আফজাল বারী : রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা-সমালোচনার খোরাক এখন বিএনপি। প্রায়দিন সভা-সমাবেশ ও গোলটেবিলে। দিন শেষে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাতের টিভি টক-শোতে। পরদিন ভোর বেলায় সারাংশ মিলে পত্রিকার পাতায়। মুখরোচক তুমুল আলোচনা আর মোটা হরফের শিরো নাম। তাতে উল্লেখ থাকে- বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হতে পারে, দলটির চেয়ারপার্সনের সাজা হতে পারে, দলটি আরেকদফা ভাঙতে পারে, দলীয় কার্যালয় নিলামে উঠতে পারে দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ জিয়ার মাজার সরানো হতে পারে, দলটির পরিণতি মুসলিম লীগের মতো হতে পারে। ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য এই শিরোনামের বাস্তবতা এখনো অন্ধকারে।
এসব নিয়ে আলাপকালে বিএনপির হাইপ্রোফাইলের নেতারা ইনকিলাবকে বলেন, বিষয়টি এমনতর যে ‘যার বিয়ে তার খবর নাই; প্রতিবেশির ঘুম নাই’। ও সবই অপপ্রচার। সরকারের সৃষ্টি। সাথে কিছু দলবাজ গণমাধ্যম। বিএনপি এসবের পাত্তাই দিচ্ছে না।
বিএনপির কাছে খবর হলোÑ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপিকে নানাভাবে চাপে রাখার যে মনোভাব ছিল সরকারি দলে, সেটা এখনো আছে। গত নির্বাচনের আগে সরকারের পরিকল্পনার বিপরীতে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলোর সামনে আন্দোলনসহ অন্য বিকল্প ছিল না। আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপিকে অন্য বিকল্প নিয়ে ভাবারও সুযোগ দেবে না সরকার। নির্বাচন কমিশন, ইভিএমসহ নানান ছক কষে আছে তারা।
সরকারি দলের নেতারা মনে করছেন, সাংবিধানিক সব বাস্তবতা মেনে নির্বাচনে অংশ নেয়া ছাড়া বিএনপির সামনে খুব একটা বিকল্পও নেই। কারণ, পরপর দু’বার জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিলে রাজনৈতিক দল হিসেবে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার মতো আইনি জটিলতায় পড়বে বিএনপি। এছাড়াও খালেদা জিয়া এই মুহূর্তে ৩৭টি মামলার আসামি। তারমধ্যে একটিতে বিচার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে এসেছে। নজির রয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচএম এরশাদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা চলছে দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে। ওই সময়ের মধ্যে তিনিও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন।
প্রধানমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলামও বলেছেন খালেদা জিয়ার সাজা হবেই। কামরুল ইসলাম আরো বলেছেন, খালেদা জিয়ার সাজা হলেই দলটির নেতারা আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে। আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মতে, নিবন্ধন বাতিলের মতো ঝুঁকি নিয়ে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করবে না। তারা অংশ নেবেই।
আলাপকালে বিএনপি নেতারা জানিয়েছেন, দীর্ঘ ৯ বছর ধরেই বিএনপির নেতাকর্মীদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন-নিপীড়ন চলছে। নেতার বাসা-বাড়ী ক্রোকের মতো নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। প্রতিদিনই ডজন ডজন নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে। গ্রেফতার করা হচ্ছে নিত্যদিন। এমন পরিস্থিতিতে সারা দেশে কোটি কোটি নেতাকর্মীর মধ্যে হাজার নেতাও দল ত্যাগ করেনি। বরং নিষ্ক্রিয়রা সক্রিয় হয়েছেন। সুতরাং দল ভাঙ্গার কল্পকাহিনী বাস্তবরূপ পাবে না।
খালেদা জিয়ার মামলা প্রসঙ্গটি খোলাসা করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহম্মদ। তিনি বলেছেন, খালেদা জিয়ার সাজা হলেও তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন, তাতে কোনো বাধা থাকবে না। গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়া ছাড়া চিন্তাও অবান্তর।
নিবন্ধন প্রসঙ্গে দলটির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছেন, বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হলে দেশে কোনো দলেরই নিবন্ধন থাকবে না।
বেগম খালেদা জিয়াকে ‘মিথ্যা মামলা প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাগুলোর তথ্য-উপাত্ত-যুক্তি নেই। ওইসব মামলা সবটাই বানোয়াট ও মিথ্যা, কোনটাই প্রমাণ করতে পারবে না সরকার। তারা এই মামলা দিয়ে দেশনেত্রীকে মানসিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে আমাদেরকে দুর্বল করতে চায়। এই সরকার বেগম জিয়াকে দিতে পারবে না, কোনো আদালতই দিতে পারবে না। খালেদা জিয়ার শাস্তি হবে এবং শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন হবে- এই দুইটি বিষয় নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা মাঠে নেমেছেন। তারা দিবা স্বপ্ন দেখছেন।
ওবায়দুল কাদেরের প্রতি প্রশ্ন রেখে রিজভী আহম্মেদ বলেন, আরে রেজিস্ট্রেশন কী? আপনারা যখন ’৭৯ সালে, ’৮৬ সালে নির্বাচনে গিয়েছিলেন, কোন নিবন্ধনের উপরে নির্বাচনে গিয়েছিলেন? নিবন্ধন হচ্ছে একটি রাজনৈতিক দলের প্রতি জনগণের ইচ্ছা-অনিইচ্ছাটাই বড় নিবন্ধন। বিএনপির নিবন্ধন বাতিল করে প্রহসনের নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ আজীবন ক্ষমতায় এবং রাজ সিংহাসনে শেখ হাসিনা রাজত্ব করবে। এই সুখ-স্বপ্ন ভুলে যান ওবায়দুল কাদের। এই দেশটি ছোট হলেও সাড়ে ১৬ কোটি মানুষকে আপনি নিবন্ধনের ফিতায় বাঁধবেনÑ সেই সুখ-স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হবে না।
বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত অক্টোবর থেকে ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত খালেদা জিয়ার সাথে দেশ-বিদেশের তৃণমূলের প্রায় আড়াই হাজার নেতাকর্মীর সাক্ষাৎ হয়েছে। দীর্ঘ সময় ওই সকল নেতাকর্মীদের নানা বিষয়ে কথা শুনেছেন বিএনপি প্রধান। সমস্যা-সম্ভাবনার পাশাপাশি নেতারা আশঙ্কা প্রকাশ করে দলীয় প্রধানের কাছে জানতে চেয়েছেন। ম্যাডাম শুনছি সরকার নাকি আপনাকে সাজা দিবে, নির্বাচনের বাইরে রাখবে? অভয় দিয়ে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে খালেদা জিয়া বলেছেন, জেল-জুলুমে আমি ভীত নই। এখনো তো জেলেই আছি। দেশের মানুষ তো অঘোষিত জেলেই বসবাস করছে। সময় বলে দেবে। হতাশ হবার কারণ নেই। উল্টো প্রশ্ন রেখে খালেদা জিয়া বলেছেন, বলুন তো রাতে চলার পথে মানুষ কেনো দরাজ গলায় গান গায়? জবাবে নেতারা বলেন, যখন ভয় পায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন