বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ইসলামী জীবন

সন্ত্রাস দমনে মহানবী সা.-এর আদর্শ

| প্রকাশের সময় : ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আফতাব চৌধুরী

\ এক \
আমাদের প্রিয়নবী (সা.)-এর আগমনের মুহূর্তটি ছিল বিশ্বমানবতার জন্য এক অনাবিল ঈদ-মহামুক্তির মহোৎসব। তিনি এলেন, পৃথিবীর সভ্যতাকে বদলে দিলেন। শান্তি, সমৃদ্ধি ও অনুপম মানবসভ্যতা কায়েম করলেন। ইসলামের চিরন্তনবিধানের আলোকে তিনি আমাদের জন্য রেখে গেলেন এমন এক চিরায়ত আদর্শ, যার সত্যনিষ্ঠ অনুসরণ ও চর্চা সমাধান দিতে পারে আমাদের প্রতিটি সমস্যার।
হাজারো সমস্যার ঘূর্ণিবর্তে নিপতিত এই আধুনিক পৃথিবীর একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা হলো- সামাজিক সন্ত্রাস। সমাজদেহের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় এর প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে আজ। প্রশাসক, সমাজবিজ্ঞানী নির্বিশেষে সমাজের প্রতিজন সদস্য আজ সন্ত্রাসের এই অভিযান থেকে মুক্তির পথ খুঁজছেন ও সমাধান পচ্ছে না। এই প্রেক্ষাপটে আমরা মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আদর্শের আলোকে এই সামাজিক সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ-নির্দেশনা নিতে প্রয়াস পাব। আজকে আমাদেরকে গোড়া থেকে চিন্তা করতে হবে যে, নৈতিক অবক্ষয় ও সন্ত্রাস কীভাবে জন্ম নেয় এবং এর বিস্তার ঘটে। এক কথায় সামাজিক ও মূল্যবোধে যখন ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, তখনই আসে বিপর্যয়। আর তাই সন্তানের সাথে মাতা-পিতার সম্পর্ক, ছাত্রের সাথে শিক্ষকদের সম্পর্ক, ব্যবসায়ীর সাথে তার অংশীদারের সম্পর্ক, বন্ধুর সাথে বন্ধুর সম্পর্ক-তথা সমাজের একজন সদস্যের সাথে আরেকজনের সম্পর্কের টানাপড়েন থেকেই জন্ম নেয় এক ধরনের বিকৃত মানসিকতা, যার চ‚ড়ান্ত রূপ হয়ে ওঠে সর্বসংহারী সন্ত্রাস। এ প্রসঙ্গে মহানবীর একটি হাদিস খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছেন : নিজের ক্ষতি করতে পারবে না, অপরের ক্ষতিও না। আরেক বাণীতে তিনি বলেন : অপরের জন্য তাই পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য কর।
মহানবীর জীবনে এ হাদিসের বাস্তবায়ন কীভাবে ঘটছে তা দেখতে পাই আমরা একটি ঘটনায়। তিনি মসজিদে নববীতে বসে আছেন। এমন সময় এক যুবক এসে বলল : ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমি ইসলামের সব কিছুই মানতে প্রস্তুত আছি, তবে ব্যভিচার ছাড়তে পারব না।’ উপস্থিত সাহাবীগণ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কিন্তু মহানবী (সা.) তাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করার জন্য খুবই দরদভরা অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন : শোন, তুমি যার সাথে যিনা-ব্যভিচার করবে সে নিশ্চয়ই কারো বোন, কারো না কারোর মা, খালা, ফুফু হবে তাই না? সে উত্তরে বললো, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে এবার বল, তুমি কি রাজি যে তোমার বোনের সাথে কেউ এই কাজটি করুক? সে বলল, অবশ্যই আমি তা সহ্য করব না। এভাবে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) তাকে তার কয়েক ধরনের মহিলা আত্মীয়ের কথা বললেন। সে প্রতিবারই বললো- তা আমি অবশ্যই সহ্য করব না। এক পর্যায়ে সে বলে উঠল, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! এখন আমার মন থেকে এই জঘন্য অপরাধের প্রবণতা দূর হয়ে গেছে।’
এখানে আমরা দেখলাম যে, একটি অপরাধ-মনস্ক ব্যক্তিকে তিনি মানসিকভাবে পরিশুদ্ধ করার জন্য তাকে অপরাধের শিকারের পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে নিজেকে ভাবতে দিলেন। নিজের জন্য যা গ্রহণযোগ্য নয় অপরের উপর তা চাপাতে গেলে এক সময় নিজেও এর শিকার হতে হবে। আমরা যদি আমাদের সমাজের পথভ্রষ্ট লোকদের মহানবীর এই প্রক্রিয়ায় মানসিক পরিচর্যা করতে পারি তাহলে আশা করা যায় তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আবার স্বাভাবিক জীবনধারায় ফিরে আসবে। এখানে আমাদের আরেকটি বিষয় চিন্তা করতে হবে যে, একটি যুবক তার যৌবন উদ্যাম শক্তিকে কেন নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারল না। সে তো নিষ্পাপ অবস্থায় জন্ম নিয়েছে। মাতা-পিতার নিয়ন্ত্রণ পারিবারিক পরিমÐলে। সে বেড়ে উঠেছে অনেক বছর। মাতাপিতার কি কিছু দায় দায়িত্ব নেই?
মহানবী (সা.) বলেন, “প্রতিটি নবজাতক স্বভাবধর্মেই জন্ম লাভ করে। তারপর তার বাপ-মা তাকে ইয়াহুদী বানায়, নাসারা বানায় বা অগ্নিপূজক বানায়।” এজন্যই দেখা যায়, যুব-মানসে যে সন্ত্রাসী মনোভাবের জন্ম নেয়, তা পরিবারে উপযুক্ত অভিভাবকত্ব, যতœ ও শিক্ষার অভাবেই হয়ে থাকে। মা-বাবার পরস্পরের ভুল বোঝাবুঝির প্রভাব পড়ে কোমলমতি সন্তানের মনসিকতায়। আবার পারিবারিক বন্ধনে ভারসাম্যহীনতা থেকে এক ধরনের অস্বাভাবিকতা জন্ম লাভ করে। পারিবারিক ও সামাজিক অধিকারে বঞ্চনা পেতেও এক সময় যুব-মানস বিগড়ে যায়। যেখানে ক্ষত সেখানেই মলম লাগাতে হয়। তবে কথা আছে- চৎবাবহঃরড়হ রং নবঃঃবৎ ঃযবহ পঁৎব.
এজন্যই মহানবী (সা.) বলেছেন : “তোমাদের সন্তানদের সাথে সম্মানবোধের মাধ্যমে আচরণ কর এবং তাদেরকে আদব মূল্যবোধ শেখাও।” মহানবী (সা.) শিশুদের সাথে এমনভাবে আচরণ করতেন যাতে তদের মনে কোন বঞ্চনা বা হতাশার সৃষ্টি না হয়। তিনি একবার প্রিয় দৌহিত্র হাসান ও হোসেন (রা.)-কে চুমা দিলেন। পাশেই ছিল পালিত পুত্র যায়দ-এর শিশু পুত্র উসামা, তাকেও চুমা দিয়ে সমতা বিধান করলেন। এ সবই আমাদের শিক্ষণীয়। সন্ত্রাসের অঙ্কুর যেন হজাতে না পারে, সে জন্য মাতা-পিতাকে সদা সতর্ক থাকতে হয়। উঠতি বয়সে সমাজের নানান ধরনের চরিত্রের মানুষের সাথে পরিচয় ঘটে। তখন অভিভাবকদের উচিত তাদেরকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া। কোন সমাজ গঠনমূলক কাজে উৎসাহিত করা। কারণ যৌবনের স্বাভাবিক আবেদন অনুযায়ী যুবকরা কিছু করতে চায়। ভাল কাজে নিয়োজিত না হতে পারলে খারাপের দিকে চলে যায়।
মহানবী (সা.) তাঁর যৌবনের প্রারম্ভে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামক একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলেন। আমাদের যুব সমাজকে যদি আমরা এ ধরনের সামাজিক সংগঠনের সাথে যুক্ত করতে পারি, তাহলে তারা অন্তত নিজেরা তো ভাল থাকবেই, আত্ম-কর্মসংস্থানমূলক সংগঠনে জড়িত থাকলে বেকারত্ব দূর হওয়ার সাথে সাথে তারা নিজের ও দেশের ভাগ্য গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে পারবে। যুব সমাজ বিপথগামী হয় প্রধান : সঙ্গদোষে। মহানবী (সা.) বলেন : “মানুষ তার সহচরের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়। কাজেই তোমাদের কেউ বন্ধুত্ব করার সময় ভালো করে দেখেশুনে বন্ধুত্ব করবে।” (মুসনাদে আহমদ)---
অপর হাদিসে তিনি বলেন, ‘সৎসঙ্গী ও অসৎসঙ্গীর দৃষ্টান্ত হচ্ছে সুগন্ধি বহনকারী ও লোহার হাপর চালনাকারীর মতো। সুগন্ধির বাহক হয় তোমাকে কিছু দেবে অথবা তুমি তার কাছ থেকে কিছু ক্রয় করবে অথবা অন্তত তার সুঘ্রাণ তো পাবে। পক্ষান্তরে, হাপর চালানেওয়ালা হয় তোমার পোশাক পুড়িয়ে দেবে অথবা কমপক্ষে তুমি দুর্গন্ধ তো পাবে।” (বুখারি মুসলিম)
সমাজে সন্ত্রাসী হিসেবে যারা কুখ্যাত, তাদের এ কাজে হাতেখড়ি হয়েছে কোন বিপথগামী বন্ধুর কাছে। যে যুবক মাদক দ্রব্যে আসক্ত হয়ে মৃত্যুর গুহার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, সে এই সর্বনাশা নেশা করা শিখেছে তার কোন সহযাত্রী বা সহচরের প্রভাবে। এই মাদক দ্রব্য তাদেরকে একই আস্তানায় অদৃশ্য সুতোয় গেঁথে নিয়েছে। এর জন্য অন্যের উপর হয়ে চাঁদা আদায় করতে বড় বেরহমভাবে। আবার দলের কেউ আক্রান্ত হলে তাকে ছাড়িয়ে আনতে পথের কাঁটা সরিয়ে দিচ্ছে। এতে প্রয়োজন খুন, জখম করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। আল্লাহর নবী এ সম্পর্কে সম্যক সচেতন। তিনি বলেন, “তোমাদের ভালবাসা যেন উন্মাদনার রূপ ধারণ না করে এবং তোমার শত্রæতা যেন উৎপীড়নের পর্যায়ে না পৌঁছে।” (আল আদাবুল মুফরাদ)
আজ আমরা একই সমাজে বাস করেও অতি তুচ্ছ স্বার্থের দ্ব›েদ্ব পড়ে প্রতিপক্ষকে চরমভাবে ধ্বংস করার নির্দয় আচরণ লক্ষ্য করছি। পরস্পরের মধ্যে সংশয় ও সন্দেহ আমাদের সমাজ জীবনকে অস্থির করে তুলছে। অনেক সময় এ-ও দেখা যায় যে, একটি উড়ো কথায় রেশ ধরে ঘটে যায় অনেক অঘটন। অথচ দেখুন, আমাদের প্রিয়নবী (সা.) কি বলেছেন, “কোন ব্যক্তি মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, সে যা শুনে তাই বলে বেড়ায়।” তিনি আরো বলেন, “কু-ধারণা পোষণ করবে না, আর অনুমান নির্ভর কু-ধারণা সবচে বড় মিথ্যা কথা।”

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন