রফিকুল ইসলাম সেলিম : ‘বছরের শুরুতে বাড়িভাড়া বেড়েছে। স্কুলে বেড়েছে বেতন ও ভর্তি ফি। চট্টগ্রাম ওয়াসা পানির দাম বাড়িয়েছে ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে সরকার গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিলো। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগাম ঘোষণাও দেয়া হলো। কিন্তু আমাদের বেতন তো বাড়েনি, অতিরিক্ত ব্যয় করব কোথা থেকে।’
চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদের বাসিন্দা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী মহিউদ্দিন ক্ষোভের সাথেই এসব কথা বললেন। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সরকারি ঘোষণায় তার মতো সীমিত আয়ের লোকজনের মাঝে চরম ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। তাদের আশঙ্কা গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ফলে বাজারে মূল্যবৃদ্ধির হিড়িক পড়বে। যানবাহনের ভাড়া বাড়বে।
এমনিতেই জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধ্বমুখী। ভরা মৌসুমেও চালের দাম নিয়ন্ত্রণহীন। প্রতিদিনই চালের দাম বাড়ছে। খাদ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রোববার বাজারে মাঝারি মানের চালের দাম ছিল ৪০ থেকে ৪১ টাকা। নিম্নমানের মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৩৪ থেকে ৩৫ টাকা। আর সরু চালের দাম ছিল ৪৯ থেকে ৫০ টাকা। ভোজ্যতেল, মাছ, গোশত থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম আকাশছোঁয়া।
নগরীর বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারীদের (ভাড়াটিয়া) সাথে কথা বলে জানা যায়, বছরের শুরুতেই নগরীর প্রায় প্রতিটি বাড়ির মালিক ঘরভাড়া বাড়িয়েছেন। কোনো নীতিমালা না থাকায় ইচ্ছেমতো বাড়িভাড়া বাড়ানো হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন গৃহকর আদায়ে তোড়জোড় শুরু করেছে। আর একে পুঁজি করে বাড়িওয়ালারা বাসাভাড়া বাড়িয়ে দিচ্ছেন। জানুয়ারির প্রথম দিন থেকে চট্টগ্রাম ওয়াসা গ্রাহক পর্যায়ে পানির দাম ১৬ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছে। এটিকে পুঁজি করেও ঘরভাড়া বাড়ানো হচ্ছে।
বছরের শুরুতে স্কুলে শিক্ষার্থীদের বেতন ও ভর্তি ফি বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ক্ষুব্ধ অভিভাবকদের অভিযোগের ভিত্তিতে জেলা প্রশাসনের ৫টি মনিটরিং টিম মহানগরীর স্কুলগুলোতে অভিযান চালিয়ে এর সত্যতাও পায়। ৬৮ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেয়া অতিরিক্ত ফি ফেরত দিতেও বলা হয়। কিন্তু কোনো স্কুলই অতিরিক্ত ফি ফেরত দেয়া তো দূরের কথা অতিরিক্ত ফি আদায় বন্ধেরও ঘোষণা দেয়নি।
বাড়িভাড়া, স্কুল-কলেজে অতিরিক্ত ফি আদায়সহ বিভিন্ন কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে। আবার এর মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেয়ায় মূল্যবৃদ্ধির আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষ। গত বৃহস্পতিবার সরকার দুই ধাপে গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। প্রথম ধাপ কার্যকর হবে আগামী এক মার্চ থেকে। ঘোষণা অনুযায়ী আবাসিক খাতে দুই চুলার জন্য ৮শ’ টাকা গুনতে হবে গ্রাহকদের। আর এক চুলার জন্য দিতে হবে ৭৫০ টাকা। সিএনজির দাম মার্চ থেকে প্রতি ঘনমিটার ৩৮ টাকা ও জুনে ৪০ টাকা করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
এর আগে আরো এক দফা গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। গ্যাসের দাম বাড়ানোর পর গ্যাসচালিত পরিবহনে ভাড়া বেড়ে যায়। বিশেষ করে মধ্যবিত্তের বাহন হিসেবে পরিচিত সিএনজি অটোরিকশা গলাকাটা হারে ভাড়া আদায় শুরু করে। বর্ধিত মূল্য কার্যকর হলে ভাড়া নৈরাজ্য আরো বাড়বে এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। চট্টগ্রামে গ্যাস সঙ্কট দীর্ঘদিনের। সাম্প্রতিককালে আবাসিক খাতে গ্যাস সঙ্কট তীব্র হয়ে উঠেছে। নগরীর অনেক এলাকায় দিনের বেশিরভাগ সময় গ্যাস থাকছে না। রান্নাবান্নার কাজ সারতে এলপি গ্যাস, কেরোসিনের চুলাসহ বিকল্প উৎস ব্যবহার করছে গ্রাহকরা। লাইনে পর্যাপ্ত গ্যাস না থাকার পরও গ্রাহকদের অতিরিক্ত দাম পরিশোধ করতে হচ্ছে।
শিল্প ও বাণিজ্যিক খাতেও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। দাম বাড়ানো হয়েছে চা বাগানের গ্যাসেরও। এতে করে শিল্প কারখানায় উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, বাড়বে জিনিসপত্রের দামও। তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ভোক্তা পর্যায়ে। সরকার গ্যাসের দাম বাড়ালেও পরিবহন ভাড়া এখনো সমন্বয় করেনি। আর এর মধ্যেই সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ পরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায় শুরু হয়ে গেছে।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর পরদিন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আগাম ঘোষণা এসেছে সরকারি তরফে। এর আগে আরো কয়েক দফা বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। গ্রাহকরা বলছেন, ভুয়া বিল দিয়ে গ্রাহকদের পকেট কাটছে পিডিবি। নগরীর বেশিরভাগ এলাকায় গ্রাহকদের অভিযোগ, পিডিবির কর্মীরা মিটার না দেখেই তাদের ইচ্ছেমতো বিল তৈরি করছে। সীমিত কিছু এলাকায় প্রি-পেইড মিটার চালু হলেও বেশিরভাগ এলাকায় পিডিবির দেয়া অতিরিক্ত বিল পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছে গ্রাহকেরা। প্রি-পেইড মিটার চালুর পর বিদ্যুতের অতিরিক্ত বিলের বিষয়টি প্রমাণ পাচ্ছেন গ্রাহকরা।
আগ্রাবাদ পাঠানটুলি এলাকায় এক মাস আগে প্রি-পেইড মিটার বসে। ওই এলাকার গ্রাহক আবদুল হালিম জানান, ডিসেম্বর মাসে পিডিবি তার বাসার বিদ্যুৎ বিল দিয়েছে ১১৮০ টাকা। প্রি-পেইড মিটার বসানোর পর ওই বাসাতেই জানুয়ারি মাসে বিদ্যুৎ খাতে খরচ হয়েছে মাত্র ৫০০ টাকা। এতে বোঝা যায়, প্রায় দ্বিগুণের বেশি বিল করছে পিডিবির কর্মীরা। এ অবস্থায় বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি হলে গ্রাহক হয়রানি বাড়বে বলে মনে করছেন গ্রাহকেরা।
চট্টগ্রাম মহানগরীতে বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ৬০ লাখ। এ বিশাল জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত। গ্যাস-বিদ্যুতের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়বে এ শ্রেণী। শিক্ষা-স্বাস্থ্য সব খাতেই ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী মানুষের আয় বাড়ছে না। সংসার চালাতে গিয়ে অনেককে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সঞ্চয় বলে কিছুই থাকছে না।
ক্যাব চট্টগ্রামের নেতাদের মতে, হঠাৎ করে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণায় সাধারণ মানুষের ওপর চরম জুলুমের শামিল। এতে করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির হিড়িক পড়বে। আর তাতে সাধারণ লোকজন সঙ্কটের মুখোমুখি হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন