প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর : বারো আউলিয়ার পূণ্যস্মৃতি চট্টগ্রাম। পাহাড়, নদী, সাগর এই তিনের মিতালী চট্টগ্রামকে পরিণত করেছে এক মায়াবী জনপদে। এমনি এক নদীর নাম ‘হালদা’। বছরের এক নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে মাছের ‘ডিম ছাড়ার কেন্দ্র’ তথা দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র এই হালদা নদী। কর্ণফুলী থেকে বেরিয়ে এসে পল্লব ঘন তরুরাজি বেষ্টিত সদা বহমান এ হালদা নদীর তীরে অবস্থিত ছায়াময় কাগতিয়া গ্রাম, একটি স্বপ্নিল নাম উপজেলা- রাউজান, জেলা- চট্টগ্রাম। এ গ্রামেরই কৃৃতি সন্তানের কথা- এক মহামনীষীর কথা। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে এ গ্রামের মাইজপাড়ার সম্ভ্রান্ত ও ইতিহাসখ্যাত এক মুসলিম পরিবারে তার জন্ম; বস্তুত তিনিই হচ্ছেন জগদ্বিখ্যাত আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব কাগতিয়া আলীয়া গাউছুল আজম দরবার শরীফের প্রতিষ্ঠাতা খলিলুল্লাহ, আওলাদে মোস্তফা, খলিফায়ে রাসূল (সা.) হযরত শায়খ ছৈয়্যদ গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। ঐতিহাসিক সূত্র মতে, ইসলাম প্রচারক আওলাদে রাসূল (সা.) হযরত শায়খ ছৈয়্যদ বখতেয়ার মাহি ছাওয়ার (রা.) সূদূর আরব থেকে মাছের পিঠে ছাওয়ার হয়ে সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে চট্টগ্রামের বর্তমান বোয়ালখালী থানার চরণদ্বীপ নামক স্থানে অবতরণ করেছিলেন। তাঁরই বংশ পরম্পরায় হযরত শায়খ ছৈয়্যদ গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হুর আত্মপ্রকাশ ঘটে।
গাউছুল আজমের বৈশিষ্ট্য হল- তিনি যুগে যুগে পৃথিবীকে একটি সূতোয় গ্রথিত করার প্রয়াস চালিয়ে থাকেন। যা তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা, আচার-আচরণ, কর্মপ্রণালী ও রচনাবলীর মাধ্যমে বিকীর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি জাগতিক মোহে আবদ্ধ না থেকে স্র্রষ্টার সাথে সম্পর্কোন্নয়নে লিপ্ত থাকেন এবং মানুষ জাগতিক ভোগবিলাসে মাত্রাতিরিক্ত আচ্ছন্ন হয়ে পড়লে তাদেরকে কৃচ্ছ্রতাময় জীবনের আহŸান জানিয়ে থাকেন। তাই তিনি জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকলের প্রতি ভালবাসা, মানবতাবোধ, মানবকল্যাণ এসব মহান আদর্শের মধ্য দিয়ে একটি সহনশীল ও শান্তির সংস্কৃতি গড়ে তোলেন। তাই তো দেখা যায়, হযরত শায়খ ছৈয়্যদ গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হুর দরবারে দোয়াপ্রার্থী হিসেবে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমানের সমাগম। ইসলামের অসাম্প্রদায়িকতার এ যেন এক অপূর্ব দৃশ্য। এ মনীষীর দরবারে দল-মত নির্বিশেষে সকল স্তরের মানুষের ভীড় এটাই প্রমাণ করে যে, তরিক্বতের আলোকে আলোকিত হওয়ার যে পথ, সেটাই হচ্ছে ইসলামের প্রকৃতপথ।
এ মহান মনীষীর অবিনশ্বর কীর্তি হল- কাগতিয়া এশাতুল উলুম কামিল এমএ মাদ্রাসা। আজ এ প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার আলেম ইসলামী আরবি শিক্ষার পাশাপাশি আধুনিক বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দেশ মাতৃকার খেদমত করে যাচ্ছেন। এছাড়াও তিনি দেশ-বিদেশে প্রতিষ্ঠা করেন বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও ইসলামী পাঠাগার। ব্যক্তিজীবনে এ মহান মনীষী তদানীন্তন সময়ের ‘মুমতাজুল মোহদ্দেসীন’ তথা টাইটেল বা কামিল ডিগ্রী অর্জন করে উক্ত প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ পদে সমাসীন হন। উল্লেখ্য যে, হযরত শায়খ ছৈয়্যদ গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হুর পূর্বপুরুষগণ থেকেই যে দ্বীনি খেদমত চলে আসছিল ‘কাতেব বাড়ি’ নামটিই তার স্বাক্ষর বহন করছে। তৎকালে মুদ্রণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতাহেতু নিজ হাতে কিতাবাদি লিখে শিক্ষাদান করতেন বলেই এই নাম। আরও উল্লেখ্য যে, একটি হস্তলিখিত ‘কোরআন মাজীদ’ হযরত শায়খ ছৈয়্যদ গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হুর বাড়িতে আজও সংরক্ষিত আছে।
গতানুগতিক প্রথা-সর্বস্ব পীর-মুরিদীর উপলব্ধিহীন এবাদতের পরিবর্তে শরীয়তের সাথে রূহানীয়তের সমন্বয়ে এক অনন্য ধ্যান-ধারণার আলোকে প্রদীপ্ত, সুস্পষ্ট উপলব্ধিগত, বাস্তবস্পর্শ সত্য আধ্যাত্মপথকে আলোকবর্তিকারূপে গ্রহণ করাই হচ্ছে এ মহান মনীষীর তরিক্বতের প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ্যক্রম। তিনি জ্ঞানের সেই দিকটির প্রতিনিধিত্ব করছেন যা হৃদয় থেকে হৃদয়ে পরিবাহিত হয় এবং অনুভূতি ও ধ্যানের ওপর নির্ভরশীল প্রত্যক্ষ ও সঙ্গজাত জ্ঞানের রূপান্তর। এ যেন কোয়ান্টাম ফিজিক্স’র ঊীঃৎধ ঝবহংরহম চবৎপবঢ়ঃরড়হ-এর নামান্তর।
বর্তমান বিশ্বের অশান্তময় পরিবেশ তথা ধর্মের নামে সৃষ্ট অরাজক পরিস্থিতিতে ইসলামের আধ্যাত্মিক কার্যক্রম বা আলোকিত পদ্ধতিতে ধর্মীয় অনুশাসন পালনই পারে কাক্সিক্ষত শান্তি ফিরিয়ে আনতে। আলোকিত পরিবেশে নামাজ পালন, কোরআন পঠন ও ইসলামী জীবনযাপনের জন্য তাঁর দরবারে চালু রয়েছে সারা বছরব্যাপী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা; চালু রয়েছে প্রতিষ্ঠানভিত্তিক, মসজিদভিত্তিক, এলাকা ও নগরভিত্তিক এশায়াত সম্মেলন, এশায়াত মাহফিল, এশায়াত সেমিনার, গাউছুল আজম কন্ফারেন্স, তরিক্বত কন্ফারেন্স ইত্যাদির আয়োজন।
তদুপরি প্রকাশনা পরিষদ গঠনের মাধ্যমেও ইসলামের মরমী দর্শনকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতেও তিনি প্রয়াস নিয়েছেন। ইসলামের অন্তর্নিহিত শক্তি নূর বা আলো; এর সাথে সম্পৃক্ত না হওয়া পর্যন্ত মানবীয় দোষত্রæটি দুরীভূত হয় না- অধৈর্য, অকৃতজ্ঞতা, অনৈক্যতা, অহংকার ইত্যাদি দোষাবলী হতে মুক্ত হওয়া যায় না। কালজয়ী আধ্যাত্মিক মনীষী হযরত শায়খ ছৈয়্যদ গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হু অভ্যন্তরীণ পরিশুদ্ধির কাজটিই করতেন, যা বর্তমান বিশ্বের জন্য একটি অনুকরণীয় উদাহরণ। বিশ্ব আজ স্পষ্ট সুদৃষ্টিতে আলোকিত মানুষের দিকে তাকিয়ে আছে; যতবেশি সংখ্যক আলোকিত মানুষের হার বাড়বে, ততই বিশ্ব সভ্যতার অগ্রগতি ত্বরান্বিত হবে।
এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে হযরত শায়খ ছৈয়্যদ গাউছুল আজম রাদ্বিয়াল্লাহু আন্হু প্রতিষ্ঠা করেন কাগতিয়া আলীয়া গাউছুল আজম দরবার শরীফ। গঠন করেন অরাজনৈতিক তরিক্বতভিত্তিক আধ্যাত্মিক সংগঠন মুনিরীয়া যুব তবলীগ কমিটি বাংলাদেশ, দেশে-বিদেশে যার ২০০টিরও বেশি শাখা ও উপশাখা রয়েছে।
এ মহান মনীষীর অনুসৃত তরিক্বতের পাঠ্যক্রমে মহিলাদেরকে আলোকিত মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার ব্যাপারটিও প্রণিধানযোগ্য। এতে মহিলাদের অনুপস্থিতিতে তাদেরকেও ঊ.ঝ.চ পদ্ধতি তথা তাসাউফের ভাষায় তাওয়াজ্জুহ্ বিল গায়েবের মাধ্যমে মানবীয় গুণাবলী বিকাশে উদ্বুদ্ধ করা হয়। নারী শিক্ষার ব্যাপারে একদিকে তাঁর মাদ্রাসায় পুঁথিগত জ্ঞান প্রদানের ব্যবস্থা, অন্যদিকে তরিক্বত পাঠ্যক্রমে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের ব্যবস্থা উভয়টা মিলে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছেন তিনি।
এ মহান মনীষী গত ২৬ রজব ১৪৩৭ হিজরি, ৪ মে ২০১৬ খ্রিস্টাব্দ বুধবার সকাল ১১.১০ মিনিটে প্রিয় রাসূল (সা.)’র সাথে মেরাজের বরকতময় মাসে আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁরই সান্নিধ্যে চলে যান। বর্তমানে তাঁরই জাহিরী এবং বাতেনী যাবতীয় কাজ অবিকল আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছেন তাঁরই গাউছিয়্যতের দায়িত্বপ্রাপ্ত একমাত্র প্রতিনিধি মুনিরীয়া যুব তবলীগ কমিটি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, কাগতিয়া এশাতুল উলুম কামিল এম.এ. মাদ্রাসার স্বনামধন্য অধ্যক্ষ, আওলাদে রাসূল হযরতুলহাজ্ব আল্লামা শায়খ ছৈয়্যদ মুহাম্মদ মুনির উল্লাহ্ আহমদী মাদ্দাজিল্লুহুল আলী।
লেখক : সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন