শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

হয়রানির শিকার প্রকৃত ব্যবসায়ীরা

প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

উমর ফারুক আলহাদী : হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ ঢাকা কাস্টম হাউসকে কেন্দ্র করে চলছে লুটপাট, অনিয়ম আর দুর্নীতি। চলছে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চোরাই পণ্য খালাসের মহোৎসব। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সংস্থাটি এখন দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মোটা অঙ্কের ঘুষ না দিলে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দাবিকৃত টাকা না পেলে ব্যবসায়ীদের পণ্য মাসের পর মাস আটক রাখা হয়। তাদের হাতে এখন ব্যবসায়ীরা জিম্মি। তবে ঘুষের বিনিময়ে কোটি কোটি টাকার চোরাই পণ্য ঠিকই দ্রুত খালাস করে দেয়া হচ্ছে। ফলে সরকার প্রতি বছর কয়েক শ’ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। লুটপাট, দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাপক তথ্য-প্রমাণও পাওয়া গেছে। সরেজমিনে পরিদর্শন করে ও বিভিন্ন ভুক্তভোগীর সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
অভিযোগকারীরা বলছেন, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় চোরাকারবারিদের মহোৎসব চলছে ঢাকা কাস্টম হাউসের কুরিয়ার শুল্কায়ন ইউনিটে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা বৈধ ব্যবসায়ীদের বাধা দিলেও, অবৈধ ব্যবসায়ীদের দিচ্ছে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা। চোরাকারবারিদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করছে সহকারী কমিশনার প্রিভেনটিভ মো. শহিদুজ্জামান সরকার ও তার সহকারী ইয়াকুব জাহিদের (এআরও প্রিভেনটিভ)। এর ফলে কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ কোটি কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।সূত্রে জানা যায়, এয়ারফ্রেইট কুরিয়ার শুল্কায়ন থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার পণ্য আমদানি হচ্ছে এবং একাধিক কুরিয়ার সার্ভিসের নামে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানী হয়ে আসছে। তবে বৈধ পণ্যের আড়ালে আসছে বিভিন্ন প্রকার অবৈধ পণ্য। অবৈধ পণ্যের মধ্যে রয়েছেÑঅস্ত্র, গোলাবারুদ, স্বর্ণ, রূপা, হেরোইনসহ বিভিন্ন প্রকার নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য। এসব চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ করে দুর্ধর্ষ দুটি চোরাচালানি গ্রুপ।
জানা যায়, যে সব চোরাকারবারিরা এদের চাহিদামতো টাকা দিতে অস্বীকার করে তাদের মালামাল আটক করে জয়েন্ট গ্রিলে রেখে দেয়া হয়। পরে দর কষাকষির পর সহকারী কমিশনার প্রিভেনটিভের বিশেষ ক্ষমতায় মালামাল পার করে দেয়া হত। আর এসব টাকা লেনদেন হতো কাস্টম হাউসের প্রিভেনটিভ রুমে। টাকা গ্রহণ করতো সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ইয়াকুত জাহিদ। সহকারী কমিশনার শহীদুজ্জামান সরকার। সহকারী কমিশনার প্রিভেনটিভের কন্টাকে চোরাচালানী পণ্য পাচার হয়। ঐসব বে-আইনী পণ্য পাচারের সময় প্রিভেনটিভ টিম ডেলিভারি গেটে কাগজ-পত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নির্বিঘেœ পণ্য পাচার কজে সহযোগিতা করত। যাতে অন্যরা বুঝতে না পারে। এটাই ছিল প্রিভেনটিভ টিমের বিশেষ কৌশল। এভাবে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার অবৈধ পণ্য প্রিভেনটিভ টিম পাচার করতো বিনা শুল্কে। এসব পণ্য পাচারের একটা মোটা অঙ্কের টাকা যেত কুরিয়ার শুল্কায়নের সহকারী কমিশনারের পকেটে।
বিমানবন্দরের একাধিক সূত্র জানায়, এই আলোচিত-সমালোচিত সহকারী কমিশনার মো. শহিদুজ্জামান সরকারকে কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ গোল্ডেন প্রাইজ হিসাবে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি এয়ারফ্রেইট ইউনিট আমদানী পরীক্ষায় বদলী করেছেন। গত ২২ ফেব্রুয়ারি এয়ারফ্রেইট ইউনিট আমদানী পরীক্ষায় সে যোগদান করেন। শহিদুজ্জামান সরকারের বে-আইনি কর্মকান্ডে কাস্টম হাউসের অনেক পদস্থ কর্মকর্তারা অতিষ্ঠ ও অসন্তোষ। তবুও কর্তৃপক্ষ তাকেই গোল্ডেন প্রাইজ পোস্টিং দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে কাস্টম হাউসের জেসি-১ এর কাছে জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, কাকে কোথায় পদায়ন করা হবে, সেটা কর্তৃপক্ষের ব্যাপার, তবে শহিদুজ্জামান সরকারের ব্যাপারে অনেক কিছু শুনেছি; কিন্তু কোন প্রমাণ হাতে পাইনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত ২৬ নভেম্বর ২০১৫ বৃহস্পতিবার দুপুরে কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষের সহকারী কমিশনার (প্রিভেনটিভ) শহিদুজ্জামান সরকার তার-ই এক সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবু সাইদকে একটি এয়ারওয়ে বিল রেজিস্টার খাতায় লিখতে আদেশ দেন। আদেশ পাওয়ার পর সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবু সাইদ তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে এয়ারওয়ে বিল নম্বরটি লিখেন। এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে সহকারী কমিশনার শহিদুজ্জামান সরকার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা আবু সাইদকে চড়-থাপ্পড় মারেন। ঘটনাটি অন্যান্য সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তোপের মুখে পড়েন শহিদুজ্জামান সরকার। একপর্যায়ে কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আমদানি কার্গোর সব গেট বন্ধ করে কর্মবিরতি শুরু করেন। এ সময় সব ধরনের পণ্য খালাস বন্ধ হয়ে যায়। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে জরুরী বৈঠকে বসেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরে সংশ্লিষ্ট সহকারী কমিশনারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেন।
সূত্র জানায়, কার্গো ভিলেজ রপ্তানী শাখায় স্ক্যানিং মেশিনের মধ্যদিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে গত ১৩ জানুয়ারি বুধবার বিমানের সিকিউরিটি গার্ড ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। সিকিউরিটি গার্ডদের অভিযোগ, কাস্টমসের ৩ সহকারী কমিশনারের নেতৃত্বে ৫ সদস্যের একটি দল বিমানের স্ক্যানিং মেশিন কক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিকিউরিটি গার্ড সবুর আলীকে বেদম মারধর করে। গত ১৩ জানুয়ারি বুধবার সন্ধ্যায় বিমানের কার্গো রফতানি শাখায় এ ঘটনা ঘটে।
অপর একটি সূত্র জানায়, সন্ধ্যায় কাস্টমসের সহকারী কমিশনার শহিদুজ্জামান সরকার একটি প্রাইভেট কার নিয়ে কার্গো রফতানি শাখায় প্রবেশ করতে চান। গাড়িটি কার্গো গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশের সময় বিমান সিকিউরিটি গার্ড সবুর আলী তাকে বাধা দেন এবং শরীর স্ক্যান করে ভেতরে প্রবেশের অনুরোধ জানান। এতে শহীদুজ্জামান ভেতরে না ঢুকে বের হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর তিনি আরো দু’জন সহকারী কমিশনার ও দু’জন সিপাহী নিয়ে কার্গো কমপ্লেক্সে আসেন। এরপর বিমানের সিকিউরিটি গার্ড সবুর আলীকে কলার ধরে স্ক্যানিং মেশিন কক্ষের এক কোনায় নিয়ে চড়-থাপ্পড় দেন। পরে এপিবিএন সদস্যরা তাকে উদ্ধার করেন। এছাড়াও সাধারন ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ভাবে মামলা দিয়ে হয়রানি করে থাকে। এতেও সে ক্ষান্ত হয় না, তাদের লাইসেন্সও বাতিল করার হুমকি দেয়।
সূত্রে জানা গেছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত ২৫ জানুয়ারি অবৈধভাবে পাচারকালে ৩ কার্টনভর্তি ৪৮৪ জোড়া পাঞ্জাবি ও লেডিস জুতা জব্দ করে ঢাকা কাস্টম হাউসের প্রিভেন্টিভ টিম। অবৈধভাবে আনা ওই পণ্যের প্রকৃত মালিক ফ্যাশন কোর ডটকম নামে ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠান। আর গত ২২ জানুয়ারি মালগুলো খালাসের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত আবেদন করে রাজধানীর মতিঝিলের ঝর্ণা এজেন্সি নামে একটি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়ে ঘটনার ১৬ দিন পর গত ১০ ফেব্রুয়ারী মধ্যরাতে বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা দায়ের করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। আসামি করা হয় মোঃ নজরুল ইসলাম, লিজাউর রহমান বিপুল, নয়ন, মানিক, মোঃ ইয়াকুব চৌধুরী, কামরুজ্জামান লিটনসহ অচেনা আরও ১০-১৫ জনকে। কিন্ত ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বাদ দিয়ে ওই মামলায় সাধারণ ব্যবসায়ীদের আসামি করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। এমনকি ভারতের দার্জিলিংয়ের একটি কলেজে অধ্যয়নরত এক শিক্ষার্থীকেও আসামি করা হয়েছে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে।
গত বুধবার বিমানবন্দর থানায় কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মোঃ ইয়াকুত জাহিদের দায়ের করা মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ২৫ জানুয়ারি বেলা সাড়ে ১১টায় কনভেয়ার ইউনি এক্সপ্রেস নামে একটি কুরিয়ার সার্ভিসে অবৈধভাবে পাচারের জন্য ৩ কার্টন ভর্তি ৪৮৪ জোড়া পাঞ্জাবি ও লেডিস জুতা আনে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট নাসিমা এন্টারপ্রাইজের কাস্টমস সরকার, মোঃ নজরুল ইসলাম (সুজন), লিজাউর রহমান বিপুল, নয়ন মানিকসহ অচেনা আরও ১০-১৫ জন। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে মালামাল খালাসের প্রাক্কালে তাদের কাছে ওই পণ্যগুলোর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখতে চায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। কিন্ত তারা তা দেখাতে না পারায় মালামালগুলো জব্দকালে কর্মকর্তাদের ধাক্কা দেয় এবং হত্যার হুমকি দেয়।
ওই দিন বিকালে এওয়াইজেড এক্সপ্রেস নামে কুরিয়ার সার্ভিসের মালিক জনৈক জাফরকে ওই চালানের করাদি গ্যারান্টার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এতে কামরুজ্জামান লিটন ক্ষুব্ধ হন। ওই রাতেই কাস্টমসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মোবাইল ফোনে হুমকি ধমকি দেন। কিন্ত রহস্যজনক কারণে জাফরকে আসামি করা হয়নি। অথচ এজহারে নয়ন নামে ভারতের দার্জিলিংয়ে এ-লেভেল পড়–য়া এক শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এই মামলা করার আগে একটি গ্রুপ কতিপয় কাস্টমস কর্মকর্তাকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়েছেন। অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে ঢাকা কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মোঃ ইয়াকুত জাহিদ আমাদের সময় ডট কমকে বলেন, যথাযথ নিয়ম মেনেই মামলা দায়ের করা হয়েছে। যারা অবৈধভাবে আনা মাল খালাসের চেষ্টা করেছেন শুধু তাদেরই আসামি করা হয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রলীগ উত্তর বিমানবন্দর থানার সাধারণ সম্পাদক লিজাউর রহমান বিপুল এবং তার দুই মামাতো ভাইয়ের নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করেছে ঢাকা কাস্টম হাউস কর্তৃপক্ষ। বিদেশ থেকে আমদানীকৃত পণ্য খালাসের ঘোষণা দেয় ঝর্ণা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি সিঅ্যান্ডএফ প্রতিষ্ঠান। যথাযথ প্রক্রিয়ায় পণ্য খালাসের আগেই ঢাকা কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার (প্রিভেন্টিভ) শহীদুজ্জামান সরকার এবং সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ইয়াকুত জাহিদ কুরিয়ার শুল্কায়ন গেটে অভিযান চালিয়ে উক্ত পণ্য স্টপ ডেলিভারী করে কাস্টমস সহকারী কমিশনার শহীদুজ্জামানের ব্যক্তিগত গোডাউনে পণ্য জব্দ না করেই জমা করা হয়। পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে বিমান বন্দর থানায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মামলা দায়ের করতে গেলে ওসির নির্দেশে মামলা না করে একটি সাধারণ ডায়েরি করে। ঘটনার ১৬ দিন পর গত ১০ ফেব্রুয়ারী মধ্য রাতে সংঘবদ্ধ চোরাকারবারিদের সাথে গোপন আঁতাতে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে চোরাকারবারি-পুলিশ-কাস্টমস সমঝোতায় ছাত্রলীগ উত্তর বিমানবন্দর থানার সাধারণ সম্পাদক লিজাউর রহমান বিপুল এবং তার দুই মামাতো ভাই সুজন ও নয়নের নাম যুক্ত করে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করে বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন