বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

ওয়ান ইলেভেন কুশীলবদের বিচার দাবিতে বিএনপি-আ’লীগের একই আওয়াজ

প্রকাশের সময় : ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

তারেক সালমান : দীর্ঘ সাত বছর পর দেশীয় রাজনীতিতে বহুল আলোচিত ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় যারা রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীদের উপর নির্মমভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করেছেন সেই সব কুশীলবদের বিচারের দাবিতে এক কন্ঠে বক্তব্য দিচ্ছেন সরকারবিরোধী দল বিএনপি এবং ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। দল দু’টির নেতারা ওয়ান ইলেভেনের সময় কে কি করেছে তা খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিশন গঠন করারও দাবি জানান। এর আগে এক এগারোর সময় ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার সঙ্গে জড়িত গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট ও ব্যক্তিদের বিচার করার ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা গ্রহণ করে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত ফখরুদ্দীন আহমেদের সরকার। ২০০৬ সালের শেষভাগে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী জোট সরকার ক্ষমতা ছাড়ার পর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতা-হানাহানির আপাত অবসান ঘটে ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের জরুরি অবস্থা জারির মধ্য দিয়ে। একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ ছেড়ে দেন তিনি। বাতিল করা হয় ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন। ওই বিশেষ সরকারের প্রধান হিসেবে ফখরুদ্দীন দায়িত্বপালন করলেও পেছন থেকে সকল কলকাঠি তৎকালীন সেনা প্রধান বর্তমানে নির্বাসিত জীবন যাপনকারী জেনারেল মঈনুদ্দীন আহমেদের হাতে ছিল বলে রাজনীতিবিদদের অভিযোগ।
দেশজুড়ে উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠার মধ্যে সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, জনগণের জানমালের নিরাপত্তা ও অর্থনীতির স্বার্থে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছেন। সেদিন সন্ধ্যা থেকেই জরুরি অবস্থা কার্যকর হয়। রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত ঢাকাসহ সব মহানগরী ও জেলা শহরে ঘোষণা করা হয় কারফিউ।
গভীর রাতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ সুগম করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পরদিন সেনা বাহিনীর সমর্থন নিয়ে নতুন প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্ণর ফখরুদ্দীন আহমদ। ‘ওয়ান ইলেভেন’র পট-পরিবর্তন নানান অস্বস্তির জন্ম দেয় শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। দল ভাঙা-দল গড়ার ‘খেলা’ও ওই সময়ে দেখে জনগণ। ১১ জানুয়ারি ক্ষমতার পালাবদলের পর জরুরি ক্ষমতার আওতায় রাজনৈতিক কর্মকা- নিষিদ্ধ হয়েছিল। দুর্নীতির মামলায় বহু রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এক পর্যায়ে গ্রেফতার হন শীর্ষ দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া।
এদিকে, এই প্রথম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নাম উল্লেখ করে গত ২২ ফেব্রুয়ারি মহান একুশে ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমাকে আর খালেদা জিয়াকে মাইনাস করতে চেয়েছিলেন দুই সম্পাদক।
শেখ হাসিনা বলেন, এই দুটি পত্রিকা সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারের সময় ডিজিএফআইয়ের লিখে দেয়া মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে রাজনীতি থেকে আমাকে এবং খালেদা জিয়াকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। আর ডেইলি স্টার সম্পাদক আমাকে দুর্নীতিবাজ বানানোর বহু চেষ্টা করেছেন। তিনি তা স্বীকারও করেছেন। কিন্তু তাদের পিতৃতুল্য বিশ্বব্যাংকও দুর্নীতিবাজ বানাতে পারেনি। আসলে সত্য কখনও চাপা থাকে না।
এরপর গত বুধবার দুপুরে রাজধানীর পল্টনের বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে এক আলোচনা সেই সময়ের ষড়যন্ত্রে জড়িত রাজনীতিবিদদের বিচার দাবি করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ। তিনি বলেন, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের তথাকথিত সংস্কারপন্থিরা তখন মনে করেছিল, এই দুই মহিলাকে (শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া) সরাতে পারলে তাদের জন্য পোয়াবারো। কিন্তু তাদের সে স্বপ্ন সফল হয়নি। জনগণ ও গণমাধ্যম থেকে তথ্য নিয়ে সঠিক তদন্তের মাধ্যমে সেই ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার করতে হবে।
এদিকে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ বক্তব্যকে ইতিবাচক বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বর্তমানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি শান্ত থাকায় দেশে একটা সুবাতাস বইছে। সরকার মাঠের বিরোধীদল সবাই একটু নরমসুরে কথা বলছেন। বর্তমান রাজনীতি প্রসঙ্গে নৌ ও পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, আমি মনে করি রাজনীতিতে সুবাতাস বইছে। বিএনপি ভুল বুঝতে পারলে, সঠিক পথে আসলে রাজনীতির এ সুবাতাস অব্যাহত থাকবে। তবে গত সোমবার সকালে ধানমন্ডি-৩ সংলগ্ন সড়কে ইংরেজি দৈনিক দ্য ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামকে গ্রেফতার ও পত্রিকা বন্ধের দাবিতে মানববন্ধন করেছেন ঢাকা-১০ আসনের ছাত্রলীগ নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ওয়ান ইলেভেনের সময় কে কি করেছে তা খুঁজে বের করতে তদন্ত কমিশন গঠনের দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় যারা ভিলেন ছিলেন, তারা নায়ক হয়ে যাচ্ছেন। একজন মি. মাহফুজ আনাম। তিনি বলেন ভুল করেছিলেন। রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করবেন, ডাক্তার সাহেবরা ডাক্তারি করবেন, সাংবাদিক বন্ধুরা সাংবাদিকতা করবেন। এটাই বড় কথা। যার যার সীমানা আছে। সীমানা কেউ অতিক্রম করলে, ভুল করাই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, রাজনীতিবিদরা ভুল করতেই পারে। তবে রাজনীতিবিদরাই দেশ স্বাধীন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আর শেখ হাসিনা দেশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। রাজনীতিবিদরাই দেশ সৃষ্টি করেছেন। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা ভালো করতে পারেন, খারাপও করতে পারেন।
নাসিম বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় চক্রান্ত করে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিছু অশুভ শক্তি ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল। আমরা সবাই জানি শেখ হাসিনা দক্ষতার সঙ্গে, যোগ্যতার সঙ্গে গণতন্ত্র রক্ষা করেছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গত বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে এক আলোচনা সভায় বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সময় যারা লেখালেখি করেছেন, তাদের বিচারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু যারা সেই সময়ের কুশীলব তাদের বিচার হচ্ছে না। তাদের বিচারের কোনো কথাই বলা হচ্ছে না। যারা রাজনীতিকদের নিয়ে গিয়ে অত্যাচার করেছেন তাদের বিচার করতে হবে।
গত ২২ ফেব্রুয়ারি সোমবার বিকেলে ওসমানী মিলনায়তনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও বলেন, ওয়ান ইলেভেনের সরকারকে আমরা এক ইঞ্চিও ছাড় দিইনি। আমরা তথাকথিত সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসিনি। আমাদের লক্ষ্য ছিল জননেত্রী জেল থেকে বেরিয়ে আসবে, সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা সেই নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়লাভ করব এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করব। ‘রুখে দাও লেলিহান ও জাতীয় সংসদে শাজাহান খান এমপি’ শীর্ষক দুটি গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
সৈয়দ আশরাফ আরও বলেন, অনেকেই আমাদের কাছে এসেছিলেন। বলেছিলেন, আসেন আমরা বিএনপি-আওয়ামী লীগ মিলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে উৎখাত করি। আমরা ভয়ংকর এই প্রস্তাবে রাজি হইনি। আমাদের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক রাজনীতি ফিরিয়ে আনা।
অপরদিকে, গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে ‘সমসাময়িক গণমাধ্যম’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবদের’ বিচারে কমিশন গঠনের যে দাবি বিভিন্ন মহল থেকে উঠেছে, সরকার তা ‘ভেবে’ দেখবে।
ইনু বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে যে কমিশনের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে, এটা সরকার শুনেছে। সরকার পরে এটা ভেবেচিন্তে দেখবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন