স্টাফ রিপোর্টার : বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল কলেজ) যখন বাংলাভাষার দাবিতে রক্তাক্ত রাজপথ, ঠিক সেই সময়েই পুরনো ঢাকায় দেয়ালে উর্দু ভাষায় সেøাগান লিখেছিলেন- ‘হামারী জবান, বাংলা জবান (আমার ভাষা বাংলা ভাষা)’। এ নিভৃতচারী ভাষা সৈনিকের নাম জয়নুল আবেদীন (ঝনু)। ‘মাস্টার অব ওয়াল রাইটার’ নামে পরিচিত।
৮০ বছর বয়েসি এই মানুষ যিনি পেশাগতভাবে একজন আপাদমস্তক সাংবাদিক, তিনি যকৃতের জটিলতা বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে প্রহর গুনছে এক অজানার ঠিকানায়।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা ভালো নয়, নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। বারডেমের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আজাদ খানও বিকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে দেখে গেছেন।
প্রচারবিমুখ জয়নুল আবেদীনকে সাংবাদিক পেশার লোকজন ‘বিহারী ঝনু’ ভাই বলে চিনে।
ত্রিভুবনের মানুষ হিসেবে পরিচিত ঝনু ভাই একদিকে সাংবাদিক, অন্যদিকে চলচিত্র কাহিনীকার এবং আরেকটি পরিচয় সাহিত্যিক। উর্দু ভাষা মাতৃভাষা হলে ঝনু ভাই সব সময় বাংলা ভাষাকেই তার মায়ের ভাষা মনে করেন।
অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে ভেজা চোখে অতীত স্মৃতি রোমন্থে জয়নুল আবেদীন বলেন, আমি বাংলাদেশকে নিজের মায়ের দেশ মনে করি। জন্ম আমার ভারতের ভারতের এলাহাবাদে হলে আমার বাবা ও মমতাময়ী মা জয়তুন বিবির কবর এদেশেই। সৈয়দপুরে বাবা মায়ের কবর। প্রতিবছর তিনি জিয়ারত করতে যান সেখানে।
একুশ সম্পর্কে তিনি বলেন, বাংলা ভাষার জন্য এরকম রক্ত দেয়ার ঘটনা বিশ্বের আর কখনো ঘটবে না। এজন্যই সারা বিশ্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্রæয়ারিকে বিলম্বে হলেও স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই রকম একটি দেশের মানুষের সঙ্গি আমি, এটাই আমার বড় ভাগ্য।
জয়নুল আবেদীন শৈশব কেটেছে বিহারে যেখানে বাবা মুহাম্মদ মোস্তফা ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে হেড ড্রাফটসম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে ৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তার বাবা রেলওয়ের চাকরি নিয়ে পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে যোগ দেন।
সৈয়দপুরের হাইস্কুলে ঝনু ভাইয়ের মেট্রিকুলেশন পরীক্ষা, পরে ঢাকা কলেজে আইকম ও পরবর্তীতে বি.কম পাস করেন। তখন পুরান ঢাকার ফুলবাড়ীয়ার সিদ্দিকবাজার এলাকায় ঢাকা কলেজের ক্যাম্পাস ছিলো।
৫০‘র দশক থেকে জয়নুল আবেদীন বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। ১৯৩৭ সালে জন্ম জয়নুল আবেদীনের। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি প্রথম।
বাংলাদেশে জয়নুল আবেদীন কোনো রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় স্বজন নেই, তবে আছে অসংখ্য ‘আত্মার আত্মীয়’। তার পরিবারের সদস্যদের দ্ইু ভাই করাচীতে থাকার সুবাদে প্রতিবছর একবার পাকিস্তানে যান তিনি। একমাত্র বোন ৪ বছর আগে মারা যান। পরিবারের সদস্যরা ভিডিও কলে তার সাথে কথা বলেন খোঁজ-খবর নেন বলে জানান তিনি।
জয়নুল আবেদীনের সাংবাদিকতা শুরু ৫৭ সালে উর্দু দৈনিক জং। পরবর্তীতে তিনি মনিংনিউজ, বাংলাদেশ টাইমস, চলচ্চিত্র পত্রিকা চিত্রালী, ওয়াতন, সংবাদ সংস্থা এনা‘য় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন।
বর্তমানে তিনি পাকিস্তানের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক ‘জং’ পত্রিকার বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছেন।
একশ’রও বেশি চলচ্চিত্র কাহিনীর রচয়িতা জয়নুল আবেদীনকে চলচ্চিত্র জগতের লোকজন গুরু হিসেবে সম্বোধন করে। তার লেখা শতাধিক ছবি চিত্রায়িত হয়েছে যার মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে চকোরি, আনাড়ি, পায়েল, ছোট সাহেব, রাজু, দংশন, সংগ্রাম।
চলচ্চিত্র জগতে জয়নুল আবেদীনের বন্ধু হিসেব পরিচালক এহতেশাম, মুস্তাফিজ, রহমান, শিবলী সাদেক প্রমুখের সাথে কাজ করেছেন। এক সময়ে সাড়া জাগানো বাংলা চলচ্চিত্রের নায়িকা ববিতা ও সুচন্দা তার লেখা একাধিক ছবিতে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেছেন। লেখক আখতারুজ্জামান বিখ্যাত উপন্যাস খোয়াবনামা’ উর্দুভাষায় অনুবাদ করেন ঝনু ভাই।
১৯৫০ সাল থেকে জয়নুল আবেদিন ঢাকায় বসবাস করছে। তার ঠিকানা তোপখানা রোডের জাতীয় প্রেসক্লাব। সেখানেই তিনি বসবাস করেন।
৫২‘র ভাষা আন্দোলন, ৬২‘র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯‘র গণঅভ্যুত্থান, ৭০’র নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধসহ গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনে রাজপথের চিত্রগুলো খুব কাছ থেকে দেখেছেন তিনি।
সাংবাদিকতা শুরু ৫০’র দশকে ৫৬ ভাষায় আন্দোলনে সময়ে ঢাকা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস ছিলো ফুলবাড়ীয়াতে। উর্দুতে সেøাগান লিখতেন দেয়ালে অত্যন্ত প্রাণবন্তভাষায় সেজন্য তাকে বলা হতো ‘মাস্টার অব ওয়াল রাইটার’
ভাষা আন্দোলনের সময়ে তার লেখা সেøাগানের ভাষা জানতে চাইলে বিনম্র সুরে বললেন, হামারি জবান বাংলা জবান (আমার ভাষা বাংলা ভাষা)’, ‘জুলুম ফের জুলম হ্যায়, বার্তা হ্যায় তো তাবজাদা (জুলুম সেটাই জুলুম যেটা বাড়তে বাড়তে থমকে যায়)।’ এসব সেøাগানের মধ্য দিয়ে ২১ ফেব্রæয়ারি পুরনো ঢাকায় বিহারি অধ্যুসিত উর্দু ভাষাভাষীদের মধ্যে বাংলা ভাষার অন্তরের কথা তুলে ধরেছেন বলে জানান এই প্রবীন মানুষটি।
তার সাথে আলাপ করে জানা যায়, ২১ ফেব্রæয়ারি পুলিশ যখন ঢাকায় সমাবেশ-মিছিল-মানুষের চলাচলের ওপর ১৪৪ ধারা জারি করে, ঠিক সেসময়টিতে পুলিশের নজরদাবি এড়াতে বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসমান নৌকায় মিটিং হয়েছে, সেখানে অনেক ভাষা সৈনিকের সাথে তিনিও ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন