকে সত্য উদ্ঘাটন, অনুধাবন ও উপলব্ধিতে সহায়তা করে। অন্যদিকে স্রষ্টা প্রদত্ত ঐশী জ্ঞান ব্যতীত পৃথিবী সৃষ্টির রহস্য ও স্রষ্টার পরিচিতি অবগত হওয়া কঠিন বিষয়। তাই পবিত্র কোরআনের প্রথম বাণী (পড়–ন)। অর্থাৎ পড়লেই সৃষ্টিকর্তার স্বরূপ, সৃষ্টি রহস্য এবং নিজের দায়িত্ব ও কর্তব্য অবগত হওয়া যাবে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি।’ (মিশকাত শরীফ)
পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘দয়াময় (আল্লাহ) কোরআন শিক্ষা দিলেন। (সূরা আর রহমান, আয়াত-১-২)।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর মানুষ শিক্ষা-দীক্ষা, গবেষণার ক্ষেত্রে উন্নতির চরম শিখরে উপনীত। কিন্তু আধুনিক বস্তুবাদী শিক্ষা ও গবেষণায় ধর্মের গুরুত্ব না থাকায় মানুষের মাঝে অনৈতিকতা, হিং¯্রতা, পরশ্রীকাতরতা, নির্লজ্জতা, অসততা, নাস্তিকতা ও পাশবিকতাসহ যাবতীয় মন্দ স্বভাবের বিস্তার ঘটেছে। শুধু তাই নয়; আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার করে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রসমূহ অহরহ মানবতার জীবন হানি করে চলছে। বিশ্বের শান্তি প্রত্যাশী মানুষের জন্য নৈতিকতায় উদ্ভাসিত, সত্য বা ন্যায়-পরায়নতায় ভাস্বর, আধুনকিতার উচ্চমার্গে উপনীত অভ্রান্ত ও অবিকৃত ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণা অত্যন্ত প্রয়োজন। গবেষণা ইসলামী জীবন দর্শনের অন্যতম চালিকাশক্তি। অন্যদিকে নৈতিকতার মূল উপজীব্য ও প্রাণরস ইসলামী শিক্ষা ও গবেষণার মাঝে নিহিত। মহানবী হযরত (সা.) এরশাদ করেছেন, “রাতে কিছু সময় জ্ঞানচর্চা করা রাতভর নফল ইবাদত করার চেয়ে উত্তম’’। (মিশকাত শরীফ)।
বিজ্ঞানীরা যতদিন পরম স্রষ্টার অবতারিত বিধানের নিকট চ‚ড়ান্তরূপে আত্মসমর্পণ করবে না ততোদিন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রকৃত সুফল হতে মানবজাতি বঞ্চিত হবে। মানব সভ্যতাকে শিক্ষা-দীক্ষা ও গবেষণার মাধ্যমে জাগিয়ে তোলার জন্য মুসলিম বিশ্বকে সকল জড়তা, হীনতা-দীনতা ও অকর্মন্যতাকে পদদলিত করে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক ড. আল্লামা ইকবাল বলেন;
খুদীকো কর বুলান্দ ইতনা কে হার
তাকদীর সে পহেলে,
খোদা বন্দে সে খোদ পুঁহছে
বাতা তেরী রেযা কেয়া হ্যায়।’
অর্থাৎ ‘তুমি আপন আত্মা ও ব্যক্তিত্বকে এমনভাবে সুদৃঢ় করে তোলো, যেন আল্লাহ তাকদীর সৃষ্টির পূর্বেই নিজে তোমাকে জিজ্ঞেস করেন, বলো বান্দা, তাকদীর কি রকম হলে তুমি খুশী হও’।
নৈতিকতা : আত্মা ও দেহ দুয়ের সমন্বয়ে পূর্ণাঙ্গ মানুষ। দেহের উন্নয়নের পাশাপাশি আত্মার উন্নতি ঘটলে মানুষের সত্যিকার পূর্ণতা আসে। আর ঐ উন্নয়নের প্রধান অবলম্বন হলো আল্লাহর মনোনীত ধর্ম ‘ইসলাম’র যথাযথ অনুসরণে জীবন গঠন। ধর্ম যা মানুষ ধারণ করে থাকে, তার প্রকৃত ও বাস্তব অনুসরণ, অনুকরণ মানুষের মাঝে খোদাভীরুতা, নৈতিকতা, সততা ও ন্যায় পরায়নতারোধ জাগ্রত করে। আল কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সে-ই অত্যধিক সম্মানিত যে, আল্লাহকে বেশি ভয় করে।’ মহানবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘নৈতিক চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্যই আমি প্রেরিত হয়েছি’ (মিশকাত শরীফ)।
অন্যত্র নবীজি এরশাদ করেন, ‘কিয়ামত দিবসে মুমিনের আমল পরিমাপের পাল্লায় সর্বাধিক ভারী বস্তু যা হবে তা হলো তার উত্তম আখলাক’ (মিশকাত শরীফ)।
শিক্ষার সংজ্ঞা : শিক্ষা বা Education শব্দটি ল্যাটিন শব্দ Educare (লালন করা)এবং Educere (উৎপন্ন করা) শব্দ হতে উৎকলিত। শাব্দিকভাবে এর অর্থ দাঁড়ায় Pack the information in and draw telents out অর্থাৎ অবগতি ও জ্ঞান প্রদান এবং জ্ঞেয় বিষয়ে সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ। বিভিন্ন মনীষী শিক্ষার সংজ্ঞায় নিম্নরূপ অভিমত ব্যক্ত করেছেন :
১। দার্শনিক ড. আল্লামা ইকবাল বলেন, “খুদী বা আত্মার উন্নয়ন ঘটানোর প্রক্রিয়াই হলো শিক্ষা’’।
২। ড. জন পার্ক বলেন, ‘শিক্ষা হচ্ছে নিদর্শন ও অধ্যয়নের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন বা প্রদানের কৌশল তথা প্রক্রিয়া’।
৩। জন মিল্টন বলেন, ‘আমি ঐ শিক্ষাকে পূর্ণাঙ্গ ও উদার শিক্ষা বলি, যা একজন মানুষকে তৈরি করে, ব্যক্তিগত বা সরকারি দায়িত্ব ন্যায় সংগতভাবে, দক্ষতাসহকারে এবং উদারভাবে প্রতিপালন করতে’।
৪। বিংশ শতাব্দীতে শিক্ষার সংজ্ঞায় বলা হচ্ছে, ‘পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে সার্থকভাবে জীবন পরিচালনা করাই হচ্ছে শিক্ষা’।
ইসলামী শিক্ষা : ‘ইসলাম’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ; শান্তি, মুক্তি, নিরাপত্তা, আত্মসমর্পণ, সন্ধি ও আনুগত্য। পরিভাষায় ইসলামের অর্থ; আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ও আত্মসমর্পণ এবং প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) কর্তৃক আল্লাহর নিকট হতে আনীত জীবন বিধান দৃঢরূপে গ্রহণ ও ধারণ করা। কালজয়ী জীবন বিধান ‘ইসলাম’কে বুঝার জন্য প্রয়োজন ইসলামী শিক্ষার। তাই ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব অত্যধিক। এরশাদ হচ্ছে, ‘আর জ্ঞানবান ব্যতীত কেউই তা (আল্লাহর উপমা) হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। (সূরা আনকাবুত, আয়াত- ৪৩)।
‘হে নবী আপনি বলুন, যারা অবগত এবং যারা অবগত নয়; তারা কি সমতুল্য? জ্ঞানবান ব্যতীত কেউই উপদেশ গ্রহণ করে না।’ (সূরা জুমার, আয়াত-০৯)।
শিক্ষা শব্দটিকে আমরা দু অর্থে ব্যবহার করতে পারি। সাধারণ অর্থে শিক্ষা হচ্ছে ঐসব বিশেষ প্রভাবÑ যা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মাদরাসা এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা উদ্ভাবন ও সংগঠিত করেন; যা শিক্ষার্থীর সামগ্রিক জীবনকে প্রভাবিত করে। ব্যাপক অর্থে শিক্ষা বলতে বুঝায়, শারীরিক, জৈবিক, নৈতিক এবং সামাজিক প্রভাবসমূহ, যেগুলো দ্বারা ব্যক্তি এবং জাতির জীবনধারা নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
ইসলাম সম্পর্কে প্রয়োজনীয় জ্ঞানার্জন, কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি ও মূল্যবোধে উজ্জীবিত হওয়া হলো ইসলামী শিক্ষা অর্থাৎ যে শিক্ষার মাধ্যমে নিজেকে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে চিনতে পারা যায় এবং জন্ম হতে মৃত্যু পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সব বিষয়ের দিক নির্দেশনা রয়েছে- তাই ইসলামী শিক্ষা। ইসলামী শিক্ষা মানুষকে অন্ধকার হতে আলোর দিকে, মিথ্যা হতে সত্যের দিকে, অবাস্তব থেকে বাস্তবতার দিকে পরিচালিত করে। এ দৃষ্টিকোণ হতে নৈতিকতায় উদ্ভাসিত ইসলামী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। এ শিক্ষা সৃষ্টিকুলের জন্য সার্বিক কল্যাণকর। পক্ষান্তরে অন্যান্য শিক্ষা সার্বিক কল্যাণকর নয়; বরং পূর্ণাঙ্গও নয়। এরশাদ হচ্ছে আর যাদের ইলম (কোরআন-সুন্নাহর) প্রদান করা হয়েছে, তারাই মর্যাদাবান। (সূরা মুজাদিলাহ, আয়াত-১১)।
আধুনিক বস্তুবাদী শিক্ষা : প্রাচীন গ্রীসেই আধুনিক বস্তুবাদী শিক্ষার সূচনা। আর ষোড়শ শতকে রেনেসাঁ আন্দোলনের পর বস্তবাদী শিক্ষার জয়জয়কার। শুধু পার্থিব জগতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনই বস্তবাদী শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। নীতি-নৈতিকতা, আত্ম-সংযম, খোদাভীরুতা, চারিত্রিক উৎকর্ষসহ সকল সদগুণরাজিকে পদদলিত করে পরকাল বিমুখ একদল মানুষ সৃষ্টির জন্য এ শিক্ষার পিছনে অঢেল অর্থ ব্যয়। ইসলামী শিক্ষায় ইহকাল ও পরকাল একসাথে গাঁথা। মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘বিদ্যার্জনের জন্য (প্রয়োজনে) চীন দেশ সফর কর। বুঝা গেল ইসলামে আধুনিক শিক্ষার গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু তা নৈতিকতার বিচারে উত্তীর্ণ হতে হবে।
গবেষণা : ‘গবেষণা’ যা ইংরেজি প্রতিশব্দ জবংবধৎপয-এর আভিধানিক অর্থ হলো Careful investigation or enquiry, through search for new facts in any branch of knowledge, অর্থাৎ গবেষণা হলো সত্য জ্ঞানের অনুসন্ধান, কোন নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহের জন্য বৈজ্ঞানিক ও সুসংবদ্ধ অনুসরণকে গবেষণা বলা যেতে পারে। পন্ডিতগণ গবেষণার বিভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছেন; যেমন
(ক) রেডম্যান ওমরী বলেন, ‘নূতন জ্ঞান আহরণের সুসংবদ্ধ প্রচেষ্টাই গবেষণা।
(খ) গ্রীন এর মতে, জ্ঞানানুসন্ধানের আদর্শায়িত বা মানসম্মত পদ্ধতির প্রয়োগই গবেষণা।
(গ) জন ডবিøউ বেস্ট বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির প্রয়োগ দ্বারা বিশ্লেষণের আরো আনুষ্ঠানিক সুসংবদ্ধ ও ব্যাপক প্রক্রিয়াকে গবেষণা বলা যেতে পারে। এ ছাড়া রাস্ক, রুমেল, ক্রফোর্ড প্রমুখ গবেষণা বিষয়ে মূল্যবান অভিমত দিয়েছেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন