মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

‘ইসলাম’ সন্ত্রাস নয়, শান্তি ও নিরাপত্তার ধর্ম

| প্রকাশের সময় : ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

\ চার \
১০। অন্যায়ভাবে মু‘মিনকে হত্যাকারীর কোন ইবাদত কবুল করা হবে না। রাসূল সা. বলেন: “যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোন মু‘মিন ব্যক্তিকে হত্যা করবে আল্লাহ তার কোন নফল ও ফরয ইবাদত কবুল করবেন না।” “ইমাম আবু দাউদ, আস- সুনান, অধ্যায়: আলফিতান, অনুচ্ছেদ: ফী ত’যীমি কতলিল মু‘মিন, প্রাগুক্ত, তা.বি., খ. ৪, পৃ. ১৬৭”
১১। নিষিদ্ধ পন্থায় অপরের রক্তপাত ঘটানো মু‘মিনকে উচ্চ মর্যাদা থেকে স্খলিত করে। রাসূল সা. বলেন: “মু‘মিন ব্যক্তি উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন জীবন-যাপন করতে থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত হারাম পন্থায় অন্যের রক্তপাত না ঘটাবে।” “ইমাম আবু দাউদ, আস-সুনান, অধ্যায়: আলফিতান, অনুচ্ছেদ: ফী তা’মীমি কাতলিল মু‘মিন, প্রাগুক্ত, খ. ৪, পৃ. ১৬৭”
১২। কোন মুসলিমকে হত্যা করা দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার থেকেও গুরুতর। রাসূল সা. বলেন: “আল্লাহর নিকট সারা দুনিয়া ধ্বংস হওয়ার চেয়েও গুরুতর হচ্ছে কোন মুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করা।” “ইমাম তিরমিযী, আস-সুনান, অধ্যায়: আদ-দিয়াত আন রাসূল সা. অনুচ্ছেদ: মা জাআ ফী তাশদীদি কতলিল মু‘মিননি, বৈরুত: দারুল ফিকর, ১৯৮৩, খ. ২, পৃ. ৪২৬”
১৩। নিরাপত্তা প্রদাকৃত যে কোন ধর্মাবলম্বীকে হত্যাকারীর সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। রাসূল সা. বলেছেন- “যে ব্যক্তি নিরাপত্তা প্রদানকৃত ব্যক্তিকে হত্যা করে আমার সাথে ঐ হত্যাকারীর কোন সম্পর্ক থাকবে না, যদিও নিহত ব্যক্তি কাফির হয়।” “ইমাম আত-তাবারানী, আল-মু‘জামুস সগীর, অধ্যায়: হারফুল হামযাহ, অনুচ্ছেদ: আল-আলফ মিন ইসামিহি আহমাদ, বৈরুত: আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, ১৯৮৫, খ. ১, পৃ.১৪১৫”
সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলাম ঃ আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য একমাত্র জীবনব্যবস্থা হলো ইসলাম। আল্লাহ বলেন: “নিঃসন্দেহে ইসলামই আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন।” আল-কুরআন, ৩: ১৯। অন্য স্থানে আল্লাহ বলেন, “কেউ ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন গ্রহণ করতে চাইলে তা কখনও কবুল করা হবে না এবং সে হবে আখিরাতে ক্ষতিগ্রস্থদের অন্তর্ভুক্ত।” আল-কুরআন, ৩ : ৮৫। ইসলাম শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থই শান্তি। এ জীবনব্যবস্থার এরূপ নামকরণই প্রমাণ করে যে, মানুষের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার চিন্তা ইসলামের সামগ্রিক প্রকৃতি ও মৌল দৃষ্টিকোণ হতে উৎসারিত। তাই ইসলামের প্রতিটি আদেশ-নিষেধ, বিধি-বিধান থেকে শান্তির ফল্গুধারা নিঃসৃত হয়। শান্তিময় পরিবেশের স্থায়িত্ব বজায় রাখার শান্তি বিঘিœত করে এমন সকল কর্মকাÐ প্রতিরোধ অপরিহার্য। তাই যৌক্তিকভাবেই ইসলাম শান্তি প্রতিষ্ঠা ও এর স্থায়িত্ব বজায় রাখার স্বার্থে সকল ধরনের সন্ত্রাসকে প্রতিরোধে ও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে নির্র্মূল করার নির্দেশনা দান করে। ইসলাম বলতে প্রথমত ও প্রধানত কুরআন ও রাসূল সা.-এর সুন্নাহ বা হাদীসকেই বুঝায়। রাসূল সা. বলেছেন: “আমি তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস রেখে গেলাম, এই দু‘টি জিনিসকে যতক্ষণ আঁকড়ে ধরে রাখবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না, সে দু‘টি জিনিস হলো আল্লাহর কিতাব তথা কুরআনও তাঁর রাসূল সা. এর সুন্নাহ তথা হাদীস।” “ইমাম মালিক, আল-মুয়াত্তা, অধ্যায়: আল-ক্বাদর, অনুচ্ছেদ: আন-নাহইউ আনিল কওলি বিল ক্বাদর, মিসর: দারু ইহইয়াইত তুরাছিল আরাবিয়্যি, তা.বি., খ. ২, পৃ. ৮৯৯”
তাই সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলামের নির্দেশনা বলতে সন্ত্রাস প্রতিরোধে কুরআন ও রাসূল সা. এর সুন্নাহতে বর্ণিত নির্দেশনাসমূহ বর্ণনা করা উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য যে, সন্ত্রাস প্রতিরোধক আয়াত, হাদীস ও রাসূল সা.-এর আদর্শ এত বেশি যে, তার সবগুলো এই স্বল্প পরিসরে উল্লেখ করা অসম্ভব। তাই এ ব্যাপারে ঐ তিন উৎসের মৌলিক নির্দেশনাসমূহ নিম্নে পেশ করার প্রয়াস পাচ্ছি। সন্ত্রাস প্রতিরোধে আল-কুরআনের নির্দেশনা ঃ আল-কুরআনে প্রথমত সাধারণতভাবে সন্ত্রাসের কারণ সৃষ্টি হওয়ার ছিদ্রপথ বন্ধ করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।
১। ন্যায়পরায়ণতা ও সদাচরণের নির্দেশ ও অশ্লীলতা, অসৎকার্য ও সীমালঙ্ঘনমূলক কাজ করতে নিষেধ প্রদান করে আল-কুরআনে নির্দেশনা এসেছে যে, “আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ ও আত্মীয়-স্বজনকে দানের নির্দেশ দেন এবং তিনি নিষেধ করেন অশ্লীলতা, অসৎকার্য ও সীমালঙ্ঘন; তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর।” “আল-কুরআন, ১৬: ৯০”
২। সন্ত্রাস মূলত বিভিন্ন ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘনের ফলেই সৃষ্ট। তাই জীবনের সকল ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন, বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করে আল-কুরআনে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। আল্লাহ বলেন: “বল, হে কিতাবীগণ! তোমরা তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে অন্যায়ভাবে বাড়াবাড়ি কর না; এবং যে স¤প্রদায় ইত:পূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে, অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে ও সরল পথ হতে বিচ্যুত হয়েছে, তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না।” “আল-কুরআন, ৫: ৭৭” অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, “যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তোমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর; কিন্তু সীমালঙ্ঘন কর না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালবাসেন না।” “আল-কুরআন, ২: ১৯০” উপরোক্ত প্রথম আয়াতে আহলে কিতাবদের উদ্দেশ্য করে এবং দ্বিতীয় আয়াতে সশস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রের প্রসঙ্গ বর্ণিত হলেও অন্যান্য আয়াত ও হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, সীমালংঘন ও বাড়াবাড়ি মুসলিমদের জন্যও সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ।
৩। পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা নিষিদ্ধ। সন্ত্রাস নিঃসন্দেহে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। তাই সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে বা অন্য কোনভাবে পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আল-কুআনে নির্দেশনা এসেছে। আল্লাহ বলেন: “দুনিয়ায় শান্তি স্থাপনের পর তোমরা তাতে বিপর্যয় ঘটাইও না, তাঁকে ভয় ও আশার সাথে ডাকবে। নিশ্চয় আল্লাহর অনুগ্রহ সৎকর্মপরায়ণদের নিকবর্তী।” “আল-কুরআন, ৭: ৫৬”
এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বিশ্বখ্যাত মুফাসসির হাফিয ইবনে কাছীর র. বলেন, “শান্তি স্থাপনের পর ভূপৃষ্ঠে বিপর্যয় ও যে সকল কর্মকান্ড পৃথিবীকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, তা থেকে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। কেননা যখন কাজ-কারবার শান্তিপূর্ণ পরিবেশে যথাযথভাবে চলতে থাকে, তখন যদি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হয়, তবে তা হবে বান্দার জন্য বেশী ক্ষতিকর। এজন্য আল্লাহ এরূপ করতে নিষেধ করেছেন।” “ইমাম ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, রিয়াদ: দারুত ত্বায়্যিবাহ লিন নাশরি ওয়াত তাওযী’, ১৯৯৯, খ. ৩, পৃ. ৪২৯”
ইমাম কুরতুবী র. বলেন, স্বল্প-বিস্তর যতটুকুই হোক শান্তি স্থাপনের পর আল্লাহ পৃথিবীতে কম বা বেশি যাই হোক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে নিষেধ করেছেন।” “ইমাম কুরতুবী, আল-জামি’ লি-আহকামিল কুরআন, রিয়াদ: দারু ‘আলামিল কুতুব, ২০০৩, খ.৭, পৃ. ২২৬”
অনর্থ বিপর্যয় সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হতে নিষেধ করে আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ যাহা তোমাকে দিয়েছেন তা দ্বারা আখেরাতের আবাস অনুসন্ধান করো এবং দুনিয়া থেকে তোমার অংশ ভুলো না; তুমি অনুগ্রহ করো যেমন আল্লাহ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চেয়ো না, আল্লাহ বিপর্যয় সৃষ্টিকারীকে ভালবাসেন না।” “আল-কুরআন, ২৮: ৭৭”
৪। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের মাধ্যমে নিরাপরাধ মানুষকে হত্যা করা ইসলামে সম্পূর্ণরূপে হারাম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ যার হত্যা নিষিদ্ধ করেছেন যথার্থ কারণ ব্যতিরেকে তাকে হত্যা করো না।” “আল-কুরআন, ৬: ১৫১, ১৭: ৩৩” আদম সন্তানকে সম্মানিত ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন: “আমি তো আদম-সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি; স্থলে ও সমুদ্রে তাদের চলাচলের বাহন দিয়েছি; তাদেরকে উত্তম রিয্ক দান করেছি এবং আমি যাদেরকে সৃষ্টি করেছি তাদের অনেকের উপর তাদেরকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছি।” “আল-কুরআন ১৭:৭০” এত মর্যাদাবান ও অনুগ্রহপুষ্ট শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী সমগ্র মানবজাতির কোন এক সদস্যের প্রাণহাণী ঘটানোকে সমগ্র মানবজাতির প্রাণহানী ঘটনার সাথে তুলনা করে আল্লাহ বলেন: “এই কারণেই বনী ইসরাঈলের প্রতি এই বিধান দিলাম যে, নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করা ব্যতীত কেউ কাউকেও হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল।” “আল-কুরআন, ৫: ৩২”।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন